রাজ্যে ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন (এসআইআর) প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগেই বুথ লেভল অফিসারদের (বিএলও) নিয়ে বিতর্কের মাত্রা বাড়ছে। পরপর দু’দিন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভোটার তালিকা সংশোধনের ক্ষেত্রে বিএলও-দের হুঁশিয়ারি দেওয়ার পরে এ বার রাজ্য প্রশাসন ওই প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করছে বলে অভিযোগ তুললেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের পাল্টা প্রশ্ন, নির্বাচন কমিশন কী করবে, তা শুভেন্দুরা বলে দিচ্ছেন কেন?
বোলপুরে প্রশাসনিক বৈঠক থেকে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, এ রাজ্য থেকে এক হাজার বিএলও-কে যে দিল্লিতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, সে কথা জেলাশাসকেরা রাজ্য প্রশাসনকে জানাননি। এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না হয়, তার জন্য জেলাশাসকদের সতর্ক করেন তিনি। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু বুধবার নির্বাচন কমিশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে অভিযোগ করেন, মুখ্যমন্ত্রীর ওই হুঁশিয়ারির পরে রাজ্যের মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ জেলাশাসকদের ‘মৌখিক’ নির্দেশ দিয়েছেন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এক হাজার বিএলও-কে বদলে দেওয়ার জন্য। বিরোধী দলনেতার দাবি, রাজ্য সরকার যে ভাবে কমিশনের কাজে ‘অবৈধ’ হস্তক্ষেপ করছে, তার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। জেলাশাসক তথা জেলা নির্বাচন আধিকারিকদের (ডিইও) উদ্দেশেও বিরোধী দলনেতার আবেদন, এই পরিস্থিতিতে রাজ্য প্রশাসনের কারও ‘মৌখিক’ বার্তার ভিত্তিতে তাঁরা যেন নির্বাচন সংক্রান্ত কোনও কাজ না করেন। তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্য সহ-সভাপতি জয়প্রকাশ মজুমদারের পাল্টা অভিযোগ, ‘‘হুমকি দিয়ে শুভেন্দু প্রমাণ করছেন, ভোটার তালিকা দলের প্রয়োজন মতো বদল করতে চাইছে বিজেপি! আমরা নজর রাখছি।’’ তাঁর প্রশ্ন, ‘‘কমিশন কী করবে, তা শুভেন্দুরা বলে দিচ্ছেন কেন?’’
এই টানাপড়েনে এসআইআর নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে ‘চ্যালেঞ্জ’ করে সমাজমাধ্যমে সরব হয়েছেন দুর্গাপুরের এক বিএলও। দুর্গাপুরের এক প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক তথা বিএলও চিরঞ্জিত ধীবর সমাজমাধ্যমে লিখেছেন, ‘আমি মুখ্যমন্ত্রীকে চ্যালেঞ্জ করছি, ভুয়ো, মৃত ভোটার পেলে অবশ্যই নাম বাদ দেব। আমি বিএলও। নিরপেক্ষ ভাবে ডিউটি করা আমার দায়িত্ব। আমাদেরকে আপনি চাকরি দেননি যে, চাকরি কেড়ে নেওয়ার ভয় দেখাবেন।’ চিরঞ্জিত এ দিন বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী পরোক্ষে বলেছেন, বিএলও-রা এমন ভাবে ডিউটি করুন, যাতে কারও নাম বাদ না যায়। কিন্তু ভুয়ো ভোটার, মৃত ভোটার ছাড়াও, খবরের কাগজে দেখছি, বাংলাদেশে এবং এই দেশ, দুই জায়গায় নাম থাকা ভোটার, দেশের দুই রাজ্যে নাম থাকা ভোটারের কথা সামনে আসছে। নিয়ম মেনেই সে সব বাদ যাবে। এখানে রাজনীতির ব্যাপার নেই।’’ যদিও তৃণমূলের দাবি, বিজেপি সমর্থক বলে পরিচিত ওই বিএলও মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের ‘অপব্যাখ্যা’ করছেন। বিজেপির পাল্টা দাবি, ওই বিএলও-র বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করা হলে তারা পাশে থাকবে।
হুগলির খানাকুলে ‘কন্যা সুরক্ষা যাত্রা’য় গিয়েও বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু ফের অভিযোগ করেছেন, ‘‘এখানে রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি মুসলমানদের ডেকে আনা হচ্ছে। প্রশাসনিক স্তরকে তাদের কার্ড করে দেওয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘কেন বাধা দেওয়া হচ্ছে ভোটার তালিকা নিয়ে? আমি কথা দিয়ে যাই, এক জন ভারতীয়েরও, তিনি হিন্দু-মুসলমান যা-ই হোন, কারও নাম ভোটার-তালিকা থেকে বাদ যাবে না। বাদ যাবে মৃত, ভুয়ো ভোটার, রোহিঙ্গা, বাংলাদেশি মুসলমানদের।’’
এই বিতর্কের মধ্যে এসইউসি-র রাজ্য সম্পাদক চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘‘এক দিকে কেন্দ্রীয় সরকারে আসীন দলের স্বার্থে কমিশনের মাধ্যমে বিরাট সংখ্যক বৈধ ভোটারের নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার পরিকল্পনা, অন্য দিকে তার প্রতিবাদে রাজ্য সরকারের অধীনে কর্মরত বিএলও-দের মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষ থেকে সেই কথা বার বার স্মরণ করানোর দ্বারা কার্যত চাপ সৃষ্টি করা---- দুই দলের পরিচালনাধীন সরকারের অগণতান্ত্রিক চরিত্রকেই প্রকাশ করছে।’’ গরিব ও পরিযায়ী শ্রমিকদের কাগজের জন্য যাতে হয়রানি না হয়, কমিশনের তা নিশ্চিত করার সঙ্গে বিএলও-দের নিরপেক্ষ ভাবে কাজের ব্যবস্থা করার দাবি তুলেছেন তাঁরা। অন্য দিকে, বিএলও হিসেবে স্থায়ী শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের নিয়োগ করা নিয়ে আপত্তি তুলেছে ‘শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী বিএলও ডিউটি প্রতিরোধ মঞ্চ’। তারা নিরাপত্তার প্রশ্ন তুলে দাবিপত্র জমা দিয়েছে মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকের (সিইও) দফতরে। তবে কমিশন সূত্রের বক্তব্য, নিরাপত্তার ঘাটতি রাখা হবে না। প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় বাহিনীর সহযোগিতা নেওয়ার কথাও ভাবা হতে পারে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)