Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

বিবিধের মাঝে সিএজি পাচ্ছে বেহিসেবের ছায়া

খড়দহের একটি ক্লাবের কালীপুজোয় এ বার বাজেট ছিল তিন লক্ষ টাকা। পুজোর শেষে ক্লাবের অভিজ্ঞ হিসাবরক্ষক হিসেবের খাতায় ‘বিবিধ’ খাতে হাজার তিনেক টাকা খরচ দেখিয়েছেন। এতে পুজোর স্মারক পত্রিকায় জমা-খরচের হিসেব মিলে গিয়েছে অব্যর্থ ভাবে। খড়দহের বিধায়ক তথা রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র চলতি বছরের বাজেট প্রস্তাব পেশ করে শুরুতেই জানিয়ে দিয়েছেন, এ বার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ‘বিবিধ’ খাতে আয় ও ব্যয়ের জন্য প্রায় ৩১ হাজার কোটি টাকা রাখছে। এবং অর্থ বছরের শেষে অঙ্কটা আরও বাড়তে পারে।

জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:৪০
Share: Save:

খড়দহের একটি ক্লাবের কালীপুজোয় এ বার বাজেট ছিল তিন লক্ষ টাকা। পুজোর শেষে ক্লাবের অভিজ্ঞ হিসাবরক্ষক হিসেবের খাতায় ‘বিবিধ’ খাতে হাজার তিনেক টাকা খরচ দেখিয়েছেন। এতে পুজোর স্মারক পত্রিকায় জমা-খরচের হিসেব মিলে গিয়েছে অব্যর্থ ভাবে। খড়দহের বিধায়ক তথা রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র চলতি বছরের বাজেট প্রস্তাব পেশ করে শুরুতেই জানিয়ে দিয়েছেন, এ বার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ‘বিবিধ’ খাতে আয় ও ব্যয়ের জন্য প্রায় ৩১ হাজার কোটি টাকা রাখছে। এবং অর্থ বছরের শেষে অঙ্কটা আরও বাড়তে পারে।

যে খাতে বছরের শুরুতে এক টাকাও আদায় বা খরচ হওয়ার কথা নয়, সেখানে এই বিপুল পরিমাণ বরাদ্দের কথা জেনে চোখ কপালে উঠেছে দেশের হিসেব পরীক্ষক সংস্থা কন্ট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (সিএজি)। তাদের প্রশ্ন, এমনটা হয় নাকি? শুধু প্রশ্ন তুলেই থেমে যায়নি সিএজি। রাজ্য সরকারকে ‘নোট’ পাঠিয়ে তারা বলেছে, এই কাজ নিয়মবিরুদ্ধ। এমন বিরাট অঙ্কের টাকা বিবিধ খাতে ধরা যায় না। এটা শুধরে নেওয়া প্রয়োজন।

সিএজি-র এই পর্যবেক্ষণের পরেও অবশ্য অর্থ দফতর টুঁ-শব্দ করছে না। গত বছরের তুলনায় এ বার কেন বিবিধ খাতে বরাদ্দ অনেকটাই বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তার স্পষ্ট ব্যাখ্যাও দিচ্ছে না তারা। সিএজি-র নোট নিয়ে অমিতবাবুর মতামত জানতে তাঁকে ফোন করা হয়েছিল। এসএমএস-ও পাঠানো হয়। কোনওটারই জবাব মেলেনি।

অর্থনীতির নিয়মে, যে কোনও হিসেবের খাতায় বিবিধ বা ‘মিসলেনিয়াস’ নামে একটি খাত থাকে। পরিকল্পনার বাইরে বা আচমকা কোনও খরচ হয়ে গেলে তা বিবিধ খাতে ধরা হয়। একই ভাবে, হিসেবের বাইরে কোনও অর্থ এসে পড়লে তা-ও ওই খাতে আয় বলে দেখানো হয়। তবে বাজেট করার সময়ই এই খাতে আয় বা ব্যয়ের সংস্থান রাখা উচিত নয়। অর্থনীতিবিদদের মতে, বিবিধ খাতে আয় ও খরচ স্বাস্থ্যকর লক্ষণ নয়। বরং বেহিসেবি আয়-ব্যয়কে শিলমোহর দিতেই বিবিধ খাতটি ব্যবহার করা হয়। তাঁদের কথায়, “এর মধ্যে একটা গোঁজামিল দেওয়ার প্রবণতা থাকে।”

মমতার অর্থমন্ত্রী কিন্তু চলতি অর্থবর্ষের শুরুতেই বিবিধ খাতের জন্য বাজেটের একটা বড় অংশ রেখে দিয়েছেন। ২০১৪-’১৫ সালের জন্য ১ লক্ষ ৩০ হাজার কোটি টাকার বাজেট পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী। এর মধ্যে বিবিধ খাতে ৭ হাজার ২২৫ কোটি টাকা খরচ এবং ২৩ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা আয় হিসেবে মোট ৩০ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকা দেখানো হয়েছে। অর্থাৎ, মোট ব্যয় হিসেবে যা দেখানো হয়েছে, বিবিধ খরচ তার ৫.৮৬%। একই ভাবে মোট আয়ের ২১.৮৭%-ই দেখানো হয়েছে বিবিধ আয় হিসেবে। সিএজি-র এক কর্তা বলেন, “কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে এই খাতে টাকা জমা-খরচের কথা বলেছে। সেই হিসেবে বাজেটের শুরুতে এই খাতে কোনও টাকাই থাকা উচিত নয়। রাজ্য সরকার সব জেনেও কেন্দ্রের নির্দেশ অমান্য করছে।”

অর্থমন্ত্রী নীরব থাকলেও তাঁর দফতরের একাধিক শীর্ষ কর্তা মেনে নিয়েছেন, নিয়মবিরুদ্ধ ভাবেই বিবিধ খাতে আয়-ব্যয় দেখানো হচ্ছে। তাঁদের একাংশের ব্যাখ্যা, বাজেটে জমা-খরচের জন্য ৯টি খাত (হেড) তৈরি করে দিয়েছে অর্থ মন্ত্রক। এর মধ্যে চারটি মেজর, দু’টি সাব মেজর এবং তিনটি মাইনর হেড নামে পরিচিত। কেন্দ্র ও সব রাজ্যের বাজেটে এই ন’টি খাত থাকাটা বাধ্যতামূলক। দেশের ৩০টি রাজ্যে সরকারি কোষাগারের যাবতীয় লেনদেন হয় মূলত ওই ন’টি নির্দিষ্ট খাতের মাধ্যমে। অর্থকর্তাদের ব্যাখ্যায়, মৌমাছির চাকে প্রতিটি মৌমাছি তার নির্দিষ্ট জায়গায় থাকে। ফলে কোনও গোলমাল হয় না। নির্দিষ্ট খাতের মাধ্যমে আয়-ব্যয় হলে সেই শৃঙ্খলা বজায় থাকে। এর বাইরে বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য একটি খাত (হেড অন অ্যাকাউন্টস) তৈরি করা হয়, যা জেনারেল হেড নামে পরিচিত। এই খাতে কোন কোন প্রকল্পের আয়-ব্যয় ধরা হবে, তা ঠিক করে সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলি।

বাজেটে ৮০০ নম্বর নামে একটি হেড থাকে, যেখানে বিবিধ বা মিসলেনিয়াস জমা-খরচের হিসাব দেখানো হয়। অর্থকর্তারা বলছেন, একান্ত ব্যতিক্রম হিসেবে কোনও আয় বা ব্যয় হলে তা বিবিধ খাতে দেখানো হয়। কিন্তু সিএজি মনে করছে, এ রাজ্যে জমা-খরচের চালু নিয়ম প্রতিনিয়ত অগ্রাহ্য করা হচ্ছে। বিবিধ খাতের মাধ্যমে যেমন খুশি খরচ হচ্ছে, অর্থ জমাও পড়ছে। ফলে আর্থিক শৃঙ্খলা রক্ষার রীতিটাই ভেঙে পড়ছে।

কী ভাবে ঘটছে এমন ঘটনা? অর্থ দফতর সূত্রের খবর, এ বার বিবিধ খাতে যে আয় দেখানো হয়েছে, তার মধ্যে ২২ হাজার ৬২৮ কোটি টাকাই কেন্দ্রের থেকে আসা অনুদান। একই ভাবে, বিদ্যুৎ শুল্ক থেকে যে আয় হয়, তার ১৯২ কোটি টাকা বিবিধ খাতে দেখানো হয়েছে। রাজ্য সরকার বিভিন্ন পুরসভা, পঞ্চায়েত, সমবায় এবং রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে ঋণ দিয়ে থাকে। তার সুদ বাবদ মোটা টাকা আয় হয়। এ রকম সুদ থেকে পাওয়া ৩৬৭ কোটি টাকাও বিবিধ খাতে আয় বলে দেখিয়েছেন অমিতবাবু। অথচ বিদ্যুৎ শুল্ক থেকে প্রাপ্ত অর্থ দেখানো উচিত ছিল সংশ্লিষ্ট দফতরের নির্দিষ্ট খাতে।

একই ভাবে কেন্দ্রীয় অনুদান যে সব দফতর পাবে, সেই সব দফতরের নির্দিষ্ট খাতে অনুদানের হিসাব থাকার কথা। অর্থ দফতরের এক শীর্ষ কর্তা জানাচ্ছেন, কেন্দ্রীয় অনুদানের টাকা বিবিধ খাতে আয় হিসাবে দেখানোয় রাজ্য বাজেটের স্বচ্ছতাই নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।

আবার, অর্থ দফতরই যে হেতু কোনও সংস্থাকে ধার দেয়, তাই সুদের টাকা তাদের খাতেই জমা পড়ার কথা। ওই সূত্রের বক্তব্য, নির্দিষ্ট খাতে আয়ের টাকা রাখলে তা অন্য খাতে ব্যয় করা কঠিন হয়ে পড়ে। সেই কারণেই বিবিধ খাতে টাকা রেখে যে কোনও কাজে তা খরচ করার পথ খোলা রাখা হয়েছে।

শুধু আয় নয়, খরচের ক্ষেত্রেও দায় এড়াতে নির্দিষ্ট প্রকল্পভিত্তিক খরচও বিবিধ হিসাবে দেখিয়েছে অর্থ দফতর। যেমন ত্রিস্তর পঞ্চায়েতে গাড়ি, বাড়ি, মহার্ঘ ভাতা, ভ্রমণ খরচ, স্বাস্থ্য বিমার টাকা, বোনাস, টেলিফোন, বিদ্যুতের বিল, নানা অনুদান, ভাতা এবং শিশু শিক্ষা কর্মসূচি বাবদ ৪৩৫ কোটি টাকা খরচ বিবিধ খাতে দেখানো হয়েছে। বিদ্যুৎ দফতরের জন্য দ্বাদশ পরিকল্পনার ২৪৮ কোটি টাকার খরচ হবে বিবিধ খাত থেকে। একই ভাবে, জলসম্পদ উন্নয়ন দফতরের জমি-বাড়ি-অতিথিশালার রক্ষণাবেক্ষণ, শ্যালোতে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার ভর্তুকি কিংবা যাবতীয় রক্ষণাবেক্ষণের কাজ বিবিধ খাতের খরচ থেকে হচ্ছে। এ বাবদ ২৪২ কোটি রাখা হয়েছে। এমন নানাবিধ খরচ সংশ্লিষ্ট দফতরের নির্দিষ্ট খাতের বদলে বিবিধ খাত থেকে হওয়ায় আপত্তি জানিয়েছে সিএজি।

কিন্তু রাজ্য এমন করছে কেন? দফতরের এক কর্তার কথায়, “মুখ্যমন্ত্রীর ইচ্ছাপূরণ করতে গত তিন বছর হঠাৎ হঠাৎ নানা খরচের ধাক্কা এসে পড়ছে। তা ‘স্টেজ ম্যানেজ’ করতেই বিবিধ খাতে অগ্রিম টাকা রাখতে হচ্ছে। সেখান থেকে খরচ করা হচ্ছে।” অনেকে আবার জানিয়েছেন, অর্থ দফতরের অফিসারদের একাংশ নিময়নীতির তোয়াক্কা করছেন না। তাঁরা নির্দিষ্ট খাতের বদলে বিবিধ খাতের মাধ্যমেই জমা-খরচ করতে বেশি উৎসাহী।

নবান্নের খবর, প্রিন্সিপ্যাল অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেল স্টিফেন হংরে সম্প্রতি এন্ট্রি কনফারেন্সের সময় এই সব গরমিলের কথা রাজ্যের অর্থসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদীর কাছে নোট পাঠিয়ে জানিয়েছেন। তাতে বলা হয়েছে, ২০০৯ সালের ২০ জানুয়ারি অর্থ মন্ত্রক এক আদেশনামায় বিবিধ খাতে খরচের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা নিতে বলেছে। কোষাগারের অর্থ খরচ হলে তা কোন খাতে হচ্ছে, তা জানা জরুরি। কিন্তু বিবিধ খাতে খরচ হলেই অস্বচ্ছতার বীজ বোনা হয়। ঠিক কোথায় টাকা খরচ হল, তা বোঝা মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। সরকারের প্রাপ্য টাকাও নির্দিষ্ট খাতে জমা হওয়ার কথা। তা না হয়ে বিবিধ খাতে জমা পড়ায় বেনিয়ম হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়।

অর্থ দফতরের কর্তারা অবশ্য বলছেন, কেন্দ্রের নির্দেশিকা সত্ত্বেও বর্তমান পরিস্থিতিতে বিবিধ খাতে টাকা রাখা ছাড়া বিশেষ উপায়ও নেই। কারণ, বাজেটে উল্লেখ নেই এমন বহু খরচ হচ্ছে আচমকাই। এবং সেটা বছরের যে কোনও সময়। সরকারের মেলা-খেলা-উৎসব-ভাতা-অনুদান দেওয়ার জন্য যে অর্থ খরচ হচ্ছে, অনেক সময় পরিকল্পনা করে তা কোনও নির্দিষ্ট খাতে রাখার সময়টুকুও দিচ্ছেন না কর্তারা। তখন বাধ্য হয়ে তড়িঘড়ি হিসাব মেলাতে বিবিধ খাতে টাকা খরচের হিসাব দেখাতে হচ্ছে। এটা অনিয়ম জেনেও করতে হচ্ছে। কারণ, কর্তার ইচ্ছাতেই কর্ম।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE