নারদ কাণ্ড নিয়ে রাজ্য সরকারের পৃথক তদন্তের সিদ্ধান্তকে বিশেষ আমলই দিতে চাইল না কলকাতা হাইকোর্ট। বরং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের যে সিদ্ধান্তকে ঘিরে গত ৭২ ঘণ্টা ধরে রাজনীতির পারা চড়ছে, সে ব্যাপারে হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুর সোমবার বলে দিলেন, ‘‘কে কী করছে বা বলছে, তা বড় কথা নয়। এ নিয়ে আদালত যা রায় দেবে, সেটাই শেষ কথা। কারও আপত্তি থাকলে আদালতের রাস্তা খোলা রয়েছে।’’
নারদ স্টিং অপারেশনটি ফাঁস হওয়ার পর পরই এ ব্যাপারে কলকাতা হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা দায়ের হয়েছিল। প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুরের ডিভিশন বেঞ্চে তার শুনানি চলছে। সোমবার ওই মামলার শুনানি প্রসঙ্গেই এই মন্তব্য করেন প্রধান বিচারপতি। ডিভিশন বেঞ্চের পরবর্তী শুনানি হবে আগামী শুক্রবার। সন্দেহ নেই, নারদ-তদন্ত সম্পর্কে প্রধান বিচারপতি এ দিন যে মন্তব্য করেছেন, তাতে পরবর্তী শুনানি নিয়ে কৌতূহল ও আগ্রহ আরও বাড়ল। অনেকের মতে, বিষয়টি নিয়ে স্নায়ুর চাপ বাড়ল সরকারের ওপর, বিপরীতে বিরোধী শিবিরে দৃশ্যত উৎসাহের ছবি।
নারদ কাণ্ডের ভিডিও ফুটেজ ফরেন্সিক পরীক্ষার জন্য ইতিমধ্যেই হায়দরাবাদে পাঠিয়ে দিয়েছে প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ। গরমের ছুটির পর হাইকোর্টের কাজ শুরু হলে মামলাটি ১০ জুন শুনানির তালিকায় ছিল। কিন্তু সে দিন প্রধান বিচারপতি আদালতে না থাকায় শুনানি হয়নি। সাত দিন পরেও মামলাটি শুনানির তালিকায় না থাকায় ১৭ তারিখ প্রধান বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করেন আবেদনকারীদের আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য। প্রধান বিচারপতি ওই দিন তাঁকে আশ্বাস দেন, দু’-এক সপ্তাহের মধ্যে মামলাটি শুনানির জন্য উঠবে। কাকতালীয় ভাবে সে দিনই সন্ধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নবান্নে সাংবাদিক সম্মেলন করে জানিয়ে দেন, নারদ স্টিং অপারেশন নিয়ে রাজ্য সরকার পৃথক তদন্ত করবে। কলকাতার পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারের নেতৃত্বে তদন্ত টিম গঠিত হবে।
মুখ্যমন্ত্রী শুধু তদন্তের কথা জানিয়েই থেমে থাকেননি। গত শনিবার তৃণমূলের কর্মশালা থেকে নারদ কাণ্ডে অভিযুক্তদের কার্যত ক্লিনচিটও দেন। সেই সঙ্গে বুঝিয়ে দেন, রাজীব কুমার আসলে ঘুষকাণ্ডের তদন্ত করবেন না। ঘুষ দেওয়ার নেপথ্যে কী ষড়যন্ত্র ছিল, তারই তদন্ত হবে। এবং যেমন বলা তেমন কাজ। রবিবার নিউ মার্কেট থানায় নারদ নিউজের কর্তা ম্যাথু স্যামুয়েলের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন নারদ-কাণ্ডে অন্যতম অভিযুক্ত কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী রত্না চট্টোপাধ্যায়।
নারদের টুঁটি চেপে ধরতে তৃণমূলের এই খেলা ধরে ফেলতে বিরোধীদের অসুবিধা হয়নি। কিন্তু কৌতূহল তৈরি হয়েছিল, আদালত এ ব্যাপারে কী অবস্থান নেবে, তা নিয়ে। সোমবার তাই প্রধান বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করেন বিকাশবাবু। তিনি ডিভিশন বেঞ্চে জানান, মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে স্পষ্ট, রাজ্য সরকারের তদন্ত অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে হবে না। উল্টে নারদ নিউজ ও বিরোধী দলগুলিকে দায়ী করছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর আরও দাবি, ভিডিও ফুটেজটির ফরেন্সিক রিপোর্ট এসে গিয়েছে। এই অবস্থায় রাজ্য সরকার হঠাৎ করে তদন্তের নির্দেশ দিতে পারে কি? তাঁর মতে, এটি আদালত অবমাননার সামিল।
তখন প্রধান বিচারপতি জিপি (গভর্নমেন্ট প্লিডার) অভ্রতোষ মজুমদারের কাছে সরকারি তদন্তের ব্যাপারে জানতে চান। জিপি জানান, রাজ্য সরকার তাঁকে এখনও কিছু জানায়নি। তিনি জেনে আদালতে জানাবেন। বিকাশবাবু আশঙ্কা প্রকাশ করেন, পরবর্তী শুনানির আগেই যদি রাজ্যের তদন্ত কমিটি কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়, তখন কী হবে? তা শুনেই প্রধান বিচারপতি বলেন, কে কী করছে বড় কথা নয়!
প্রধান বিচারপতির এই মন্তব্যই বিরোধীদের স্বস্তি দিয়েছে। বিরোধী দলনেতা আব্দুুল মান্নান বলেন, ‘‘আমরা আদালতের উপর ভরসা রেখেছিলাম। প্রধান বিচারপতির মন্তব্যে প্রমাণিত হল, আমরা ঠিকই করেছিলাম। মুখ্যমন্ত্রী চেষ্টা করলেও মানুষকে বোকা বানাতে পারবেন না।’’ একই ভাবে বাম পরিষদীয় দলনেতা সুজন চক্রবর্তী ও বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষও প্রধান বিচারপতির মন্তব্যকে স্বাগত জানিয়েছেন।
তবে এ সবের মধ্যে একটা নতুন বিষয়ও উঠে এসেছে। তা হল, মেয়রের স্ত্রীর অভিযোগের ভিত্তিতে কলকাতা পুলিশ এ বার নারদ কর্তা ম্যাথু স্যামুয়েলকে জেরা করবে কিনা! সে জন্য আগাম কোনও আইনি ব্যবস্থা নেবেন কি ম্যাথু? তিনি কি হাইকোর্টের দ্বারস্থ হবেন? ম্যাথু বর্তমানে দুবাইতে। তবে ফোনে বলেন, ‘‘বিষয়টি এখন আদালতে বিচারাধীন। আমি দেশে ফিরে আমার আইনজীবীদের সঙ্গে পরামর্শ করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেব।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy