সিবিআই দফতরের পথে রজত মজুমদার।— নিজস্ব চিত্র।
সারদার টাকা কে বা কারা নিয়েছেন, এ নিয়ে আদালতে কেউই তাঁকে কোনও প্রশ্ন করেনি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা মুকুল রায়ের নামও ওঠেনি। কিন্তু তিনি নিজে থেকেই আগ বাড়িয়ে সারদার লেনদেনের সঙ্গে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তৃণমূলের সর্বভারতীয় সম্পাদক মুকুল রায়ের নামটা জড়িয়ে দিলেন।
তবে অতি কৌশলে।
বৃহস্পতিবার আলিপুর আদালতে দাঁড়িয়ে সিবিআইয়ের উদ্দেশে রাজ্য পুলিশের প্রাক্তন ডিজি এবং তৃণমূলের সহ-সভাপতি রজত মজুমদার বললেন, “সাত দিন কেন, সত্তর দিন হেফাজতে রাখুন। কিন্তু মমতা-মুকুলকে টাকা দিয়েছি, তা বলাতে পারবেন না।”
রজতের মুখে আচমকা এ কথা শুনে রীতিমতো অবাক হয়ে যান আদালতে হাজির আইনজীবীরা। রজত কেন নিজে থেকে এ কথা বলতে গেলেন, কেন মুখ্যমন্ত্রী এবং মুকুল রায়ের নাম নিতে গেলেন তাই নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়ে যায়। সিবিআই কর্তাদের একাংশের কিন্তু বক্তব্য, প্রাক্তন আইপিএস অফিসার আসলে তদন্তকারীদের শাসানোর ছলে সারদা কেলেঙ্কারির পর্দা উন্মোচনেরই অনেক বড় ইঙ্গিত দিয়েছেন! এখানে পরশুরামের গল্পের সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘না মানেই হ্যাঁ’-এর কৌশল নেওয়া হয়েছে বলে তাঁদের মত। সেই সঙ্গে আগের দিন তৃণমূল নেতাদের একাংশ যেমন রজত সক্রিয় ভাবে তৃণমূল করতেনই না বলে দাবি করছিলেন, তারও একটা ‘জবাব’ দেওয়া গেল।
মঙ্গলবার সারদা কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে রজতবাবুকে গ্রেফতার করেছিল সিবিআই। কিন্তু সেই রাতেই তিনি অসুস্থ বোধ করছেন বলে দাবি করায় তাঁকে নীলরতন সরকার হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। এ দিন হাসপাতাল তাঁকে ছুটি দেওয়ার পরে বেলা সাড়ে তিনটে নাগাদ আলিপুর আদালতে হাজির করানো হয় রজতবাবুকে। পরনে হাল্কা রঙের কাজ-করা পাঞ্জাবি, সাদা পায়জামা, হাওয়াই চটি। গালে কয়েক দিনের না-কামানো দাড়ি। এজলাসে হাজির হওয়ার আগে বাহ্যত শারীরিক অসুস্থতার লেশ না থাকলেও মানসিক ভাবে কিছুটা বিধ্বস্ত লাগছিল রাজ্য পুলিশের প্রাক্তন ডিজি-কে। সেই তিনি-ই যে আদালতে এমন নাটকীয় বক্তব্য রাখবেন, তা তখন অনেকেই ভাবতে পারেননি।
এ দিন আদালতের মধ্যে আগ বাড়িয়ে মোট দু’বার মমতা-মুকুলের নাম করেন রজতবাবু।
আলিপুরের অতিরিক্ত মুখ্য বিচারবিভাগীয় বিচারকের এজলাসে সারদার অন্য একটি মামলার শুনানিতে এ দিন সারদা কর্তা সুদীপ্ত সেনকে হাজির করানো হয়েছিল। সেই শুনানি চলার সময় কাঠগড়ার এক পাশে দাঁড়িয়েছিলেন রজতবাবু। সেখান থেকেই তিনি হঠাৎ সুদীপ্তকে ধমকে বলেন, “তুমি সিবিআইকে বলেছ, আমি নির্বাচনের আগে তোমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে গিয়ে মমতা-মুকুলকে দিয়েছি? চালাকি হচ্ছে?”
এই ঘটনাটাই নাটকীয় মোড় নেয় রজতবাবুর বিরুদ্ধে মামলায় সিবিআইয়ের আইনজীবী পার্থ দত্তের সওয়ালের পর। পার্থবাবু আদালতে জানান, সারদা আর্থিক কেলেঙ্কারির সঙ্গে রজতবাবুর যোগ পাওয়া গিয়েছে। প্রচুর টাকা তছরুপ হয়েছে। রজতবাবুকে আরও জেরার প্রয়োজন রয়েছে। সেই কারণেই সিবিআইয়ের তরফে রজতবাবুকে সাত দিনের জন্য হেফাজতের নেওয়ার আবেদন করা হচ্ছে। অন্য দিকে রজতবাবুর আইনজীবী সঞ্জয় বসু দাবি করেন, সিবিআই যে ভাবে ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব খাড়া করছে, তার কোনও ভিত্তি নেই।
এর পরেই বিচারকের কাছে আত্মপক্ষ সমর্থনে কিছু বলতে চান রজতবাবু। অনুমতি মিলতেই তিনি বলতে শুরু করেন, সিবিআই তাঁকে নোটিস দিয়ে ডাকেনি। অগস্টে তাঁর বাড়ি তল্লাশির সময় তাঁকে জেরা করা হয়। ফের সিবিআই অফিসেও জেরা করা হয়। প্রাক্তন পুলিশকর্তার দাবি, সিবিআইকে তিনি সব নথি দিয়েছেন। আমেরিকায় প্রবাসী বাঙালিদের সম্মেলন বাবদ ১ কোটি ৭৫ লক্ষ টাকা দিয়েছিল সারদা। পরে আরও তিন কোটি টাকার চুক্তি হয়েছিল। কিন্তু সেই চুক্তি বাতিল হয়ে গিয়েছিল।
এর পরেই আবার স্বতোঃপ্রণোদিত হয়ে মমতা-মুকুল প্রসঙ্গ তোলেন রজতবাবু। তিনি আদালতে বলেন মঙ্গলবার মুখোমুখি জেরার সময় কুণাল দাবি করেছিলেন, ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে সুদীপ্ত সেনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে মমতা-মুকুলকে দিয়েছেন রজতবাবু। রজতবাবুর দাবি, তিনি এর প্রতিবাদ করলে তদন্তকারীরা মধ্যাহ্নভোজের বিরতিতে যান। তার পরে তাঁকে বসিয়ে রেখে বিকেলে গ্রেফতার করা হয়।
এ দিন এ কথা আদালতে বলার পরেই কিছুটা উত্তেজিত হয়ে পড়েন রজতবাবু। এজলাসে দাঁড়ানো সিবিআই অফিসারদের উদ্দেশে হাত নেড়ে বলতে থাকেন, “আপনারা রাজনীতি করছেন। আমাকে রাজনীতির জন্যই গ্রেফতার করেছেন। সাত দিন কেন, সত্তর দিন হেফাজত নিন। কিন্তু আমার মুখ থেকে মমতা-মুকুলকে টাকা দিয়েছি, তা বলাতে পারবেন না। মারুন, মানসিক চাপ দিন কোনও মতেই আমি তা বলব না।” তার পর আরও জোর গলায় বলেন, “খুব বেশি হলে বলতে পারি, হ্যাঁ আমি মমতা-মুকুলকে চিনি। এর বেশি কিছুই নয়।”
এজলাসে এমন উত্তেজনা দেখে অনেকেই বিস্মিত হয়েছেন। সিবিআই অফিসারেরা কিন্তু মুচকি হাসছেন। তাঁদেরই এক জনের ইঙ্গিত, তদন্তে উনি-ই হবেন অন্যতম সাহায্যকারী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy