জাল পরিচয়পত্র তৈরি করে আধাসামরিক বাহিনীতে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার পিছনে রাজ্য জুড়ে প্রশাসনিক কর্মী এবং জনপ্রতিনিধিদের একাংশের হাত রয়েছে বলে সিবিআইয়ের তদন্তে উঠে এসেছে। বৃহস্পতিবার মহেশ কুমার চৌধুরী নামে আধাসামরিক বাহিনীর এক সেপাইকে কাঁকিনাড়ায় গ্রেফতার করা হয়। সেই সূত্রেই বিষয়টি উঠে এসেছে। মহেশকে আলিপুর সিবিআই আদালতের বিচারক পাঁচ দিনের জন্য সিবিআই হেফাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
সিবিআইয়ের তদন্তকারীদের সূত্রে দাবি, মহেশের বিরুদ্ধে শংসাপত্র জালিয়াতি এবং আধা সামরিক বাহিনীতে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে কোটি কোটি টাকা সরানোর অভিযোগ উঠেছে। আধাসামরিক বাহিনীতে জাল নথির মাধ্যমে বহু বিদেশি নাগরিক এবং এ রাজ্যের বাসিন্দাদের চাকরির ব্যবস্থা করা হয়েছে, ২০২৩ সালে কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশে এই অভিযোগের তদন্ত শুরু করে সিবিআই। তবে তদন্তকারীদের দাবি, মহেশ ওই চক্রের এক জন ‘মিড্লম্যান’ এবং চক্রের মাথারা যথেষ্ট প্রভাবশালী।
তদন্তকারীদের কথায়, গত দেড় বছরে নানা জায়গায় তল্লাশি অভিযান চালিয়ে জাল শংসাপত্র (প্রধানত ডোমিসাইল সার্টিফিকেট বা স্থানীয় বাসিন্দার পরিচয়পত্র) তৈরি এবং তা চাকরির ক্ষেত্রে ব্যবহারের নানা সূত্র মিলেছে। এর পরেই উত্তর ২৪ পরগনার কাঁকিনাড়ার আধা সামরিক বাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের সেপাই মহেশকে গ্রেফতার করা হয়। উত্তর ২৪ পরগনার খড়দা, জগদ্দল-সহ বেশ কয়েকটি এলাকার কিছু বাসিন্দাকে জাল নথি তৈরি ও আধাসামরিক বাহিনীতে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মহেশ কয়েক কোটি টাকা তুলেছিলেন বলে তদন্তকারীদের সূত্রের দাবি। আপাতত তাঁর কয়েকটি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে দেড় কোটি টাকার হদিস মিলেছে বলে আদালতে দাবি করেছে সিবিআই।
তদন্তকারীদের সূত্রে দাবি, বিভিন্ন জেলায় মহকুমা শাসকের দফতর থেকে ডোমিসাইল শংসাপত্রের ছাড়পত্র দেওয়া হয়। মহকুমা শাসকের দফতরে ওই শংসাপত্রের আবেদনের ভিত্তিতে তা বিডিও-র দফতরে পাঠানো হয়। বিডিওর তরফে অবেদনকারীর নাগরিকত্বের তথ্য যাচাই করা হয়। আধার কার্ড, ভোটার কার্ড এবং পারিবারিক জমির দলিল যাচাই করার পরে বিডিওর তরফে মহকুমা শাসকের দফতরে আবেদনকারীকে শংসাপত্র দেওয়ার সুপারিশ করা হয়।
তদন্তকারীদের দাবি, ডোমিসাইল শংসাপত্র পেতে ভোটার কার্ড, আধার কার্ড এবং বাসস্থানের নথির পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি অর্থাৎ পঞ্চায়েত প্রধান, বিধায়ক বা পুরসভার চেয়ারম্যানের শংসাপত্র লাগে। মূলত জনপ্রতিনিধিদের শংসাপত্রের ভিত্তিতেই বিডিও অফিসের তরফে আবেদনকারীর সব নথি যাচাই করা হয়ে থাকে। তদন্তকারীদের একাংশের দাবি, ভুয়ো শংসাপত্রের পিছনে জেলা প্রশাসনের কর্তা, নিচুতলার কর্মী থেকে রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধিরা সবাই জড়িয়ে। জাল নথির মাধ্যমে সরকারি স্কুল, কলেজ এবং বিভিন্ন সরকারি দফতরে বিদেশি নাগরিকদের চাকরি পাইয়ে দেওয়ার ঢালাও কারবার চলছে বলে দাবি। সিবিআইয়ের এক কর্তা বলেন, “শিক্ষা, রেশন, কয়লা, গরু পাচারের মতো ভুয়ো নাগরিকত্বের পরিচয় নিয়ে কেলেঙ্কারির শিকড়ও যথেষ্ট গভীরে বলে মনে হচ্ছে।” ওই কর্তার দাবি, ২০১৫ সালের পর থেকে ধীরে ধীরে জেলা প্রশাসনের দফতরে সংগঠিত ভাবে জাল শংসাপত্র তৈরির চক্র গড়ে ওঠার আভাস মিলেছে। তাঁর বক্তব্য, তাতে নেতা, মন্ত্রী এবং আমলাদের ভূমিকাও সন্দেহজনক।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)