শুরুর আগে ছিল প্রাণ থাকতে হতে না-দেওয়ার হুঙ্কার। কিন্তু রাজ্যে ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধনের (এসআইআর) প্রথম পর্ব শেষের মুখে দাঁড়িয়ে প্রত্যয় বাড়ছে মমতা বন্দ্যোপাধায়ের। যে এসআইআর-কে বিজেপির ‘যড়যন্ত্র’ বলেই বহু বার তোপ দেগে এসেছেন মুখ্যমন্ত্রী, এখন সেই প্রক্রিয়াতেই ‘বিজেপির কবর’ খোঁড়া হচ্ছে বলে মনে করছেন তিনি!
ভোটারদের জন্য এসআইআর-এর গণনা-পত্র জমা দেওয়ার সময় আরও এক সপ্তাহ বাড়িয়ে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। তবে রাজ্যে গণনা-পত্র পূরণের কাজ এখনই প্রায় শেষের পথে। তৃণমূল কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ রিপোর্টও বলছে, উত্তর ও দক্ষিণ কলকাতা বাদে প্রায় সব সাংগঠনিক জেলাতেই ফর্ম পূরণের হার বিপুল। বিশেষত, সংখ্যালঘু-অধ্যুষিত বেশির ভাগ এলাকায় সেই হার ৯৫%-এর বেশি। এই তথ্য হাতে নিয়েই মালদহ ও মুর্শিদাবাদ সফরে এসেছেন মুখ্যমন্ত্রী। মালদহের গাজলে বুধবার দলের ভোট-রক্ষা সমাবেশ থেকে তৃণমূল নেত্রী বলেছেন, ‘‘ভোট চাইতে আসিনি। আমি শুধু ভোটের সময়ে রাজনীতি করি না। আপনাদের দুশ্চিন্তার কথা স্মরণ করে পাশে দাঁড়ানোর জন্য এসেছি। পরিষ্কার বলছি, নিশ্চিন্তে থাকুন। ভয় পাবেন না!’’ একই সঙ্গে তাঁর ঘোষণা, ‘‘এসআইআর করে নিজেদের কবর খুঁড়েছে বিজেপি! মানুষ তোমাদের সমর্থন করছে না। বিহার দখল করেছো, বাংলা পারবে না। ইংরেজরা পারেনি, তোমরা কোন ছার!’’
পশ্চিমবঙ্গে এসআইআর প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগে থেকে কত নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ যাবে এবং শাসক দলের কত বড় বিপদ হবে, সেই সংক্রান্ত নানা দাবি করে এসেছেন বিজেপি নেতারা। কিন্তু গণনা-পত্র পূরণের ছবি দেখে অন্তত শাসক শিবিরে স্বস্তির পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এক দিকে সংখ্যালঘু এলাকায় যেমন গণ-হারে ফর্ম পূরণ হয়েছে, তেমনই বিজেপির ভোট-ব্যাঙ্ক মতুয়াদের একাংশের মধ্যে ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়ার আশঙ্কা বাড়ছে। রাজনৈতিক শিবিরের একাংশের ব্যাখ্যা, এই পরিস্থিতিতেই খেলা ঘুরিয়ে দেওয়ার আশা দেখছেন মমতা।
তবে আপাতত স্বস্তির হাওয়া থাকলেও এসআইআর-এর পরবর্তী পর্বের জন্য সরকার ও দলকে তৎপর রাখছেন মুখ্যমন্ত্রী। দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যে দিন রাজ্যের বিজেপি সাংসদদের সঙ্গে আলোচনায় এসআইআর-এর প্রয়োজনীয়তা ও নিজেদের এলাকায় জনসংযোগ বাড়ানোর কথা বলছেন, সে দিনই বিজেপির দখলে থাকা মালদহ উত্তর লোকসভা এলাকায় দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করে দিয়েছেন, গণনা-পত্র জমা শেষ হলেই আগামী ১২ ডিসেম্বর থেকে ব্লকে ব্লকে সরকারি স্তরে সহায়তা শিবির (মমতার কথায়, ‘মে আই হেল্প ইউ ক্যাম্প) চালু হবে। শুনানিতে কাজে লাগার মতো নথির বন্দোবস্ত করতে ভোটারদের সাহায্য করবেন সরকারি আধিকারিকেরা। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘এর পরে শুনানি হবে। যাঁর যা (নথি) লাগবে, করিয়ে নেবেন। তৃণমূলের কর্মীদের বলছি, নির্বাচনে যেমন বুথ শিবির করি, সেই ভাবে মানুষকে সাহায্য করতে হবে। নেতাদের বলছি, যারা কাজ করছে, দরকারে বাড়ি থেকে একটু চা-খাবার দিয়ে তাদের সাহায্য করবেন।’’
এসআইআর চাপিয়ে দেওয়ার জন্য বিজেপিকে নিশানা করতেও ছাড়েননি মমতা। বলেছেন, আগে করেছে নোটবন্দি। এখন এসআইআরের নামে করছে গণ-বন্দি! ভোটবন্দি হচ্ছে। বাংলায় ৩৯ জনের মৃত্যু হয়েছে, ১৩ জন হাসপাতালে, তিন জন আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। আর কত প্রাণ যাবে?’’ তাঁর আরও প্রশ্ন, ‘‘কী দরকার ছিল? উন্নয়নের কাজ বন্ধ করে ৬ মাস আগে থেকে রাজ্য সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য? চুলকে ঘা করছো!’’
মুখ্যমন্ত্রী ৩৯ জনের মত্যুর কথা বলার পরে ফের অভিযোগ এসেছে, এসআইআর-আতঙ্কে কোচবিহারের তুফানগঞ্জের হাচনা বিবি (৫৫) মঙ্গলবার গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। পরিবারের দাবি, আধার কার্ডে নাম ছিল হাচনা বিবি এবং ভোটার কার্ডে নাম ছিল হাচনা রিবি। চিন্তায় ছিলেন প্রৌঢ়া। ঘটনাটি নিয়ে বুধবার হইচই শুরু হয়েছে। এসডিপি ও (তুফানগঞ্জ) কান্নেধারা মনোজ কুমার বলেছেন, ‘‘তদন্ত শুরু হয়েছে।’’
বিভিন্ন রাজ্যে বাংলাভাষী মানুষের হেনস্থার জন্য বিজেপিকে জবাবদিহি করতে হবে ফের সুর চড়িয়েছেন মমতা। পাশাপাশিই বলেছেন, ‘‘যে নাগরিক, তাকে প্রমাণ দিতে হচ্ছে আবার যে, সে নাগরিক! বাংলায় কাউকে ডিটেনশন ক্যাম্পে যেতে হবে না, কাউকে পুশব্যাক করা হবে না। আপনারা দেশের নাগরিক,বাংলার ভোটার। আমি পাহারাদার!’’
ভোট মরসুমে বঙ্গ বিজেপির প্রধান ‘চাণক্য’ হয়ে যিনি আসবেন, সেই অমিত শাহকেও ফের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে রেখেছেন তৃণমূল নেত্রী। তাঁর মন্তব্য, ‘‘ভোট আছে বলে তিন মাস আগে অমিত শাহ এটা (এসআইআর) করছেন। ভেবেছেন, এসআইআর না-মানলে সরকার ভেঙে দাও! তা না-হলে নাম বাদ দাও। কিন্তু চালাকি দ্বারা কোনও মহৎ কাজ হয় না।’’ মমতার সংযোজন, ‘‘আমরা রুখে দেব, অধিকার আদায় করব। বাংলাকে দমানো যায় না হ্যাংলার দল! ’’
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)