Advertisement
E-Paper

সমবায়ের মন্ত্রে বদলাচ্ছে মেয়েদের জীবন

এক সময়ে যে হাতদুটো জল ঘেঁটে মীন ধরত ভোররাতে, সেই হাতেই আজ কমপিউটারের মাউস। চরম দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করে সে দিনের দরিদ্র গৃহবধূ আজ সুন্দরবন মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠী কো-অপারেটিভ সোসাইটির সভাপতি। দেবীরানি জানা কেবল নিজের জীবনকেই সার্থক করে তোলেননি, তাঁর মতো বহু মেয়েদের জীবন গড়ার পথ তৈরি করে দিচ্ছেন।

অমিত কর মহাপাত্র

শেষ আপডেট: ২৭ মে ২০১৫ ০৩:২৪
কাজ চলছে সুন্দরবন মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠী কো-অপারেটিভ সোসাইটি। নন্দকুমারপুরে তোলা নিজস্ব চিত্র।

কাজ চলছে সুন্দরবন মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠী কো-অপারেটিভ সোসাইটি। নন্দকুমারপুরে তোলা নিজস্ব চিত্র।

এক সময়ে যে হাতদুটো জল ঘেঁটে মীন ধরত ভোররাতে, সেই হাতেই আজ কমপিউটারের মাউস। চরম দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করে সে দিনের দরিদ্র গৃহবধূ আজ সুন্দরবন মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠী কো-অপারেটিভ সোসাইটির সভাপতি। দেবীরানি জানা কেবল নিজের জীবনকেই সার্থক করে তোলেননি, তাঁর মতো বহু মেয়েদের জীবন গড়ার পথ তৈরি করে দিচ্ছেন।

কাজটা সহজ ছিল না। সে সব দিনের কথা বলতে গেলে আজও চোখ জলে ভরে আসে বছর চুয়ান্নর দেবীরানির। রাতে মীন ধরা আর দিনে বাড়ি বাড়ি দুধ সংগ্রহ। ‘‘পেটে দানা ছিল না, গায়ে কাপড় ছিল না। অন্নপ্রাশনের আগের দিন অপুষ্টিতে মারা গেল ছেলেটা। পরের দুই মেয়ে প্রাণে বাঁচল স্বাস্থ্য-শিক্ষাহীন হয়ে।’’

জীবনের মোড় ঘুরল ১৯৯৬ সালে। সেই সময় স্থানীয় সংস্থা ‘সবুজ সংঘ’ গ্রামে গ্রামে নানা স্বনির্ভর গোষ্ঠী তৈরি করে মহিলাদের সঞ্চয় ও ঋণের সুযোগ করে দেয়। গোষ্ঠীতে যুক্ত হয়ে ঋণ নিয়ে ভাগ চাষ করে ধীরে ধীরে জমি কিনেছেন,বাড়ি করেছেন, মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। অশক্ত স্বামীকে করে দিয়েছেন ছোট কাপড়ের দোকান।

এ ভাবে বহু মেয়ের জীবন বদলে দিয়েছে স্বনির্ভর গোষ্ঠী। মহবতনগরের গঙ্গা প্রামাণিকের বিয়ে হয় দরিদ্র পরিবারে। দশ বছর আগে গোষ্ঠীতে যুক্ত হয়ে ঋণ নিয়ে খাবারের দোকান খোলেন। সেই দোকান থেকে এখন মাসে আয় ১০ হাজার টাকা।

নগেন্দ্রপুর গ্রামের ষাটোর্ধ্বা শেফালি দোলাই বলেন, “আমাদের একটা তিন বিঘার খাল ছিল। সংস্কার না হওয়ায় মাছ হচ্ছিল না। ২০০৩ সালে গোষ্ঠীর মাধ্যমে ১০ হাজার টাকা ঋণ পাই। সেই টাকায় খাল সংস্কার করে মাছ চাষ শুরু করার পর জীবন বদলে গেল। ওই খাল এ বছর তিন লক্ষ টাকায় লিজ দিয়েছি।” শেফালি এখন গোষ্ঠীর দলনেত্রী।

এই মেয়েরা যেমন ধীরে ধীরে রোজগার বাড়িয়েছেন, তেমন বেড়েছে তাঁদের গোষ্ঠীগুলিও। মেয়েদের ছোট ব্যবসা শুরুর জন্য ঋণ দেওয়ার কাজ অনেকে করেন। সবুজ সংঘের বিশেষত্ব ছিল, চিকিত্সা, পড়াশোনা, বিয়ে, বাড়ি তৈরির মতো প্রয়োজনেও ঋণ দেওয়া। কয়েক বছরের মধ্যেই ছ’শো গোষ্ঠীর সদস্য সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। ২০০৯ সালে সঞ্চয় দাঁড়ায় প্রায় এক কোটি টাকা। ঋণ ছিল সঞ্চয়ের থেকে তিরিশ লক্ষ টাকা বেশি। সেই সময় আয়কর কর্তারা পরামর্শ দেন সমবায় সমিতি গড়ে তোলার। অনেক বাধা আসে স্থানীয় কিছু কৃষি সমবায় সমিতি থেকে। অনেক টালবাহানার পর গত নভেম্বরে রাজ্য সমবায় দফতরের অনুমোদন পেয়েছে সুন্দরবন মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠী কো-অপারেটিভ সোসাইটি। মথুরাপুর ২ ব্লকের নন্দকুমারপুরে দু’টি ঘর ভাড়া নিয়ে চলছে সমিতির কাজ।

সমিতিতে সামিল ৪১টি গোষ্ঠীর ৪৫৩ জন মহিলা। স্থায়ী আমানত ৫৭ হাজার টাকা, গত চার মাসে লেনদেন হয়েছে দু’লক্ষ টাকার কিছু বেশি। সমবায় সমিতি হিসাবে অনুমোদন পাওয়ার জন্য প্রাথমিক ভাবে ৩০টি গোষ্ঠীর কাছ থেকে শেয়ার হিসাবে দু’হাজার টাকা করে নেওয়া হয়েছে।

কেন এই সমিতি গড়ার উদ্যোগ? সমিতির ফিল্ড অফিসার রিনা মান্না, হিসাব রক্ষক কাকলি দাসের বক্তব্য, এখনও পর্যন্ত এই দ্বীপাঞ্চলগুলিতে ব্যাঙ্কিং পরিষেবার সুযোগ নিতান্তই কম। সেই ব্যাঙ্কগুলিও গুরুত্ব দেয় না মেয়েদের এই সব গোষ্ঠীকে। সামান্য পড়াশোনা, দূরত্ব, সময় নষ্টের জন্য মেয়েরাও ব্যাঙ্কে যেতে চান না। ফলে ঘরে কিছু টাকা জমলেও নানাভাবে তার অপব্যয় হত। নিয়মিত সঞ্চয়ের অভ্যাস গড়ে তোলার পাশাপাশি, ঋণ পাওয়ার সুযোগ দেবে এই সমিতি। কেউ নিজে রোজগার করতে চাইলে সহায়তাও মিলবে।

দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সমবায় দফতরের সহ নিবন্ধক দীপক হালদার বলেন, “প্রান্তিক মহিলাদের জন্য জেলায় এই ধরনের পদক্ষেপ প্রথম। এমন সমিতি গড়ে তুলতে চায় সমবায় দফতর।” দফতর সূত্রে বলা হচ্ছে, বেশ কিছু কৃষি সমবায় সমিতিতে নামমাত্র কয়েকটি মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠী যুক্ত থাকলেও, তারা কখনও নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা নিতে পারে না। আর নিজেরা সমিতি গড়লে সুবিধে মেলে অনেক বেশি। রোজগারের জন্য সমিতি গড়লেও, কয়েকশো মহিলা এ ভাবে সংগঠিত থাকায় মহিলাদের উপর সামাজিক ও অর্থনৈতিক অন্যায় অবিচার প্রতিরোধ করাতেও ভূমিকা নিতে পারে এই সমিতি।

Amit Kar Mahapatra money Co operative sunderban bank
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy