Advertisement
০৫ অক্টোবর ২০২৪
CPM CPI INDIA

‘নদী-পুকুর’ গুলিয়ে ফেলা ভুল! সিপিআইয়ের খোঁচায় সিপিএম, কাস্তে-হাতুড়ির পাশে কোদাল-বেলচা

সিপিআই সমালোচনা করলেও আরএসপি খোলাখুলি সিপিএমের পাশে দাঁড়িয়েছে। দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মনোজ ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘সিপিএম সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ওই কমিটির তেমন কোনও কাজ নেই।’’

CPM CPI INDIA

( বাঁ দিক থেকে) সিপিএম, সিপিআই এবং আরএসপির নির্বাচনী প্রতীক। —ফাইল চিত্র।

শোভন চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৯:৫২
Share: Save:

বিজেপি বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’কে কেন্দ্র করে বাংলার ৩৪ বছরের শাসক জোট বামফ্রন্টের মধ্যে অনৈক্য স্পষ্ট হয়ে উঠল। সিপিএম ‘ইন্ডিয়া’য় থাকলেও সমন্বয় কমিটি জাতীয় কোনও ‘সাংগঠনিক কাঠামো’য় থাকবে না। রবিবার এটি স্পষ্ট করে দিয়েছে সিপিএম পলিটব্যুরো। ওই কমিটির যৌক্তিকতা নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিয়েছে সিপিএম। সিপিএমের এই সিদ্ধান্তকে সর্বভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গির নিরিখে একেবারেই ভাল ভাবে নিচ্ছে না সিপিআই। বামফ্রন্টের আর এক শরিক আরএসপি অবশ্য এ ব্যাপারে সিপিএমের পাশেই দাঁড়াচ্ছে।

গত ৩১ অগস্ট এবং ১ সেপ্টেম্বর ‘ইন্ডিয়া’র শেষ পূর্ণাঙ্গ বৈঠক হয় মুম্বইয়ে। ওই বৈঠকেই গঠিত হয় ১৩ জনের সমন্বয় কমিটি। সিপিআই সাধারণ সম্পাদক ডি রাজা কমিটির অন্যতম সদস্য। কমিটিতে রয়েছেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও। বৈঠক শেষে জানানো হয়, সমন্বয় কমিটি হবে ১৪ জনের। সিপিএম পরে তাদের প্রতিনিধির নাম জানিয়ে দেবে। সিপিএম তখন এই ঘোষণা নিয়ে কোনও আপত্তিও তোলেনি। কিন্তু গত শনি এবং রবিবারের বৈঠকে সিপিএম পলিটব্যুরো সিদ্ধান্ত নেয়, কমিটিতে তারা যোগ দেবে না।

সিপিএমের এই সিদ্ধান্তকে বিরোধীদের সর্বভারতীয় জোট প্রক্রিয়ার পক্ষে স্বাস্থ্যকর বলে মনে করছে না সিপিআই। সিপিআইয়ের রাজ্য সম্পাদক তথা কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায় আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেন, ‘‘বাস্তবতার ভিত্তিতে সিপিএম হয়তো মনে করছে যে, কমিটিতে গেলে জনগণের কাছে খারাপ বার্তা যাবে। কিন্তু আমাদের কাছে সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটটাই গুরুত্বপূর্ণ। বিজেপিকে কেন্দ্রের ক্ষমতা থেকে সরানোটাই সবচেয়ে অগ্রাধিকারের বিষয়।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘আমাদের কেউ কেউ দেশ আর রাজ্য গুলিয়ে ফেলছে। সেটা খুব একটা স্বাস্থ্যকর নয়।’’

তবে আর এক ফ্রন্ট শরিক আরএসপি খোলাখুলি সিপিএমের পাশে দাঁড়াচ্ছে। দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মনোজ ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘সিপিএম সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ওই কমিটির তেমন কোনও কাজ নেই। সেখানে থাকা অর্থহীন।’’

সিপিআইয়ের জোট ভাবনার সঙ্গে কংগ্রেসের জোট ভাবনার মিল পাচ্ছেন অনেকেই। কিছু দিন আগেই প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী দেশ ও রাজ্যের প্রেক্ষাপটকে নদী ও পুকুরের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। বাংলায় তৃণমূলের তীব্র বিরোধী হিসাবে পরিচিত অধীর গত অগস্টে তৃণমূলের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে কথা বলতে গিয়ে একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘‘পুকুর এবং নদীর মধ্যে ফারাক আছে। আমার কাছে বাংলা হল পুকুর। আর ভারত হল নদী। আমি যেটা বলতে চাই, সেটাই বলি। পিছন থেকে কথা বলি না। আমাদের এখন পুকুরের কথা ছেড়ে বেশি করে নদীর কথা ভাবতে হবে।” যদিও পরে অধীর এ-ও বলেছেন, বাংলায় তৃণমূল ও বিজেপি উভয়ের বিরুদ্ধে তাঁদের লড়াই চলবে। অনেকের মতে, সিপিআইয়ের সঙ্গে কংগ্রেসের সুর এ ক্ষেত্রে মিলে যাচ্ছে।

সিপিআই ভেঙে সিপিএম তৈরিj সময় থেকেই কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে দু’দলের অবস্থানগত ফারাক বার বারই প্রকট হয়েছে। ফারাক প্রকট থেকেছে কেন্দ্রের সরকারে যোগ দেওয়া থেকে শুরু করে সর্বভারতীয় রাজনীতির নানা প্রশ্নে। ১৯৭১ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস ও সিপিআইয়ের ঐক্যকে কটাক্ষ করতে গিয়ে সিপিএম দেওয়ালে লিখত, ‘দিল্লি থেকে এল গাই, সঙ্গে বাছুর সিপিআই।’ আবার ১৯৯৬ সালে কেন্দ্রে মন্ত্রিসভায় সিপিআই মন্ত্রিত্ব নিয়েছিল। বাংলার ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছিলেন। অনেকের মতে, এ বারও সিপিআই বোঝাতে চাইল, সিপিএম নদী ছেড়ে পুকুরের কথা ভাবছে। তবে, অতীতে এই রাজ্যে কংগ্রেসের ব্যাপারে সিপিএমের যে কট্টর বিরোধিতার লাইন ছিল, তা আর নেই। এখন বাংলার কংগ্রেসকে মানসিক ভাবে অনেক সিপিএম নেতা ‘বামফ্রন্ট শরিক’ হিসাবেই দেখেন, দেখাতে চানও।

সর্বভারতীয় মঞ্চের কমিটি ইত্যাদি নিয়ে সিপিএম-সিপিআই ফারাক থাকলেও, বাংলায় তৃণমূলের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে এই মুহূর্তে দু’দলের এক সুর। সিপিএম পলিটব্যুরো বলেছে, তারা চায় ‘ইন্ডিয়া’ শক্তিশালী হোক। তারা এ-ও চায়, রাজ্যে রাজ্যে জনসমাবেশ করে ‘ইন্ডিয়া’ মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করুক। কিন্তু বাংলায় এমন সমাবেশে তৃণমূলের সঙ্গে এক মঞ্চে যাওয়ার যে প্রশ্নই নেই, তা পরিষ্কার। একই অবস্থানে সিপিআই-ও। দলের রাজ্য সম্পাদক স্বপন বলেন, ‘‘বাংলায় তৃণমূলের সঙ্গে মঞ্চ ভাগাভাগির কোনও অবকাশ নেই।’’

সর্বভারতীয় মঞ্চ নিয়ে সিপিএম-সিপিআই দুই আলাদা অবস্থান প্রসঙ্গে আরও একটি ব্যাখ্যা দিচ্ছেন সিপিএম নেতারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রাজ্য কমিটি নেতার কথায়, ‘‘সীতারাম ইয়েচুরির সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি একসঙ্গে বেরোলে আমাদের নীচতলায় যে প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়, সেই সমস্যা ওদের অতটা নেই। এখনও এই রাজ্যে আমাদের দু’লক্ষের বেশি পার্টি সদস্য। তার বাইরেও একটা বিরাট সংখ্যক কর্মী-সমর্থক রয়েছেন। তাঁদের প্রতি দিন লড়াই করতে হচ্ছে তৃণমূলের অত্যাচারের বিরুদ্ধে। আমাদের দায়টা অনেক বেশি।’’ এটা ঘটনা যে, মমতা-ইয়েচুরির পাশাপাশি ছবি নিয়ে বঙ্গ সিপিএমের নিচুতলায় যে ক্ষোভের উদ্গিরণ হয়েছিল, তা সামলাতে রাজ্য সিপিএমকে বিশেষ কর্মসূচি হিসাবে ‘পাঠচক্র’ করতে হয়েছিল শাখায় শাখায়। যেখানে বিবিধ প্রশ্নবাণে জর্জরিত হতে হয়েছিল নেতাদের। ‘ইন্ডিয়া’র সমন্বয় কমিটিতে তৃণমূলের প্রতিনিধি হিসাবে অভিষেক থাকায়, সেখানে গেলে নতুন করে ক্ষোভের আগুনে ঘি পড়তে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে বাংলার নেতাদের। অন্য দিকে কেরল সিপিএমও চায়নি কংগ্রেসের সঙ্গে বেশি ‘মাখামাখি’ করুক দল। ফলে সাঁড়াশি চাপে পড়তে হয় সিপিএম পলিটব্যুরোকে। সে সব বিবেচনার পরেই একটা অবস্থান নিয়েছে সিপিএম। জোটে থাকলেও, ‘সাংগঠনিক কমিটি’তে নয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE