ছিল ‘বাঙালি’। বদলে হয়েছিল ‘বাংলা’। আবার তা বদলে হল ‘বাঙালি’। অর্থাৎ, ‘বাংলা’ ফিরে এল ‘বাঙালি’তে।
রাজ্য সরকার ২০২৩ সালে বিধানসভায় প্রস্তাব পাশ করিয়ে জোড়া সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এক, পয়লা বৈশাখকে ‘রাজ্য দিবস’ হিসাবে পালন করা হবে। এবং দুই, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ গানটি হবে পশ্চিমবঙ্গের ‘রাজ্য সঙ্গীত’। কিন্তু সে বছরের ডিসেম্বরে রাজ্য সঙ্গীতের কথা বদল নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়। সেই বিতর্কের নিরসন হয়েছে। সোমবার রাজ্যের মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ নির্দেশিকা জারি করে জানিয়ে দিয়েছেন, রাজ্য সঙ্গীত হিসাবে রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল’ গানটির কোন স্তবকটি গাওয়া হবে। কত সময়ের মধ্যে সেটি গাওয়া সম্পূর্ণ করতে হবে। এ-ও বলা হয়েছে যে, রাজ্য সঙ্গীত চলাকালীন উঠে দাঁড়ালে ভাল।
রাজ্য সঙ্গীত সম্পূর্ণ করার জন্য এক মিনিট সময় বেঁধে দিয়ে মুখ্যসচিবের নির্দেশিকায় উল্লেখ করা হয়েছে, রাজ্য সঙ্গীত হিসাবে গাওয়া হবে, ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল- পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান।। বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন, বাঙালির ঘরে যত ভাই বোন— এক হউক, এক হউক, এক হউক হে ভগবান’।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে আন্তর্জাতিক কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে রাজ্য সঙ্গীত হিসাবে যে গান বাজানো হয়েছিল, তাতে মূল গানের কথার সঙ্গে ওই গানের কথার ফারাক ধরা পড়েছিল। রবীন্দ্রনাথের লেখা মূল গানটির শব্দে ছিল, ‘বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন, বাঙালির ঘরে যত ভাই বোন...’ (যা নতুন নির্দেশিকায় রয়েছে)। কিন্তু নেতাজি ইন্ডোরে সে দিন বেজেছিল, ‘বাংলার প্রাণ বাংলার মন, বাংলার ঘরে যত ভাই বোন...’। তা নিয়ে বিস্তর সমালোচনাও হয়েছিল। নতুন নির্দেশিকায় সেই ‘বাংলা’ ফের ‘বাঙালি’ হল।
রবীন্দ্রনাথের লিখিত গানের কথা কেন বদল করা হল, তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে সমালোচনা হতে থাকে। যদিও সরকারের তরফে আনুষ্ঠানিক কোনও ব্যাখ্যা সেই সময়ে মেলেনি। তবে শাসকদলের অনেকে একান্ত আলোচনায় একটি ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল, বাংলায় বাঙালি বাদ দিয়েও অন্যেরা থাকেন। তাঁরা বাঙালি না-হলেও বাংলার মানুষ। সে কারণেই ওই বদল করা হয়েছিল। যদিও রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘বিকৃত’ করা যায় কি না, সেই প্রশ্ন তাঁরাও তুলেছিলেন।
উল্লেখ্য, ব্রিটিশ জমানায় বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময় রবীন্দ্রনাথ গানটি লিখেছিলেন। এখন যখন বাংলাদেশ নানাবিধ কারণে ডামাডোলের মধ্যে দিয়ে চলেছে, প্রতিনিয়ত যখন ওপার বাংলায় মৌলবাদীরা রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে জীবনানন্দ দাশের নাম বিভিন্ন স্থাপত্য থেকে মুছে দিতে চাইছে, তখন পশ্চিমবঙ্গ ফিরল রবীন্দ্রনাথের আদত কথাতেই। সময়ের নিরিখে এটি ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ বলে অভিমত অনেকের।
আরও পড়ুন:
নির্দেশিকায় মুখ্যসচিব ‘বাধ্যতামূলক’ ভাবে কিছু না বললেও তিনি উল্লেখ করেছেন, জাতীয় সঙ্গীত বা রাজ্য সঙ্গীত পরিবেশিত হওয়ার সময়ে সকলে উঠে দাঁড়ালে তা ‘উৎসাহব্যঞ্জক’ হয়। জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশিত হওয়ার সময়ে উঠে দাঁড়ানো কিংবা না-দাঁড়ানো নিয়ে দেশে ২০১৬ সালে কম বিতর্ক হয়নি। সে বছর সুপ্রিম কোর্টের একটি নির্দেশে বলা হয়েছিল, প্রেক্ষাগৃহে সিনেমা শুরুর আগে জাতীয় সঙ্গীত বাজানো বাধ্যতামূলক। তাদের পর্যবেক্ষণে দেশের শীর্ষ আদালত বলেছিল, তিন ঘণ্টার সিনেমা দেখতে যাঁরা যাবেন, তাঁরা ৫২ সেকেন্ড জাতীয় সঙ্গীত শুনতে পারবেন না কেন? সেই নির্দেশিকা কার্যকর হওয়ার পরে বেঙ্গালুরু থেকে গুয়াহাটি পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন জায়গায় অশান্তির ঘটনা ঘটেছিল। জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশিত হওয়ার সময়ে কেউ কেউ উঠে না দাঁড়ানোয় তাঁদের গণধোলাই খেতে হয়েছিল। প্রসঙ্গত, আইন বলছে, সংবিধানের ৩ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, জাতীয় সঙ্গীতের অবমাননা করা যাবে না। কিন্তু জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশিত হওয়ার সময়ে উঠে না-দাঁড়ানো অবমাননা কি না, সে প্রসঙ্গে আইনে কিছু বলা নেই। সুপ্রিম কোর্টের ২০১৬ সালের ওই নির্দেশ ২০১৮ সালে খারিজ করে দেয় শীর্ষ আদালতেরই বৃহত্তর বেঞ্চ। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যসচিবের নির্দেশিকাতেও রাজ্য সঙ্গীত পরিবেশিত হওয়ার সময়ে উঠে দাঁড়ানো ‘বাধ্যতামূলক’ বলা হয়নি। বলা হয়েছে, ‘উঠে দাঁড়ালে ভাল’।
তবে ‘বাংলা’ আবার ‘বাঙালি’তে ফিরেছে।