Advertisement
E-Paper

সুপারিশ তালিকায় নাম, পেয়েছেন চাকরিও! জেরা সিবিআইয়ের, প্রশ্ন করল আনন্দবাজার অনলাইনও

প্রাথমিকে নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে উদ্ধার হওয়া সুপারিশ তালিকার যে সব চাকরিপ্রার্থী চাকরি পেয়েছেন, তাঁদের কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলেছে আনন্দবাজার অনলাইন। তদন্তের স্বার্থে তাঁদের তলবও করেছিল সিবিআই।

cbi

গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।

সারমিন বেগম

শেষ আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১১:৫৮
Share
Save

বিভিন্ন ‘প্রভাবশালী’র সুপারিশেই কি তাঁদের চাকরি হয়েছে? সেই প্রসঙ্গে কি তাঁদের ডেকেছিল সিবিআই? সরাসরি ফোন করে তাঁদের কাছেই জানতে চেয়েছিল আনন্দবাজার অনলাইন।

এক জনের দাবি, কেউই তাঁর নাম সুপারিশ করেননি। নিজের যোগ্যতায় চাকরি পেয়েছেন। কারও বক্তব্য, ‘প্রভাবশালী’কে চেনেন। কিন্তু চাকরি তাঁর সুপারিশে হয়নি। কেউ আবার ‘প্রভাবশালী’র নাম শুনেই চুপ। তার পরেই ফোন কেটে দিয়েছেন।

প্রাথমিকে নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে উদ্ধার হওয়া সুপারিশ তালিকার যে সব চাকরিপ্রার্থী চাকরি পেয়েছেন, তাঁদের কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলে এমনই প্রতিক্রিয়া মিলেছে। তদন্তের স্বার্থে তাঁদের তলবও করেছিল সিবিআই। নিজাম প্যালেসে হাজিরাও দিয়েছিলেন তাঁরা।

গত বছর জুন মাসে বিকাশ ভবনে তল্লাশি চালিয়েছিলেন সিবিআইয়ের গোয়েন্দারা। সেখান থেকে বেশ কিছু নথি তাঁরা উদ্ধার করেন। সিবিআই সূত্রের খবর, তার মধ্যে একটি নথিতে ৩২৪ জন চাকরিপ্রার্থীর নাম এবং রোল নম্বর মিলেছে। তদন্তকারীদের অনুমান, বিভিন্ন ‘প্রভাবশালী’ ব্যক্তিই তাঁদের নাম সুপারিশ করেছিলেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে (নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় ধৃত এবং বর্তমানে জেলবন্দি রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী)। অনুমানের কারণ, নথিতে সেই সব ‘প্রভাবশালী’র নাম-পরিচয়ের উল্লেখ রয়েছে। নথিতে নাম রয়েছে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর ভাই প্রাক্তন সাংসদ দিব্যেন্দু অধিকারী, বিজেপি নেত্রী তথা প্রাক্তন আইপিএস অফিসার ভারতী ঘোষের। রয়েছে তৃণমূলের সাংসদ মমতাবালা ঠাকুর এবং তৃণমূল বিধায়ক শওকত মোল্লার নামও।

তবে বিজেপির দিব্যেন্দু এবং ভারতী দু’জনেই চাকরিপ্রার্থীদের নাম সুপারিশ করার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। বস্তুত, যে বছরের প্রাথমিকের পরীক্ষা নিয়ে এত হইচই, সেই ২০১৪ সালে তাঁরা কেউই বিজেপিতে ছিলেন না। দিব্যেন্দু ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের প্রাক্কালে আনুষ্ঠানিক ভাবে বিজেপিতে যোগ দেন। তার আগে তিনি তৃণমূলে ছিলেন। ভারতী পদ্মশিবিরে নাম লেখান ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের আগে। তার আগে প্রাক্তন পুলিশ সুপার ‘তৃণমূল-ঘনিষ্ঠ’ বলেই পরিচিত ছিলেন। দিব্যেন্দু, ভারতীর মতো বিষয়টি অস্বীকার করেছেন তৃণমূলের মমতাবালা, শওকত এবং রমেন্দ্রনাথও।

নথিতে দেখা গিয়েছে, দিব্যেন্দু এবং মমতাবালার নামের পাশে ‘এমপি’ (সাংসদ) লেখা। অনেকের নামের পাশে লেখা ‘এমএলএ’ (বিধায়ক)। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন বীণা মণ্ডল, নির্মল ঘোষ, শওকত মোল্লা, শ্যামল সাঁতরা, রমেন্দ্রনাথ বিশ্বাস এবং গুলশন মল্লিক। সকলেই তৃণমূলের নেতানেত্রী। নির্মল, বীণা, শওকত এবং গুলশন এখন বিধায়ক।

তদন্তে যে সব ‘প্রভাবশালী’র নাম এসেছে, তাঁদের কয়েক জনের সঙ্গে আগেই যোগাযোগ করা হয়েছিল। দিব্যেন্দু কোনও মন্তব্য করতে চাননি। ভারতী বলেছিলেন, ‘‘আমি এসপি (পুলিশ সুপার) থাকাকালীন অনেক লোকের উপকার করেছি। কিন্তু সবটাই আইনের গণ্ডির মধ্যে থেকে। কারও পরীক্ষাকেন্দ্র বদলের দরকার হলে যেখানে বলার বলেছি। কারও পরীক্ষা হয়ে গিয়েছে, রেজাল্ট বেরোচ্ছে না, যেখানে বলার বলেছি। কিন্তু কেউ পরীক্ষা দেয়নি বা পাশ করেনি, তাকে চাকরি দিয়ে দাও, এমন আমি কখনও বলিনি।’’ ভারতীর আরও বক্তব্য, ‘‘আমার নাম সিবিআই কোথাও পেয়ে থাকলে বা আমার বলায় কারও চাকরি হয়েছে বলে সিবিআই জেনে থাকলে সিবিআইয়ের উচিত ছিল আমার সঙ্গে কথা বলা। আমাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করতে পারত। আমার সঙ্গে কোনও কথাই বলল না! আমি কিছু জানতাম না। কিন্তু আমার নাম জড়িয়ে দিল। এটা সম্পূর্ণ বেআইনি।’’ তৃণমূলের সাংসদ মমতাবালারও বক্তব্য, ‘‘এ সব কিছুই জানি না। পুরোটাই চক্রান্ত। আমি কোনও অন্যায়ের সঙ্গে যুক্ত নই।’’

সিবিআই সূত্রের খবর, বিকাশ ভবন থেকে সুপারিশ তালিকা উদ্ধার হওয়ার পর তদন্তকারীরা সেই নথি প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদে পাঠিয়ে জানতে চেয়েছিলেন, ৩২৪ জনের মধ্যে কত জনের চাকরি হয়েছে। তার জবাবে পর্ষদ সিবিআইকে নথি দিয়ে জানিয়েছে, ওই তালিকা থেকে মোট ১৩৪ জন চাকরি পেয়েছেন। সিবিআইকে পর্ষদের দেওয়া সেই নথি আনন্দবাজার অনলাইনের হাতে রয়েছে। ওই নথিতেই দেখা যাচ্ছে, দিব্যেন্দুর সুপারিশ তালিকায় যে ১১ জন চাকরিপ্রার্থীর নাম ছিল, তাঁদের মধ্যে পাঁচ জনের চাকরি হয়েছে। তাঁদেরই এক জনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। পূর্ব মেদিনীপুরের বাসিন্দা ওই ব্যক্তির কাছে জানতে চাওয়া হয়, তিনি দিব্যেন্দুকে চেনেন কি না বা তাঁর সুপারিশেই চাকরি পেয়েছেন কি না। তিনি বলেন, ‘‘সিবিআই আমায় ডেকেছিল। নভেম্বরে হাজিরা দিয়েছিলাম। ওরা আমার কাছে কিছু নথি দেখতে চেয়েছিল। সেগুলো জমা দিয়েছিলাম। দিব্যেন্দু অধিকারীকে চিনি না। আমি কারও সূত্রেই চাকরি পাইনি।’’

বীণার সুপারিশ তালিকার ছ’জন চাকরি পেয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে এক জন উত্তর ২৪ পরগনার স্বরূপনগরের বাসিন্দা। তিনিও জানান, সিবিআই তাঁকেও তলব করেছিল। গত বছর জুন-জুলাই মাসে হাজিরা দিয়েছিলেন তিনি। একই কথা জানিয়েছেন ভারতীর তালিকায় থাকা দুই চাকরিপ্রাপকও। মমতাবালার তালিকায় থাকা যে দু’জনের চাকরি হয়েছে, তাঁদের এক জনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। তাঁকেও প্রশ্ন করা হয়, তিনি মমতাবালাকে চেনেন কি না। মহিলাকণ্ঠের জবাব ছিল, ‘‘হ্যাঁ, চিনি।’’ মমতাবালার সুপারিশেই তাঁর চাকরি? শুনেই তিনি ফোন কেটে দেন। আর ধরেননি।

নির্মলের তালিকায় থাকা ছ’জনের চাকরি হয়েছে। তাঁদের মধ্যে দু’জনের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। এক জন বলেন, ‘‘সিবিআই ডেকেছিল। আমি গিয়েছিলাম। নথিও দেখিয়েছিলাম। সব ঠিকঠাক ছিল। ওরা দেখে ছেড়ে দিয়েছে। সুপারিশ তালিকায় কী করে নাম এল জানি না। সিবিআই আবার ডাকলে যাব। সাহায্যও করব।’’ আর এক জনের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, তিনি নির্মলকে চেনেন কি না। তাঁর জবাব, ‘‘নির্মল ঘোষকে চিনি না। সিবিআই যখন ডেকেছিল, তখনই নাম জানতে পেরেছি।’’ তাঁর বক্তব্য, ‘‘আমার কাছে সব নথি রয়েছে। এত চাকরিপ্রার্থী থাকতে আমার নামটাই কেন এল?’’

সিবিআই সূত্রে খবর, ৩২৪ জন চাকরিপ্রার্থীর ওই সুপারিশ তালিকা গত বছর ২৩ অগস্ট পর্ষদের কাছে পাঠিয়েছিল সিবিআই। তারা জানতে চেয়েছিল, ৩২৪ জনের মধ্যে কত জনের চাকরি হয়েছে। এর পরে ওই বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর পর্ষদ সিবিআইকে ১৩৪ জন চাকরিপ্রাপকের নামের তালিকা দেয়। পর্ষদের নথিতে ওই ১৩৪ জনের নাম, রোল নম্বর, বাবার নাম, ঠিকানা, কোন স্কুলে চাকরি এবং তারিখ-সহ সুপারিশপত্রের মেমো নম্বর রয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, কেউ ২০১৭ সালে চাকরি পেয়েছেন। কেউ আবার চাকরি পেয়েছেন ২০২১ সালেও। তদন্তকারী সংস্থার সূত্রের বক্তব্য, সুপারিশ তালিকার মধ্যে যাঁদের চাকরি হয়েছে, তাঁদের চাকরি সুপারিশের কারণেই হয়েছে কি না, আপাতত সেটিই তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। তবে ‘প্রভাবশালী’দের কাউকে এখনও তলব করা হয়নি। যদিও ওই চাকরিপ্রাপকদের একাংশকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে সিবিআই। সেটা তাঁরা আনন্দবাজার অনলাইনকেও জানিয়েছেন।

(যাঁরা চাকরি পেয়েছেন বা সিবিআই যাঁদের ডেকেছিল, তাঁদের সামাজিক সম্মানের কারণে আমরা তাঁদের নাম এখানে প্রকাশ করলাম না)

SSC Recruitment Scam SSC recruitment scam Bengal SSC Recruitment Case CBI

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}