জুনের প্রথম দিকে হিঙ্গলগঞ্জের বাঁকড়ায় কনকনগর এসডি ইনস্টিটিউশন আয়োজন করেছিল স্বাস্থ্য শিবিরের। সেখানে সন্ধ্যের মুখে বছর পঁয়ত্রিশের এক রোগিণীকে নিয়ে আসেন পরিজনেরা। তলপেটের যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাওয়া সেই মহিলা হাঁটা তো দূর, সোজা হতেও পারছিলেন না। প্রাথমিক পরীক্ষায় দেখা যায়, পেলভিক ইনফ্লেমেটরি ডিজ়িজে (পিআইডি) আক্রান্ত ওই মহিলা। চিকিৎসকেরা বুঝতে পারেন দীর্ঘদিন ধরেই সংক্রমণ ছিল তাঁর। আমপানের ফলে বিস্তীর্ণ জলমগ্ন অঞ্চলে থাকতে থাকতে স্নান-কাপড় ধোয়ার অপরিচ্ছন্নতায় সেটাই বেড়ে গিয়েছে। স্বামী মুদির দোকানে কাজ করেন এবং মহিলা নিজে মাছের জাল বুনে যেটুকু আয় করেন। তাই শারীরিক সমস্যা শুরু হলেও আমল দেননি। উদ্যোক্তাদের দেওয়া ওষুধ এবং ইঞ্জেকশনের দীর্ঘ কোর্সে সুস্থ সেই মহিলা।
সরবেরিয়ার সুন্দরবন শ্রমজীবী হাসপাতাল আয়োজিত মিনাখাঁ ব্লকের গড়ে সে দিন শিবির চলছিল। পেট ও পিঠ থেকে ঘুরে আসা অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলেন সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা এক সন্তানের বছর সাতাশের মা। সম্প্রতি গ্রামের হাতুড়ে চিকিৎসকের কাছে তাঁর গর্ভপাতও হয়েছিল। অ্যাকিউট পিআইডি রোগীর দ্রুত চিকিৎসা শুরু হয় শিবিরেই। বর্তমানে সুস্থ তিনি।
পিআইডি বা পেলভিকে সংক্রমণের মূল কারণ অপরিচ্ছন্নতা। চিকিৎসকদের মতে, মূলত তিনটি স্তর থেকে এই সংক্রমণ হতে পারে। এক, স্নান, কাপড় ধোয়া এ সবের অপরিচ্ছন্নতা থেকে। দুই, ঋতুকালীন সময়ে অপরিষ্কার থাকা বা কাপড় ব্যবহারের ফলে। তিন, গর্ভপাত যদি বিধি মেনে স্বাস্থ্যসম্মত ভাবে না হয়। চিকিৎসকদের মতে, পিআইডি সময়ে না সারালে স্যালফিনজাইটিস (ফ্যালোপিয়ান টিউবে সংক্রমণ) হয়ে সন্তান ধারণে সমস্যা হবে। এ ছাড়াও ঋতুস্রাব কম বা বেশি, অনিয়মিত ঋতুচক্রের সমস্যা বাড়তেই থাকে। পাশাপাশি এন্ডোমেট্রাইটিস (ইউটেরাসের ভিতরে রক্তক্ষরণ), সার্ভিসাইটিসের (জরায়ুর মুখে সংক্রমণ) মতো সমস্যাও দেখা দেবে।
স্বাস্থ্য শিবিরগুলিতে অংশগ্রহণকারী চিকিৎসকদের অভিজ্ঞতা, পরিচ্ছন্নতা মেনে চলায় আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় এই সংক্রমণ কম দেখা গিয়েছে। যে কারণে মোহনপুর ও হরিণহুলার মতো এলাকায় পিআইডি রোগী নগণ্য বলা চলে। সুন্দরবন শ্রমজীবী হাসপাতাল আয়োজিত ২ জুন বাউনিয়ায় প্রথম স্বাস্থ্য শিবির করেন আর জি করের চিকিৎসকেরা। ন্যাজাট, মিনাখাঁ, পশ্চিম মোহনপুর, কুলতলি এবং হিঙ্গলগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় আয়োজিত শিবিরগুলি মিলিয়ে চার হাজার রোগী দেখেছেন তাঁরা। চারশোর বেশি বিভিন্ন স্ত্রী-রোগে আক্রান্ত। এর এক-তৃতীয়াংশ পিআইডি রোগী। এ ছাড়াও পলিসিস্টিক ওভারির সমস্যাও রয়েছে। চিকিৎসকদের মতে, সচেতনতা ও চিকিৎসার অভাবে এগুলি দীর্ঘদিন ধরে লালিত।
এছাড়া, কোভিড পরিস্থিতিতে বিভিন্ন ব্লক থেকে চিকিৎসক তুলে নেওয়া হচ্ছে। ফলে মার্চের শেষ থেকে এক প্রকার চিকিৎসা বন্ধ বিস্তীর্ণ এলাকায়। ভরসা স্বাস্থ্য শিবিরে যাওয়া কলকাতার চিকিৎসকেরা। ওষুধ দিয়ে পাশে থাকছেন শিবিরের আয়োজকেরা।
কিন্তু সেটা কত দিন? কারণ, তথ্য অনুযায়ী, এখনও সব পক্ষ সচেতন না হলে স্ত্রী-রোগের বাড়বাড়ন্ত অশনি সঙ্কেত দেখাচ্ছে সুন্দরবনের ভবিষ্যতকে।