Advertisement
E-Paper

পরিকাঠামোয় পিছিয়ে, কেন মিলবে ডাক্তার

ক্ষমতায় এসেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, তিনি স্বাস্থ্যের বিকেন্দ্রীকরণ চান। কথায় কথায় গ্রামের মানুষকে চিকিৎসার জন্য কলকাতায় ছুটতে হয়। সেখানে নানা ভাবে তাঁদের হয়রান হতে হয়। এই ছবিটাই বদলে দিতে চান তিনি।

সোমা মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০১ অগস্ট ২০১৬ ০৪:০০

ক্ষমতায় এসেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, তিনি স্বাস্থ্যের বিকেন্দ্রীকরণ চান। কথায় কথায় গ্রামের মানুষকে চিকিৎসার জন্য কলকাতায় ছুটতে হয়। সেখানে নানা ভাবে তাঁদের হয়রান হতে হয়। এই ছবিটাই বদলে দিতে চান তিনি।

মূলত সেই লক্ষ্যেই মোট ৪১টি সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল খোলার সিদ্ধান্ত হয়েছিল বিভিন্ন জেলায়। গোটা প্রকল্পের আর্থিক ভার বিপুল। রাজ্যের টাকার পাশাপাশি কেন্দ্রের ‘ব্যাকওয়ার্ড রিজিয়ন গ্রান্ট ফান্ড’-এর টাকাও দেদার ঢালা হচ্ছে ‘স্পেশ্যালিটি’ খাতে। কিন্তু যে স্বপ্নের ছবিটা মুখ্যমন্ত্রী সে দিন সাধারণ মানুষকে দেখিয়েছিলেন, রাজ্যে তিনি দ্বিতীয় দফায় সরকার গড়ার পরেও তা পূরণ হয়নি। কেন?

স্বাস্থ্য কর্তাদের একটা বড় অংশের ব্যাখ্যা, ব্যাপারটা আদতে হয়ে গিয়েছে গাছের গোড়া কেটে আগায় জল দেওয়ার মতো। রাজ্যের মেডিক্যাল কলেজগুলি বহু দিন ধরেই ডাক্তার-নার্সের অভাবে ধুঁকছে। সেগুলির নীচের তলায় প্রাথমিক স্তরেও পরিকাঠামোর যথেষ্ট অভাব। সে দিকে নজর দেওয়ার বদলে সুপার স্পেশ্যালিটির বাড়তি ভার নেওয়ার সিদ্ধান্তে দূরদর্শিতার অভাবই দেখছেন ওই কর্তারা।

স্বাস্থ্য দফতরের হিসেব বলছে, প্রতি বছর এই রাজ্য থেকে মোটামুটি ২৩০০ ডাক্তার পাশ করে বেরোন। কিন্তু তার পরেও পশ্চিমবঙ্গের ১৩টি সরকারি এবং তিনটি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ, ২৭টি জেলা হাসপাতাল, ৩৭টি মহকুমা হাসপাতাল, ১১০টি গ্রামীণ হাসপাতাল, ৩৫০টি ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং ৯০০টি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বছরের পর বছর পর্যাপ্ত ডাক্তার-নার্স দেওয়া যায় না। এর সঙ্গে ৪১টি সুপার স্পেশ্যালিটি (যার কয়েকটি এখনও চালু হওয়া বাকি) জুড়লে দেখা যাচ্ছে, সব ক’টি হাসপাতাল সুষ্ঠু ভাবে চালাতে হলে সমস্ত স্তর মিলিয়ে রাজ্যে দরকার আনুমানিক আরও চার হাজার ডাক্তার, পাঁচ হাজার নার্স এবং এক হাজার টেকনিশিয়ান।

আর বাস্তব ছবিটা কী? নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক স্বাস্থ্য কর্তাই বলে দিলেন, যে সমস্ত সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে এখনও পর্যন্ত ইন্ডোর চালু হয়েছে, তার প্রত্যেকটিতেই প্রয়োজনের চার ভাগের এক ভাগ বা তারও কম সংখ্যক ডাক্তার-নার্স-টেকনিশিয়ান রয়েছেন। সর্বত্র তাই রেফারের গল্প।

রাজ্যে সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল প্রকল্প রূপায়ণের দায়িত্বপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য কর্তা প্রদীপ মিত্র পর্যন্ত বলছেন, ‘‘নতুন ডাক্তার নিয়োগ শুরু হয়ে গিয়েছে। তবে ডাক্তারের যা অভাব, তাতে সব পদ হয়তো পূরণ করা যাবে না।’’ এই সঙ্কট যে অবশ্যম্ভাবী, মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার সময়েই তা তাঁকে জানানো হয়নি কেন? অন্য এক কর্তার জবাব, ‘‘সবাই আসলে ভেবেছে, এই কথাটা যে তুলবে সে অপ্রিয় হবে। তাই কেউ সমস্যাটা সামনে আনেনি। ফল যা হওয়ার, তা-ই হচ্ছে!’’

ঘটনা হল, অনেক ক্ষেত্রে আবার সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে ডাক্তার জোগান দিতে গিয়ে উল্টো বিপাকে ফেলে দেওয়া হয়েছে মেডিক্যাল কলেজগুলিকে। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, মালদহ মেডিক্যাল কলেজের প্রত্যেকটি থেকে ৩০-৪০ জন করে মেডিক্যাল অফিসার তুলে নেওয়া হয়েছে। মেদিনীপুর মেডিক্যালের এক কর্তার কথায়, ‘‘আমরা বলেছিলাম, এত জন মেডিক্যাল অফিসারকে তুলে নিলে আমরা কাজ চালাব কী করে? তখন বলা হয়েছিল পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ট্রেনি (পিজিটি) দিয়ে কাজ চালাতে। মাথার উপরে তত্ত্বাবধানের কাউকে না রেখে শুধু পিজিটি দিয়ে মেডিক্যাল কলেজের পরিষেবা চালানো অসম্ভব।’’

পরিকল্পনার চূড়ান্ত অভাবকেই এই উভয়-সঙ্কটের জন্য দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞেরা। স্বাস্থ্য দফতরের এক উপদেষ্টা বললেন, ‘‘শুধু টাকা খরচ করলেই যে হয় না, এখন বারবার তা প্রমাণ হচ্ছে। উদাহরণ অজস্র। যেমন, বেশির ভাগ সুপার স্পেশ্যালিটিতে সরঞ্জাম জীবাণুমুক্ত করতে এমন বিশাল ‘অটোক্লেভ’ যন্ত্র দেওয়া হয়েছে যে, তা চালাতেই পারেন না কর্মীরা। ফলে সঠিক ভাবে জীবাণুমুক্ত না করেই সেগুলি ব্যবহৃত হচ্ছে।” ভদ্রলোকের আক্ষেপ, এ নিয়ে অপারেশন থিয়েটারের নার্সদের জিজ্ঞাসা করা হলে তাঁরা বলছেন, ‘‘আমরা কী করব! স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে সরাসরি তুলে এনে বসিয়ে দিয়েছে এখানে। কোনও কিছু শেখায়নি। বলেছে, যতটুকু পারো, সেটাই করো!’’

প্রসঙ্গ তুলতেই দায়িত্বপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য কর্তা প্রদীপবাবু ফের স্বীকার করে নিলেন, তাঁরা হন্যে হয়ে টেকনিশিয়ান খুঁজছেন। কিন্তু অনেকেই জেলায় যেতে চাইছেন না। ফলে টেকনিশিয়ানের অভাবে রোগ নির্ণয় কেন্দ্রও খোলা যাচ্ছে না সরকারি সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালগুলিতে।

সরকার যখন এমন নাজেহাল, তখন কী চরম বৈপরীত্য বেসরকারি ক্ষেত্রে‌! দেখা যাচ্ছে, একাধিক বেসরকারি সংস্থা বেশ সাফল্যের সঙ্গেই জেলায় জেলায় সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল চালাচ্ছে। এমন নয় যে বেসরকারি হাসপাতালের পরিষেবা নিয়েও একেবারেই অভিযোগ ওঠে না। কিন্তু তারা কী ভাবে জোগাড় করছে ডাক্তার ও টেকনিশিয়ান? একাধিক বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সেখানে শুধু যে পর্যাপ্ত সংখ্যায় পূর্ণ সময়ের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা আছেন তা-ই নয়, হাসপাতালে প্রশিক্ষণ চালু করে টেকনিশিয়ানও তৈরি করা হচ্ছে সেখানে। এটাই রাজ্য পারছে না কেন? দফতরের এক শীর্ষ কর্তার বক্তব্য, ‘‘না পারার তো কথা নয়। কিন্তু পারতে গেলে লাল ফিতের ফাঁসটা খুলতে হবে। প্রয়োজনে বেসরকারি সংস্থার সাহায্য নিতে হবে। হাসপাতালে টেকনিশিয়ানদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার পথে প্রধান চ্যালেঞ্জটাই তো হল সরকারি নিয়মের গেরো!’’

এবং নিঃসন্দেহে আরও বড় চ্যালেঞ্জ হল, রাজ্যে ডাক্তারের সংখ্যার এই সঙ্কটের মধ্যেও সরকারি হাসপাতালে তাঁদের ধরে রাখা। জেলায় কাজ করতে রাজি করানো। এখানেই বর্ষীয়ান চিকিৎসকদেরা বলছেন, শুধুমাত্র মোটা বেতন বা ভাতার লোভ দেখালেই পাণ্ডববর্জিত কোনও এলাকায় ডাক্তারেরা পড়ে থাকবেন, এমন ভাবাটা ভুল। দুর্গাপুরের এক বেসরকারি হাসপাতালের কর্ণধার সত্যজিৎ বসু বললেন, ‘‘ডাক্তাররা যে কোনও জায়গায় যেতে গেলে দেখেন, তিনি সেখানে কাজের সুযোগ, পরিকাঠামো, ভাল বেতন পাচ্ছেন কি না। আবার এ-ও দেখেন, সেখানে ভাল স্কুল, থাকার জায়গা, বিনোদনের বন্দোবস্ত ইত্যাদি আছে কি না। এই দিকগুলি নিশ্চিত করে তবেই প্রকল্প শুরু করলে ভাল হয়। আমরা সেটা দিতে পেরেছি বলেই ডাক্তাররা এসেছেন।’’ পাঁশকুড়ায় একটি সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের কর্ণধার শতদল সাহার কথায়, ‘‘এক জন চিকিৎসকের পক্ষে কাজ করার জন্য জরুরি হল স্বাধীনতা, ভাল বেতন এবং বিভাগের পরস্পরের সঙ্গে সমন্বয়। এগুলো একসঙ্গে থাকলে তিনি যেমন কাজে তৃপ্তি পাবেন, তেমন রোগীর বরাতেও ভাল পরিষেবা জুটবে।’’ তাঁর মতে, হাসপাতালে ঠিক কাদের চিকিৎসা হবে আর কী চিকিৎসা হবে— এই দু’টো বিষয় ঠিক করাই সবচেয়ে জরুরি। কাজের পক্ষেও তা সুবিধাজনক।

স্বাস্থ্য দফতরের একটা বড় অংশ মনে করে, ভাবনা-চিন্তায় খানিক বদল এলে বেসরকারি হাসপাতালের সুসংহত ছবিটা সরকারি সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালেও দেখতে পাওয়া অসম্ভব নয়। দরকার কিছু ‘ব্যতিক্রমী’ পদক্ষেপ। উদাহরণ দিয়ে এই কর্তারা বলছেন, সরকার যদি কোনও বিমা সংস্থা ও বেসরকারি হাসপাতাল সংস্থার সঙ্গে একযোগে চুক্তি করে, তা হলে সরকারি সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালগুলি চালানোর ক্ষেত্রে তা যথেষ্ট সহায়ক হতে পারে। এ ক্ষেত্রে সুরাহা হতে পারে গুচ্ছ বিমা বা ‘গ্রুপ ইনসিওরেন্স’। স্বাভাবিক নিয়মবলে এর আওতায় যত বেশি মানুষকে আনা যাবে, বিমার প্রিমিয়ামের অঙ্কও তত কমবে। ফলে এক দিকে, সেই সামান্য টাকায় বিশ্বমানের চিকিৎসা পাবেন সাধারণ মানুষ। একটি বিমা সংস্থার হিসেব বলছে, সরকার যদি তিন কোটির মতো পরিবারকে বছরে এক হাজার টাকা করে বিমা করায়, তা হলে তা থেকেই প্রত্যেকটি পরিবার বছরে দুই থেকে আড়াই লক্ষ টাকা পর্যন্ত সুবিধে পেতে পারে। এখানেই বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে হাসপাতাল চালানোর বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে সরকার দেবে বাড়ি ও সরঞ্জাম আর কর্মীর ব্যবস্থা করে হাসপাতাল চালাবে বেসরকারি সংস্থা। বিমা সংস্থা জড়িত থাকায় বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও নিশ্চিন্ত হতে পারবেন যে তাঁদের খয়রাতি করে চিকিৎসা পরিষেবা দিতে হবে না। সরকারের কাজ হবে, মানুষ যথাযথ পরিষেবা পাচ্ছে কি না, সে দিকে নজর রাখা। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই রকম বন্দোবস্ত করা গেলে বেসরকারি হাসপাতাল সংস্থাগুলি জেলায় যেতেও উদ্যোগী হবে।

কর্তাদের মতে, এমন পরিকল্পনা দরকার, যাতে সবটাই দাতব্যের পর্যায়ে না পৌঁছয়। যাতে জেলায় পাঠালে কোনও ডাক্তার সেটাকে শাস্তি বলে মনে না করেন। বিরূপ মনোভাব নিয়ে কেউ কাজে যোগ দিলে ভাল পরিষেবা পাওয়া যে সম্ভব নয়, তা বুঝতে হবে সরকারকেই।

(শেষ)

hospital infrastructure doctor
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy