Advertisement
E-Paper

শিল্পের দোর বন্ধ, পথে বসেছেন বিশ্বকর্মা

শেষ ভাদ্রের আকাশে ওড়ে পেটকাটি-চাঁদিয়াল। কিন্তু কঞ্চির বুককাঠিতে আর সেই হাওয়া নেই। চিমনির ধোঁওয়া আকাশে যত উঁচুতে ওঠে, বিশ্বকর্মা পুজোর দিন ঘুড়ি তার চেয়ে বেশি উঠলে এক সময়ে ট্রফি দেওয়া হত। সোনালি ট্রফিতে রঙ-বেরঙের ফিতে, সঙ্গে কড়া মাঞ্জা দেওয়া এক লাটাই সুতো আর এক ডজন ঘুড়ি।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:০০
আলোর সাজ বিশ্বকর্মা পুজোয়। হলদিয়া শিল্পাঞ্চলে তোলা ছবি।

আলোর সাজ বিশ্বকর্মা পুজোয়। হলদিয়া শিল্পাঞ্চলে তোলা ছবি।

শেষ ভাদ্রের আকাশে ওড়ে পেটকাটি-চাঁদিয়াল। কিন্তু কঞ্চির বুককাঠিতে আর সেই হাওয়া নেই। চিমনির ধোঁওয়া আকাশে যত উঁচুতে ওঠে, বিশ্বকর্মা পুজোর দিন ঘুড়ি তার চেয়ে বেশি উঠলে এক সময়ে ট্রফি দেওয়া হত। সোনালি ট্রফিতে রঙ-বেরঙের ফিতে, সঙ্গে কড়া মাঞ্জা দেওয়া এক লাটাই সুতো আর এক ডজন ঘুড়ি। কালো ধোঁওয়ায় ঢাকা শিল্পাঞ্চলে ঘুড়ি উত্‌সবের নামে বছরে একটা দিন আকাশ রঙিন হত।

গঙ্গাপারে ব্যারাকপুর-কল্যাণী শিল্পাঞ্চল দুর্গাপুজোয় এখন কলকাতার সঙ্গে পাল্লা দেয়। কিন্তু একটা সময়ে এখানে দুর্গাপুজোর থেকেও বড় উত্‌সব ছিল বিশ্বকর্মা পুজো। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই কলকারখানাগুলোয় শুরু হত প্রস্তুতি। সাত দিন উত্‌সবের মেজাজ থাকত। এক মাস ধরে চলত মেলা, যাত্রা। সংয়ের গান, কাওয়ালি, কীর্তন কিছু বাদ থাকত না। আর ভূরিভোজ।

স্বাধীনতার সময় থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত ঝলমলে এই ছবিটা এখন মলিন। ব্যরাকপুর কি শুধু? হুগলিতে বন্ধ হয়ে যাওয়া হিন্দমোটর কারখানা। আসানসোল-দুর্গাপুরে ঝাঁপ পড়ে যাওয়া কারখানা-শ্রমিক মহল্লায় একই বিষাদের মেঘ। ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে প্রায় সাড়ে তিনশো কারখানার মধ্যে পঁচাশিটা চলছে। ন্যাশনাল জুট ম্যানুফ্যাকচারার্স কর্পোরেশনের অধীন তিনটে বড় চটকলের মধ্যে জগদ্দলের আলেকজান্ডার চটকল বন্ধ এক দশকের উপরে। গত ১ অগস্ট বন্ধ হয়ে গিয়েছে টিটাগড় কেনিসন চটকল। আর বিশ্বকর্মা পুজোর ঠিক আগেই থমকে গিয়েছে খড়দহ চটকলের কাজ। এক সময়ের বড় কারখানা হিন্দুস্থান হেভি কেমিক্যালস-এর চিমনিতে বটের চারা শিকড় ছড়িয়েছে।

সোদপুরে বন্ধ হয়েছে ডাকব্যাকের মতো সংস্থা। টিটাগড় ওয়াগনে তালা ঝুলছে। নৈহাটির গরিফায় গঙ্গার ধারে জেনসন অ্যান্ড নিকেলসনের রঙের কারখানার দেশজোড়া খ্যাতি ছিল। তার পাশেই কয়েক বিঘা জমিতে ক্যাপস অ্যান্ড কন্টেনার, চলতি নাম ছিল ‘ছিপি কারখানা’। দশ হাজারের বেশি শ্রমিক পরিবারের রুটিরুজির সংস্থান এখন ভগ্নস্তূপ। জগদ্দলের রামস্বরূপ স্টিলের দরজায় মরচে। শ্যামনগরে সিইএসসি-র পাওয়ার স্টেশন গিলে ফেলেছে ঝোপজঙ্গল। সেখানে এখন সাপখোপের আড্ডা।

বারাসত হরিতলা মোড়ে।

নৈহাটির বন্ধ গৌরীপুর চটকল কুলি লাইনের বাসিন্দারা দু’মুঠো খাবারের জন্য পথে নেমেছেন। পিএফ অফিসের সামনে ছেঁড়া কাপড়ে থালা হাতে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। কী কারণে একের পর এক বড় কারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছে, তার সঠিক জবাব জানা নেই কারও। জগদ্দলের নিক্কো কেবল, কল্যাণী শিল্পাঞ্চল এলাকার ছোট-ছোট কারখানাগুলো বা নৈহাটি হুকুমচাঁদ চটকলে এ বারও পুজো হয়েছে। ঘুড়িও উড়েছে। কিন্তু সেই মেজাজটাই যেন নেই। বিশ্বকর্মা কারখানা ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন পাড়ার মোড়, রিকশা-অটো স্ট্যান্ড, ট্যাক্সি বা বাস স্ট্যান্ডে।

দুর্গাপুর-আসানসোল শিল্পাঞ্চলের কুলটিতে ইস্কোর বিশ্বকর্মা পুজো এক সময়ে কার্যত দুর্গাপুজার চেহারা নিত। ২০০৩ সালে কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। ২০০৮-এ ফের উত্‌পাদন শুরু হলেও রমরমা ফেরেনি। রূপনারায়ণপুরের হিন্দুস্তান কেব্‌লস কারখানাতেও ২০০৩ থেকে উত্‌পাদন বন্ধ। বর্তমানে শ্রমিক-কর্মীদের বছরখানেকের বেতন বকেয়া। আসানসোলের কন্যাপুরের শিল্পতালুকের ছবিও ম্লান। গত পাঁচ বছরে সেখানে নতুন শিল্প আসেনি। উল্টে একাধিক সংস্থা গুটিয়ে গিয়েছে।

দুর্গাপুরে বন্ধ হয়ে যাওয়া রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা এমএএমসি, বিওজিএল বা এইচএফসিএল কারখানার প্রাক্তন কর্মী ও তাঁদের পরিবারেরও শুধু স্মৃতিই সম্বল। শহরের অলিতে-গলিতে অনেক পুজো হচ্ছে বটে, কিন্তু বড় কারখানার পুজোর মতো তার কৌলীন্য-জমক কিছুই নেই। শহরের মৃত্‌শিল্পী খগেন পালের আক্ষেপ, “শিল্পের আর সুদিন নেই। তার ছাপ পড়েছে বিশ্বকর্মা পুজোতেও। আয় কমেছে আমাদের।”

এই দিনটিতে এক সময়ে ঝলমল করত হুগলি শিল্পাঞ্চল। এখন জুটমিলগুলো ধুঁকছে। গাড়ি কারখানা হিন্দুস্তান মোটরস গত কয়েক মাস যাবত্‌ বন্ধ। অবিলম্বে উত্‌পাদন চালুর দাবিতে কারখানার গেটের সামনে অবস্থান করছে আইএনটিটিইউসি। এ বার আর কারখানার ভিতরে পুজো হয়নি। বাইরে অবস্থানরত শ্রমিকেরাই নমো-নমো করে পুজোর আয়োজন করেন। আশা, যদি ফের কারখানা খোলে! টিটাগড়ে সদ্য বন্ধ হওয়া কেনিসন চটকলের কর্মী ইসমাইল হোসেন বলেন, “বিশ্বকর্মা পুজোয় আমাদের কেউ ধর্মের ধার ধারত না। সবাই বউ-বাচ্চা নিয়ে কারখানায় আসত। খিচুড়ি আর আলুর দম হত।’’

সাইকেলের পিছনে বউ সামনে বাচ্চাকে বসিয়ে কারখানার শ্রমিকদের বিশ্বকর্মা পুজো দেখাতে নিয়ে যাওয়ার চেনা ছবিটা কবেই হারিয়ে গিয়েছে।

closed factory bengal biswakarma puja celebration scenario way state news online state news Door close
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy