E-Paper

তালিকার ‘ভূত’ ধরতে কমিশনের সাত নির্দেশ

রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকের (সিইও) দফতর থেকে সব জেলাশাসকদের (ডিইও) নির্দেশিকা পাঠিয়ে বলে দেওয়া হয়েছে, গণনা-পত্র জমা পড়ে যাওয়ার কী ভাবে তথ্য যাচাই করতে হবে।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৬:৪৮

গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

ভোটার তালিকা থেকে ‘ভূত’ ঝাড়ার জন্য প্রয়োগ করা হয়েছে বিশেষ নিবিড় সংশোধন (এসআইআর)। কিন্তু সেই ছাঁকনিতে সব ‘ভূত’ ধরা পড়ছে কি? এসআইআর প্রক্রিয়ার মধ্যেও ‘ভুয়ো’ নাম থেকে যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠতে শুরু করেছে রাজ্যে। এই পরিস্থিতিতে এনুমারেশন ফর্ম বা গণনা-পত্রের তথ্য যাচাই করার জন্য কয়েক দফা পদক্ষেপ নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন। বিরোধীদের দাবি, কাগজে-কলমের নির্দেশিকা বাস্তবে মানা হচ্ছে কি না, সে দিকে নজর থাকবে। আর শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের মতে, ভোটারের তথ্য ও যোগ্যতা যাচাই করার কাজ কমিশনেরই। কিন্তু এই কাজে তারা যেন কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপির দ্বারা প্রভাবিত না হয়।

রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকের (সিইও) দফতর থেকে সব জেলাশাসকদের (ডিইও) নির্দেশিকা পাঠিয়ে বলে দেওয়া হয়েছে, গণনা-পত্র জমা পড়ে যাওয়ার কী ভাবে তথ্য যাচাই করতে হবে। এই প্রক্রিয়ায় সব চেয়ে বেশি নজর দেওয়া হচ্ছে ‘প্রোজেনি ম্যাপিং’ বা বংশগত মিলের দিকে। এসআইআর-এর নিয়ম অনুযায়ী, ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় যাঁদের নিজেদের অথবা বাবা-মা, ঠাকুরদা-ঠাকুরমার নাম আছে, তাঁদের ক্ষেত্রে অন্য কোনও নথি দেওয়ার প্রয়োজন নেই। অভিযোগ ও আশঙ্কা দেখা দিতে শুরু করেছে, এই নিয়মের ‘সুযোগ’ নেওয়ার জন্য ভুল নাম ব্যবহার করে বংশানুক্রমিক মিল দেখানোর চেষ্টা হচ্ছে। রাজ্যের বেশ কিছু বিধানসভা কেন্দ্রে (বিজেপির অভিযোগ, মূলত সংখ্যালঘু-অধ্যুষিত এলাকায়) এই বংশগত মিলের হার বেড়ে গিয়েছে। প্রশাসনিক সূত্রের মতে, ‘ভুয়ো’ ভোটারের অন্তর্ভুক্তি ঠেকাতে এই ক্ষেত্রে বাড়তি যাচাইয়ের পথে যেতে চাইছে কমিশন।

কমিশন তথা সিইও দফতরের নির্দেশিকা অনুযায়ী: এক), রাজ্যে ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় নাম ছিল বলে যাঁরা গণনা-পত্রে জানিয়েছেন, সেই সময়ে তাঁদের বয়স ৬০ বছর বা তার বেশি ছিল কি না, দেখতে হবে। দুই), ২০০২ সালের তালিকায় বাবা-মা বা ঠাকুরদার নাম ছিল এবং ২০২৫ সালে বয়স ৫০ বছর বা তার বেশি— এমন ভোটারদের ক্ষেত্রে বাড়তি নজর দিতে হবে। বয়স ২০০২ সালে ২৫ বছর বা তার বেশি হয়ে গেলেও তখন ভোটার তালিকায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নাম কেন ছিল না, জানতে হবে বুথ লেভল অফিসার (বিএলও), পরিদর্শক বা ইআরও (বিধানসভা ভিত্তিক আধিকারিক)-দের। তার জন্য প্রয়োজনে এলাকায় গিয়ে যাচাই করতে হবে। তিন) ২০২৫ সালের ২৮ অক্টোবরের পরে ভোটার তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের বাবা-মায়ের নাম সংক্রান্ত তথ্য যদি গণনা-পত্রে দেওয়া তথ্যের সঙ্গে না মেলে, তা হলে অনুসন্ধান হবে। চার), ২০০২ সালের তালিকায় উল্লিখিত বাবা-মায়ের সঙ্গে ভোটারের বয়সের ব্যবধান যদি ৪৫ বছরের বেশি বা ১৮ বছরের কম হয়, সে ক্ষেত্রেও যাচাই করতে হবে। পাঁচ), অনুপস্থিত যে ভোটারের জন্য গণনা-পত্রে পরিবারের অন্য কেউ সই করে দিয়েছেন, তাঁর ক্ষেত্রে বিএলও-কে ফোন করে বা বাড়ি গিয়ে খোঁজ নিতে হবে। জানতে হবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি অন্য কোথাও ভোটার তালিকায় নাম তুলেছেন কি না। ছয়), যে সব বুথে ‘প্রোজেনি ম্যাপিং’ বা বংশগত মিলের হার ৫০%-এর বেশি হয়েছে, সেখানে ধরে ধরে পর্যালোচনা করতে হবে। সাত), গত ২০২৪ ও ২০২১ সালের নির্বাচনে ‘স্পর্শকাতর’ তকমা পাওয়া বুথে বাড়তি নজর রাখতে হবে।

এরই পাশাপাশি, কমিশনের ‘বিএলও অ্যাপে’ ভুল তথ্য দেওয়া হয়ে গিয়েছে বলে ধরতে পারলে ইআরও এবং বিএলও-রা তা শুধরে নিতে পারবেন। ‘অনিচ্ছাকৃত’ ভাবে হয়ে যাওয়া ভুল সংশোধনের সুযোগ তাঁরা পাবেন। গণনা-পত্র পূরণের হিসেব অনুযায়ী, ষে সব বুথে মৃত বা স্থানান্তরিত ভোটারের সংখ্যা শূন্য থেকে ২০ পাওয়া যাচ্ছে, সেখানে বিএলও-দের দেওয়া তথ্য ঠিক কি না, বাড়তি যাচাই করতে হবে। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে ইআরও-দের উপরে নজর থাকবে। জন্ম-মৃত্যুর রেজিস্ট্রার এবং রেশন কার্ড বাতিলের তথ্য থেকে প্রয়োজনে মৃত ভোটার সংক্রান্ত তথ্য যাচাই করে নিতেও বলা হয়েছে ইআরও-দের।

প্রসঙ্গত, এসআইআর-এ বিশেষ তালিকা পর্যবেক্ষক সুব্রত গুপ্তের কাছে গিয়ে বিজেপি, সিপিএম ও কংগ্রেসের প্রতিনিধিরা ভোটার-তথ্য যাচাই নিয়ে বেশ কিছু দাবি জানিয়েছিলেন। কমিশনের কাছে প্রদেশ কংগ্রেসের তোলা কয়েকটি দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে যাচাই নির্দেশিকায়। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শুভঙ্কর সরকার অবশ্য বলছেন, ‘‘শুধু কাগজে-কলমে নির্দেশ দলে হবে না, বাস্তবে তার রূপায়ণই আসল কথা। যাচাই-সহ গোটা প্রক্রিয়া সুষ্ঠু ভাবে করার জন্যই আমরা এক মাস সময় বাড়ানোর দাবি করেছি।’’ সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীর মতে, ‘‘পুলিশ এবং সিভিক ভলান্টিয়ার দিয়ে যেমন তৃণমূল চলছে এখন, তেমনই নির্বাচনের সময়ে সেই দায়িত্ব পালনের চাপ দেওয়া হচ্ছে ইআরও-দের (অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিডিও)। তথ্য যাচাইয়ের এই নির্দেশিকায় ইআরও-দের উপরে নজর থাকবে। দলের তরফে আমাদেরও নজর থাকবে, বেআইনি বা অন্যায় কিছু করলে কেউ ছাড় পাবেন না!’’

বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী মঙ্গলবারও অভিযোগ করেছেন, এসআইআর-এ সব রকম ভাবে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করছে রাজ্য প্রশাসন। মালদহের ইং‌রেজবাজারে তিনি বলেছেন, ‘‘ভুয়ো ভোটার রেখে দেওয়ার জন্য বিএলও-দের সব থেকে বেশি চাপ দিয়েছেন বিডিও-রা, তৃণমূল নেতারা। ২২০৮টি বুথে ২৩ বছরে কেউ মারা যায়নি! একেবারে জালিয়াতি করে রেখেছে।’’ বিজেপির বিধায়কদের নিয়ে আজ, বুধবার ফের কমিশনে যাওয়ার কথা বিরোধী নেতার।

তৃণমূলের রাজ্য সহ-সভাপতি জয়প্রকাশ মজুমদার অবশ্য বলেছেন, ‘‘বয়স বা অন্য যে কোনও যোগ্যতা যাচাই করে ভোটাধিকার দেওয়ার দায়িত্ব কমিশনের। এ কাজ তাদেরই করতে হবে। আমরা চাইছি, সেই কাজ যে বিজেপির নির্দেশে হবে না, তা-ও নিশ্চিত করুক কমিশন।’’

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Election Commission BLO Special Intensive Revision

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy