তৃণমূল কংগ্রেসের তোলা একই এপিক নম্বরে একাধিক নাম সংক্রান্ত অভিযোগ কার্যত আগেই স্বীকার করেছিল নির্বাচন কমিশন। আজ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তারা জানাল, ত্রুটিপূর্ণ ভোটার কার্ডের ব্যাপারে তিন মাসের মধ্যে যথাযথ পদক্ষেপ করা হবে। তাতে সংশ্লিষ্ট ভোটারদের জাতীয় ইউনিক নম্বর দেবে কমিশন। তাদের সিদ্ধান্ত, আগামী দিনে নতুন ভোটারদের জন্য জাতীয় ইউনিক নম্বর চালু হবে দেশ জুড়ে। কমিশনের এই পদক্ষেপকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নৈতিক জয়’ হিসেবে দেখছে তৃণমূল।
‘ভূতুড়ে ভোটার’ নিয়ে গত কয়েক দিন ধরে সরগরম জাতীয় রাজনীতি। অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগকে কেন্দ্র করে বিতর্ক চলছে। আজ তৃণমূল, এসপি, উদ্ধবপন্থী শিবসেনা, আপ-এর মতো দলগুলির সাংসদরা ঝাঁকে ঝাঁকে নোটিস জমা দিয়েছেন, সোমবার সংসদের বাজেট অধিবেশেনের দ্বিতীয়ার্ধের প্রথম দিন এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য। সেই আবহেই কমিশন জানাল, ‘ডুপ্লিকেট’ এপিক নম্বরের সমস্যা সমাধান করা হবে। ‘ডুপ্লিকেট’ এপিক নম্বরের ভোটারদের ইউনিক এপিক নম্বর দেবে কমিশন। ভবিষ্যতে সকল ভোটারের জন্যই ইউনিক এপিক নম্বর পদ্ধতি চালু করা হবে। বিরোধীদের দাবি, অর্থাৎ, গোলমালের কথা কমিশন প্রকারান্তরে মেনে নিল।
তবে ত্রুটি মেনে নিয়েও কমিশন জানাচ্ছে, চব্বিশের অগস্ট থেকে পঁচিশের জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে সংশোধিত ভোটার তালিকা তৈরির কাজ চলেছে। সে সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বুথ প্রতিনিধিদের সঙ্গেও এই প্রক্রিয়াকে সংযুক্ত করা হয়েছিল। একটি তালিকা প্রকাশ করে দেখানো হচ্ছে, একমাত্র মহারাষ্ট্র ছাড়া কোনও রাজ্যের কোনও দলের বুথ এজেন্টের কাছ থেকে ভোটার তালিকায় অসমাঞ্জস্যের কোনও আবেদন বা অভিযোগ আসেনি।
সম্প্রতি কিছু ক্ষেত্রে ভোটার কার্ডে থাকা নম্বরের প্রথম তিনটি অক্ষরের ‘সিরিজ়’ এবং তার সঙ্গে জুড়ে থাকা নম্বর কয়েকটি রাজ্যের সঙ্গে এক হয়ে যাওয়ায় উদাহরণ মিলেছে। এই বিতর্কের আবহে জেলায় জেলায় এমন নম্বরের তালিকা তৈরি করতে শুরু করেন নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত জেলাস্তরের আধিকারিকেরা। কমিশন এ দিন তাদের লিখিত বার্তায় জানিয়েছে, ভোটার নম্বর যা-ই থাকুক, ভোটার তালিকায় নাম থাকা ভোটারেরা নিজের এলাকায় ভোট দিতেই পারবেন। যদিও বিরোধীদের এখনও বক্তব্য, ওই নম্বর যদি অন্য রাজ্যের অন্য কোনও ভোটারের নম্বরের সঙ্গে এক হয়ে যায় এবং সেই ভোটারের ছবি থাকে তালিকায়, তা হলে এ রাজ্যের ভোটারের ভোটদান আটকে দেওয়া হতেই পারে।
সমীক্ষা করে কমিশনের দাবি, একশোর বেশি এমন ভোটারের নম্বর এক হয়েছে। তবে তাঁরা ন্যায্য ভোটার। নির্বাচন সদনের বক্তব্য, ২০০০ সালে নতুন কার্ড দেওয়ার সময় কয়েকটি রাজ্যে সঠিক ‘সিরিজ়’ ব্যবহার করা হয়নি। তাই সমস্যা তৈরি হয়েছে। এ বারে সেই সমস্ত ভোটারকে জাতীয় ইউনিক ভোটার কার্ড নম্বর দেওয়া হবে। এখন সারা বছরই ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজ হয়। নতুন ভোটারদের ক্ষেত্রেও দেওয়া হবে এই নম্বরই। ফলে আগামী তিন মাসের মধ্যে এই কাজ সেরে ফেলা হবে বলে আশ্বাস কমিশনের।
এরই পাশাপাশি কমিশনের নির্দেশ, সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে থেকেই প্রতি বুথ এলাকায় বিএলও নিয়োগ করবেন ইলেক্টোরাল রেজিস্ট্রেশন অফিসার বা ইআরও। এই বিধি আগেও ছিল। কিন্তু বিরোধীদের বরাবরের অভিযোগ, সেখানে আশা এবং চুক্তিভিত্তিক কর্মীদেরও নিয়োগ করা হচ্ছে। প্রতি বুথে বুথস্তরের এজেন্ট (বিএলএ) নিয়োগ করতে রাজনৈতিক দলগুলিকে জানিয়েছে কমিশন। তারা ভোটার তালিকা সংশোধন সংক্রান্ত ব্যাপারে খোঁজখবর রাখতে পারবে। এই প্রথাও দীর্ঘদিনের। ভোটার তালিকা নিয়ে যে রাজনৈতিক বিতর্ক তৈরি হয়েছে, তাতে বিএলএ-রাও যে দায়িত্ব এড়াতে পারেন না, তা মনে করিয়ে দিচ্ছেন আধিকারিকদের একাংশ।
অন্য দিকে, তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ সকেত গোখলে তথা দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ‘একটি দুর্বল ব্যাখ্যা দেওয়ার পর, অবশেষে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন ভোটার তালিকায় কারচুপির বিষয়টি স্বীকার করেছে। এখন, শেষ মুহূর্তে ভুল শোধরাতে চেয়ে, তারা নাকি দাবি করেছে, মাত্র ৩ মাসের মধ্যেই এই সমস্যার সমাধান করবে।’ তৃণমূলের দাবি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উদ্যোগী হওয়াতেই এটা সম্ভব হয়েছে। একই সঙ্গে তাদের বক্তব্য, ‘আসল প্রশ্নগুলো এখনও রয়ে গিয়েছে। এক, কী ভাবে এপিক নম্বরের একটি ‘ভুল সিরিজ’ বেরিয়ে এল? দুই, নকল এপিক শনাক্ত করার জন্য যে সফটওয়্যারটি ছিল, সেটির কী হল? তিন, ২০০০ সাল থেকে যদি এই সমস্যা চলে আসছে, তবে ২৫ বছর ধরে কিছুই করা হয়নি কেন? নকল ভোটার আইডি সম্পর্কে নির্বাচন কমিশন এখনও নীরব কেন?’ তৃণমূলের অভিযোগ, ‘‘নির্বাচন কমিশন শুধু তার দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়নি, বরং এটি বিজেপির নির্বাচনী কারচুপির একান্ত সহায়ক হয়ে উঠেছে।”
তৃণমূলের রাজ্যসভার নেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন এ দিন বলেন, “সমস্ত বিরোধী দল সমবেতভাবে আলোচনা করেই এই বিষয়ে আলোচনার জন্য সংসদের দুই কক্ষে নোটিস দিয়েছে। এটা দেশের নাগরিকদের সমস্যা। সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন না হওয়ার সমস্যা।” তবে অন্য বিরোধী দলগুলি নোটিস দিলেও কংগ্রেস এখনও এ ব্যাপারে নোটিস জমা দেয়নি। দলের বক্তব্য, বাজেট অধিবেশনের প্রথমার্ধে রাষ্ট্রপতির বক্তৃতা নিয়ে আলোচনায় প্রসঙ্গটি তুলেছিলেন রাহুল গান্ধী। এ বার তা তোলা হবে। সোমবার সন্ধ্যায় কংগ্রেসের স্ট্র্যাটেজিক গ্রুপের বৈঠক ডাকা হয়েছে। সেখানেও এই নিয়ে আলোচনা হবে। আজ কংগ্রেসের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, কমিশন বিবৃতির আড়ালে গা ঢাকা দিলেও মানতে বাধ্য হয়েছে যে, ভোটার তালিকা বিশ্বাসযোগ্য নয়, তাতে অনেক গরমিল রয়েছে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)