Advertisement
E-Paper

দু’বছরেও বিচার হল না, কামদুনি সেই কামদুনিতে

তারিখটা এক। মাঝখানে শুধু পেরিয়ে গিয়েছে দু’টো বছর। রবিবারের এই চড়া রোদ দু’বছর আগের ৭ জুনে ছিল না। উত্তর ২৪ পরগনার এই জনপদে অঝোরে বৃষ্টি পড়ছিল সে দিন। ভরদুপুরেও ঠাহর করা যাচ্ছিল না অল্প দূরের মানুষকে। রাস্তায় লোকজনও ছিল কম। সেই সুযোগ নিয়েই কলেজ ফেরতা মেয়েটিকে উঁচু পাঁচিলের ঘেরাটোপে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে খুন করেছিল দুষ্কৃতীরা।

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য ও সীমান্ত মৈত্র

শেষ আপডেট: ০৮ জুন ২০১৫ ০৪:২৬
কামদুনির নিহত তরুণীর উদ্দেশে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন মৌসুমী কয়াল, টুম্পা কয়াল, লকেট চট্টোপাধ্যায়, শমীক ভট্টাচার্য প্রমুখ। রবিবার কামদুনিতে সুদীপ ঘোষের তোলা ছবি।

কামদুনির নিহত তরুণীর উদ্দেশে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন মৌসুমী কয়াল, টুম্পা কয়াল, লকেট চট্টোপাধ্যায়, শমীক ভট্টাচার্য প্রমুখ। রবিবার কামদুনিতে সুদীপ ঘোষের তোলা ছবি।

তারিখটা এক। মাঝখানে শুধু পেরিয়ে গিয়েছে দু’টো বছর।

রবিবারের এই চড়া রোদ দু’বছর আগের ৭ জুনে ছিল না। উত্তর ২৪ পরগনার এই জনপদে অঝোরে বৃষ্টি পড়ছিল সে দিন। ভরদুপুরেও ঠাহর করা যাচ্ছিল না অল্প দূরের মানুষকে। রাস্তায় লোকজনও ছিল কম। সেই সুযোগ নিয়েই কলেজ ফেরতা মেয়েটিকে উঁচু পাঁচিলের ঘেরাটোপে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে খুন করেছিল দুষ্কৃতীরা।

প্রতিবাদ আন্দোলনের প্রথম সারিতে থাকা স্থানীয় গৃহবধূ মৌসুমী কয়াল ভেজা চোখে বললেন, ‘‘সে দিন যদি আজকের মতো এত রোদ, এত আলো থাকত, তা হলে বোধ হয়...।’’

কাঁদছিলেন টুম্পা কয়ালও, প্রতিবাদের আর এক মুখ। ঘটনার দশ দিন পর কামদুনিতে আসা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মূলত টুম্পার ক্ষোভের মুখে পড়েই ওঁদের ‘মাওবাদী’ তকমা দিয়েছিলেন। নিহত ছাত্রীটি ছিলেন টুম্পার ছোটবেলার বন্ধু। বন্ধুর স্মরণে বেদীতে মালা দিয়ে টুম্পা এ দিন বললেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী আমাদের সিপিএম, মাওবাদী বললেন। আবার এও বলে গেলেন, পনেরো দিনের মধ্যে চার্জশিট, এক মাসের মধ্যে বিচার হবে। দু’বছর তো পেরিয়ে গেল, কামদুনির দোষীরা শাস্তি পেল কোথায়?’’

শুধু দোষীদের শাস্তি তো নয়, কামদুনির মানুষের আরও অনেক দাবিই এই দু’বছরে পূরণ হয়নি। ঘটনার পর শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীরা কামদুনির মাটিতে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেছিলেন, গ্রামের রাস্তায় আলো জ্বলবে। রাস্তা হবে ঝাঁ-চকচকে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তৈরি হবে আস্ত পুলিশ ফাঁড়ি।

কিন্তু বাস্তবে কী হয়েছে?

বারাসত থানা ভেঙে আরও তিনটি নতুন থানা হয়েছে বটে— মধ্যমগ্রাম, শাসন ও দত্তপুকুর। কামদুনি এখন শাসন থানার মধ্যে পড়ে। কিন্তু কামদুনিতে প্রতিশ্রুত পুলিশ ফাঁড়ি হয়নি। স্থানীয় স্কুলঘরে চার জন পুলিশ নিয়ে একটি অস্থায়ী ক্যাম্প বসেছে কেবল। গ্রা়মের পথে বিদ্যুতের খুঁটি বসেছে, ঝুলছে তার। কিন্তু আলো জ্বলেনি। ইট-পাথর উঠে গিয়ে কঙ্কালের চেহারা নিয়েছে গোটা রাস্তাটা। ভরে উঠেছে খানাখন্দে। বর্ষায় সেগুলো ছোটখাটো ডোবার চেহারা নেয়। বিডিও অফিস থেকে গ্রামের মধ্যে দিয়ে কামদুনি মোড় পর্যন্ত সাড়ে চার কিলোমিটার রাস্তার গোটাটাই আজও গাড়ি চলাচলের অযোগ্য।

সকাল দশটার ঝাঁ ঝাঁ রোদে নিহত ছাত্রীর স্মৃতিবেদীর সামনে তাই দু’বছর পরেও শ’দুয়েক মানুষের ভিড়। কামদুনি প্রতিবাদী মঞ্চ এ দিন মিছিল করার অনুমতি পায়নি। তাই শুধু বেদীতেই মালা দেওয়া হল। মালা দিলেন রমলা চক্রবর্তী, অপর্ণা গুপ্ত, ভারতী মুৎসুদ্দির নেতৃত্বে সিপিএমের মহিলা সমিতির সদস্যেরা। বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য, নেত্রী লকেট চট্টোপাধ্যায়।

নিহত সেই ছাত্রীর পরিবার এখান থেকে চলে গিয়েছেন দশ কিলোমিটার দূরে, বহিরা কালীবাড়ি তল্লাটে। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে ওই পরিবারকে দেওয়া হয়েছে আর্থিক ক্ষতিপূরণ, দেওয়া হয়েছে চাকরিও। তার পর থেকে ওই পরিবার তেমন ভাবে আর আন্দোলনে সামিল হয়নি। শাসক দলের তত্ত্বাবধানে তৈরি প্রতিবাদী মঞ্চের পাল্টা সংগঠন শান্তিরক্ষা কমিটি জানিয়েছিল, বিকেলে তাদের মিছিলে থাকবেন ছাত্রীর বাড়ির লোকেরা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁরা ওই মিছিলেও আসেননি। যোগাযোগ করা হলে ছাত্রীর বাবা বলেন, ‘‘আমরা অসুস্থ। তাই যেতে পারিনি। আর গিয়েই বা কী হবে!’’

হতাশার সুর চাপা থাকে না তাঁর গলায়। চাকরি-ক্ষতিপূরণের প্রলেপ ভুলিয়ে দেয় না মেয়ে হারানোর জ্বালা। দ্রুত বিচারের আশ্বাস পূরণ হয়নি যে! এখনও শেষ হয়নি সাক্ষ্যগ্রহণ পর্ব। ছাত্রীর ভাই বলছিলেন, ‘‘আমার মা-বাবা রোজ এখনও কাঁদেন। দোষীদের শাস্তির অপেক্ষায় কাঁদতে কাঁদতে মা-বাবা হয়তো মারাই যাবেন।’’ শান্তিরক্ষা কমিটির সদস্যেরা যথারীতি মিছিল করেন, বেদীতে মালা দেন। কিন্তু হতাশা কি গ্রাস করেনি তাঁদেরও? কমিটির সম্পাদক সোনা ঘোষের কথায় কিন্তু তেমনই ইঙ্গিত। বললেন, ‘‘প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ তো হয়নি। এ রকম চললে আমাদেরও অন্য কিছু ভাবতে হবে।’’

প্রতিশ্রুতি কেন রক্ষা করা হল না? সরাসরি জবাব না দিয়ে রাজ্যের মন্ত্রী তথা তৃণমূলের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বললেন, ‘‘কামদুনির মানুষকে দু’টাকা কেজি দরে চাল দেওয়া হচ্ছে। গ্রামের চারটি ক্লাবকে আর্থিক সাহায্য করা হয়েছে। গ্রামের রাস্তায় ম্যাজিক গাড়ি চলছে।’’ এ সব যে হয়েছে, কামদুনি তা অস্বীকার করছে না। কিন্তু দু’বছর আগের সেই আতঙ্কের স্মৃতি বয়ে নিয়ে চলা রাস্তা দিয়ে আজও স্কুল-কলেজ ফেরতা মেয়েদের একা ছাড়তে ভরসা পান না অভিভাবকেরা।

তারিখটা এক। কামদুনি আছে কামদুনিতেই।

arunaksha bhattacharya simanta maitra abpnewsletters kamduni justice kamduni deprived tumpa kayal kamduni unrest kamduni wants justice
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy