E-Paper

নাম-ঠিকানা তো বটেই, টাকা দিলে মিলছে সইও

ব্যক্তিগত ছবি থেকে নথি— বেহাত হয়ে যাচ্ছে সবই। সে সব ব্যবহার করেই ছড়াচ্ছে অপরাধের জাল। অন্ধকার সেই পথের খোঁজ নিল আনন্দবাজার।

নীলোৎপল বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ৩১ মে ২০২৫ ০৮:৩৮
নাম, ফোন নম্বর, ইমেল ধরে ফোন করে এর পরে বিমা নবীকরণের নামে প্রতারণার ফাঁদ পাতা হয়।

নাম, ফোন নম্বর, ইমেল ধরে ফোন করে এর পরে বিমা নবীকরণের নামে প্রতারণার ফাঁদ পাতা হয়। —প্রতীকী চিত্র।

ভিন‌্‌ রাজ্যের পুলিশের সূত্রে এই রাজ্যের বেশ কয়েকটি ঠিকানা পেয়েছিল কলকাতা পুলিশ। ওই সব ঠিকানায় বাস করা লোকজনই নাকি দেশ জুড়ে গত কয়েক মাসে ঘটে যাওয়া একাধিক আর্থিক প্রতারণা এবং ‘ডিজিটাল গ্রেফতারি’র কথা বলে টাকা হাতানোর ঘটনার মূল চক্রী! অথচ, তদন্তে নেমে এই রাজ্যের পুলিশ দেখে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রায় কারওরই পুরনো অপরাধের রেকর্ড নেই। তাঁরাই যে অপরাধ করেছেন, তার তেমন সূত্রও মিলছে না। কয়েক জন আবার বয়সজনিত কারণে ভাল করে চলাফেরাও করতে পারেন না! তা হলে তাঁরা অপরাধ ঘটালেন কী করে?

তদন্ত চালিয়ে এর পরে পুলিশ দেখে, গত এক বছরের মধ্যে শহরের কাছাকাছি একটি রিসর্টে এঁরা প্রত্যেকেই গিয়েছিলেন। কেউ ছুটি কাটাতে, কেউ বয়স্ক বাবা-মায়ের বিবাহবার্ষিকী উদ্‌যাপন করতে। কিন্তু অপরাধের সঙ্গে সংযোগ ঘটল কী করে? লালবাজারের সাইবার শাখার এক পুলিশকর্তা বলেন, ‘‘ওই রিসর্টে নিজেদের পরিচয়পত্র জমা দিয়েছিলেন ওঁরা। রিসর্টের আধুনিক ব্যবস্থায় রিসেপশনেই তাঁদের কয়েক সেকেন্ডের ভিডিয়ো এবং ছবি তুলে রাখা হয়। এর পরে সেই সব নথি, অতিথিদের ব্যক্তিগত তথ্যের ডেটা বেস বিক্রি করে দেওয়া হয়। নানা হাত ঘুরে সে সব কত দূরে পৌঁছেছে, তার তল এখনও আমরা পাইনি। তবে, শুধু এই একটি রিসর্টেরই ব্যাপার নয়। দেশ জুড়ে লক্ষ লক্ষ হোটেল, রিসর্ট, শপিং মল থেকে এই ভাবে সাধারণ মানুষের তথ্য কেনা হয়েছে গত কয়েক বছরে। সব মিলিয়ে চুরি করা তথ্যের এক বিরাট ভান্ডার তৈরি হয়েছে।’’

অভিযোগ, দেশ জুড়েই ব্যক্তিগত তথ্য লেনদেনের কারবার এই মুহূর্তে রমরমিয়ে চলছে। যেখানে শুধু মোবাইল নম্বর বা ঠিকানাই নয়, টাকা দিতে পারলে মিলে যায় কারও ইমেল আইডি, আধার বা ভোটার কার্ডের নম্বরও। এমনকি, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বাৎসরিক কত আয়ের শ্রেণিতে পড়েন বা তাঁর বিমা করানো রয়েছে কিনা এবং সেটির নমিনিই বা কে, সেই তথ্যও সহজলভ্য! ব্যক্তিগত তথ্য বিক্রির এই বাজারে নামের পাশাপাশি সই-ও বিক্রি হয় বলে অভিযোগ। একটি ডাচ সাইবার নিরাপত্তা সংস্থা দাবি করেছে, সমীক্ষা চালিয়ে তারা দেখেছে, তথ্য চুরির অভিযোগের নিরিখে ভারত এই মুহূর্তে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে। কিছু দিন আগে এই পথেই এমপ্লয়িজ় প্রভিডেন্ট ফান্ডের তথ্যও খোলা বাজারে চলে এসেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। দিনকয়েক আগেই আবার হরিয়ানা পুলিশ একটি ভুয়ো কল সেন্টারের মাথাদের গ্রেফতার করে সামনে আনে চাঞ্চল্যকর তথ্য। সেখানে প্রতারণার কাজে মাত্র ১৫ হাজার টাকার বিনিময়ে তথ্যের ভান্ডার তুলে দিয়েছিল একটি এমনই তথ্য প্রদানকারী সংস্থা, যার ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর বলিউডের প্রবীণ এক অভিনেতা। ওই সংস্থার সার্চ ইঞ্জিনের মাধ্যমে বিমার খোঁজ করা ব্যক্তিদের তালিকা তৈরি হয়েছিল। সেই নাম, ফোন নম্বর, ইমেল ধরে ফোন করে এর পরে বিমা নবীকরণের নামে প্রতারণার ফাঁদ পাতা হয়। সাধারণ ভাবে গুগলে কোনও দোকান খুঁজতে সার্চ করলে বড় সংস্থা সম্পর্কে তথ্য মেলে। কিন্তু এই সার্চ ইঞ্জিন স্থানীয় দোকানও দেখায়। সেই দোকান সম্পর্কে জানতে যিনি খুঁজছেন, তাঁর ব্যক্তিগত তথ্য ওই সার্চ ইঞ্জিনের সাইটে দিতে হয়। এই ভাবেই কোটি কোটি গ্রাহকের তথ্য ওই সংস্থার মাধ্যমে বেহাত হয়ে গিয়েছে বলে তদন্তকারীদের দাবি।

এই পরিস্থিতিতে মানুষের সচেতনতার উপরেই জোর দিচ্ছে পুলিশ। তাদের দাবি, এই কারণেই ‘ন্যাশনাল সাইবার ক্রাইম রিপোর্টিং পোর্টাল’ আর টোল-ফ্রি ১৯৩০ নম্বর চালু করা হয়েছে। একটি ইন্ডিয়ান সাইবার ক্রাইম কোঅর্ডিনেশন সেন্টারও তৈরি করা হয়েছে। থানার পাশাপাশি পোর্টালে ঢুকে বা ফোন নম্বরে ফোন করে অভিযোগ দায়ের করতে হয়। এর পরে যে জেনারেল ডায়েরি (জিডি) হল, তার নম্বর নিয়ে ব্যাঙ্ক বা সংশ্লিষ্ট সংস্থায় গিয়ে অভিযোগ করতে হয়। গড়িমসি হচ্ছে বুঝলে আদালতের দ্বারস্থ হয়ে মামলা করে দ্রুত অর্ডার বার করানোরও পরামর্শ দিচ্ছেন সাইবার বিশেষজ্ঞেরা। কিন্তু সকলের কি এ ভাবে অর্ডার বার করানোর সামর্থ্য থাকে? স্পষ্ট উত্তর মেলে না।

(শেষ)

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

police investigation Documents

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy