বৃষ্টি কবে, মেঘের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষায় কৃষক। দেগঙ্গায় সজল চট্টোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।
বর্ষা বলতে বোঝায় কালো মেঘে ঢাকা আকাশ। বর্ষা বলতে বোঝায় হুড়মুড়িয়ে আকাশভাঙা বৃষ্টি। টানা আধ ঘণ্টা থেকে পৌনে এক ঘণ্টার বৃষ্টিতে জলে থইথই লোকালয়। কিন্তু এ বছর সেই বৃষ্টিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! শেষ ভাগে ঢলে পড়েছে শ্রাবণ। তবুও না!
মাঝেমধ্যে বৃষ্টি যে না হচ্ছে, তা নয়। হচ্ছে। হাওয়া অফিসের তথ্যও বলছে, গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে বর্ষা ক্রমশ স্বাভাবিকের কাছে পৌঁছচ্ছে। তবু এ বছর বর্ষার কেমন যেন ছন্নছাড়া মেজাজ! আর সেই ম্লান মেজাজে সিঁদুরে মেঘ দেখছেন চাষিরা।
চলতি মরসুমে কলকাতায় তবু কয়েক দিন দু’-এক পশলা ভারী বৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু দক্ষিণবঙ্গের অন্য জেলাগুলির কপাল খারাপ। নিয়মিত বৃষ্টি হচ্ছে বটে, কিন্তু সেটা ম্যাদামারা বৃষ্টি। ভারী বৃষ্টি না-হওয়ায় মাঠে জল দাঁড়াচ্ছে না। মিনমিন করে যেটুকু বৃষ্টি পড়ছে, সটান তা টেনে নিচ্ছে মাটি। চাষিরা বলছেন, বীজতলা থেকে ধানের চারা তুলে মাঠে পোঁতা হয়ে গিয়েছে। এই মোক্ষম সময়ে মাঠে চাই স্থায়ী ভাবে জমা জল। কিন্তু সেই জল না-জমায় বেজায় সমস্যায় পড়তে হচ্ছে তাঁদের। ভরা বর্ষাতেও অনেক কৃষককেই শ্যালো পাম্প চালিয়ে জল জোগাতে হচ্ছে ধানের খেতে।
কৃষি দফতর সূত্রের খবর, বৃষ্টির কৃপণতায় উদ্ভূত প্রতিকূল পরিবেশ নিয়ে শুক্রবার উত্তর ২৪ পরগনা জেলা কৃষি দফতরে একটি বৈঠক হয়। বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আনন্দময় পুস্তি বলছেন, ‘‘আমন ধানের চারা পুষ্ট হওয়ার জন্য এই সময়ে মাঠে জল দাঁড়ানো দরকার। নইলে ধানের ফলন মার খেতে পারে।’’ কৃষিবিজ্ঞানীদের কেউ কেউ আবার বলছেন, বর্ষাকালে সেচের জন্য ভূগর্ভের জল তেমন লাগে না। বরং এই সময়ে ভূগর্ভে জল সঞ্চয় হয়। শুখা মরসুমে সেই সঞ্চিত জলেই চলে সেচের কাজ। কিন্তু এ বার যদি ভরা বর্ষাতেও ভূগর্ভের ভাঁড়ারে হাত পড়ে, তা হলে ভূগর্ভস্থ জলস্তর তো ক্ষতিগ্রস্ত হবেই। সেই সঙ্গে মাটির তলা থেকে বেশি জল তুলে ফেললে উত্তর ২৪ পরগনা, নদিয়া-সহ বিভিন্ন জেলায় বাড়তে পারে আর্সেনিকের প্রকোপ।
বাঙালির কাছে ভরা শ্রাবণ আর ভর বর্ষা সমার্থক। কিন্তু এ বার ভরা শ্রাবণেও বর্ষা এ বার সাবালক হল না কেন, সেই প্রশ্ন তুলছেন অনেকে।
আবহবিজ্ঞানীদের অনেকেই অবশ্য খাতায়-কলমে বৃষ্টির পরিমাণ দেখিয়ে বলছেন, জুনের শেষে যে-ঘাটতি ছিল, ক্রমশ তা কাটিয়ে উঠছে দক্ষিণবঙ্গ-সহ গোটা পূর্ব ভারত। ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানু’র প্রভাবে এ বার দেশে বর্ষা এসেছে দেরিতে। স্বাভাবিক নির্ঘণ্ট অনুযায়ী দক্ষিণবঙ্গে তার পৌঁছনোর কথা ৮ জুন। কিন্তু সে পৌঁছেছে ১৭ জুন। ফলে জুনে বৃষ্টির ঘাটতি ছিল অনেকটাই। তবে জুলাই থেকেই তার দাপট বাড়ে। তাই বর্ষার চেনা একটানা বৃষ্টি বিশেষ না-হলেও বর্ষণের ঘাটতি মিটেছে অনেকটা। মৌসম ভবনের তথ্য বলছে, ১ জুন থেকে ৩ অগস্ট পর্যন্ত হিসেব, গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে বর্ষার ঘাটতি মাত্র ছয শতাংশে এসে ঠেকেছে।
কিন্তু এটা হল অঙ্কের হিসেব। মাঠে নেমে যাঁরা বৃষ্টির সহযোগিতা আশা করেন, সেই চাষিরা এ বার বড্ড হতাশ। বিশেষ করে দক্ষিণবঙ্গে। তাঁদের প্রশ্ন, মাঠে জল জমতে তো দেখাই যাচ্ছে না। তা হলে খাতায়-কলমে ঘাটতি মিটল কি না, সেই হিসেবে হবেটা কী? ধানখেতে জল জমবে, এমন টানা বৃষ্টি হবে কবে?
‘‘টানা বৃষ্টির জন্য জোরালো নিম্নচাপ প্রয়োজন। তার অভাবেই এ বার একটানা বৃষ্টি হচ্ছে না,’’ বলছেন কেন্দ্রীয় আবহাওয়া দফতরের ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল (পূর্বাঞ্চল) গোকুলচন্দ্র দেবনাথ। আবহবিদদের একাংশ বলছেন, মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে বঙ্গোপসাগরে জন্ম নেওয়া ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর প্রভাবেই বর্ষার মতিগতি বিগড়ে গিয়েছে। সেই জন্যই নিম্নচাপ বা ঘূর্ণাবর্ত সে-ভাবে দানা বাঁধতে পারছে না। এবং তার ফলেই বর্ষা এখনও প্রাপ্তবয়স্ক হয়নি।
অগস্টের তো পাঁচ দিন কেটে গেল। এ বার কি বর্ষা নিজের ছন্দ খুঁজে পাবে, আকুল প্রশ্ন চাষিদের।
নিশ্চিত আশ্বাস দিতে পারছেন ন। তবে আশাও একেবারে ছেড়ে দিচ্ছেন না আবহবিদেরা। আবহাওয়া দফতরের খবর, ওড়িশা এবং লাগোয়া গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের উপরে এখন একটি নিম্নচাপ রয়েছে। তার প্রভাবে কমবেশি বৃষ্টিও হচ্ছে এখানে-সেখানে। বঙ্গোপসাগরে ফের একটি নিম্নচাপ তৈরির ইঙ্গিতও মিলছে। সেই নিম্নচাপের হাত ধরে বর্ষা চেনা ছন্দে ফেরে কি না, সেটাই দেখার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy