Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

আয়েশা নির্যাতনে পাকড়াও মূল অভিযুক্ত

কোনও ছবিই ছিল না তার। তার উপরে ঘনঘন মোবাইল নম্বর পাল্টে বা ফোনের সেট বদলে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল সে।এক বছরেরও বেশি সময় ধরে পুলিশকে এ ভাবে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরানোর পরে অবশেষে রাজ্য গোয়েন্দা পুলিশের জালে ধরা পড়ল শামিম ওরফে বাবু।

দীক্ষা ভুঁইয়া
কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ জুন ২০১৬ ০৯:১৯
Share: Save:

কোনও ছবিই ছিল না তার। তার উপরে ঘনঘন মোবাইল নম্বর পাল্টে বা ফোনের সেট বদলে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল সে।

এক বছরেরও বেশি সময় ধরে পুলিশকে এ ভাবে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরানোর পরে অবশেষে রাজ্য গোয়েন্দা পুলিশের জালে ধরা পড়ল শামিম ওরফে বাবু। মগরাহাটের কিশোরী আয়েশা (নাম পরিবর্তিত)-কে অপহরণ, পাচার ও গণধর্ষণের মামলায় মূল অভিযুক্ত বাবুকে শনিবার দুপুরে দক্ষিণ ২৪ পরগনার মগরাহাট বাজারে গ্রেফতার করেন গোয়েন্দারা। বয়স তার ১৯-২০। মাঝারি গড়ন। এই সদ্য-যুবকই দক্ষিণ ২৪ পরগনা জুড়ে সক্রিয় নাবালিকা পাচার চক্রের অন্যতম মাথা হয়ে উঠেছিল বলে জানান তদন্তকারীরা।

সিআইডি সূত্রের খবর, ২০১৪-র ডিসেম্বরে দাদা-বৌদির সঙ্গে ডায়মন্ড হারবার হাসপাতালে গিয়ে আয়েশা অপহৃত হয় বলে অভিযোগ। সেই ঘটনায় মূল অভিযুক্ত হিসেবে উঠে আসে বাবুর নাম। সে আয়েশাকে দিল্লিতে নিয়ে গিয়ে আসলাম ওরফে জব্বার নামে এক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে দেয়। সেই আসলাম তাকে বছরখানেক ধরে ধর্ষণ করে। তার উপরে মেয়েটিকে নিয়ে দিল্লি, হিমাচলপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড-সহ বিভিন্ন রাজ্যে ঘুরে ঘুরে তাকে দিয়ে যৌন ব্যবসা চালায় বলে অভিযোগ। শেষমেশ অসুস্থ ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় গাজিয়াবাদের এক হাসপাতালে আয়েশার হদিস পায় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। দেখা যায়, মেয়েটি এইচআইভি পজিটিভেও আক্রান্ত। নাবালিকা আয়েশার জীবনের এই দুর্গতির জন্য বাবুই আসলে দায়ী বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা।

বাংলার ওই কিশোরীর দুর্দশায় চমকে উঠেছিলেন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মী এবং দিল্লির হাসপাতালের চিকিৎসকেরাও। ডাক্তারদের ধারণা, লাগাতার ধর্ষিত হতে হতে কোনও ধর্ষকের কাছ থেকেই তার শরীরে মারণ রোগ এইচআইভি-র সংক্রমণ ঘটে। আর কোনও কাজে লাগবে না বুঝেই দুষ্কৃতীরা তাকে ফেলে পালায়। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার দৌলতে এবং হাসপাতালের পরিচর্যায় মেয়েটি মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে আসে। একটু সুস্থ হওয়ার পরে মেয়েটিকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। থানায় জানানো সত্ত্বেও বাংলার পুলিশ আয়েশা অন্তর্ধানের তদন্তে গা লাগায়নি বলে তার পরিবারের অভিযোগ। উত্তরপ্রদেশ পুলিশের বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট)-ও আয়েশার বাড়িতে এসে সব অভিযোগ শুনে প্রশ্ন তোলে, এমন একটি মামলায় বাংলার পুলিশ এবং গোয়েন্দারা এত উদাসীন থাকলেন কী করে? এক বছরে তাঁরা এক বারও মেয়েটির বাড়ি গিয়ে তদন্ত চালানোর কোনও তাগিদ দেখাননি বলে অভিযোগ।

মগরাহাট ও ডায়মন্ড হারবার থানার অফিসারেরা অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করে জানান, তাঁরা তদন্তের প্রয়োজনে সম্ভাব্য সব জায়গাতেই গিয়েছিলেন। কিন্তু গত নভেম্বরে আয়েশার পরিচয় জানাজানি হলেও বাবুকে ধরার কোনও সূত্রই বলতে গেলে সিআইডি-র হাতে ছিল না। আসলামকে অবশ্য আগেই গ্রেফতার করা হয়েছে। তার কাছ থেকে বাবুর একটি ফোন নম্বর মেলে। আসলাম ও আয়েশার দেওয়া বর্ণনার ভিত্তিতে বাবুর একটি ‘স্কেচ’-ও আঁকায় সিআইডি। ব্যস, ওইটুকুই। এর বেশি তদন্ত এগোয়নি মাসের পর মাস।

তদন্তকারীরা মনে করছেন, আয়েশা উদ্ধারের পরেই সতর্ক হয়ে গিয়েছিল বাবু। তাই সে ঘনঘন মোবাইল নম্বর ও সেট বদলাতে থাকে। সিআইডি-র এক অফিসার বলছিলেন, ‘‘আমরা এটা বুঝতে পারছিলাম যে, বাবু দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগর ও দক্ষিণ বারাসত এলাকার কাছাকাছি ঘুরঘুর করছে। কিন্তু সে ঠিক কোথায় আছে, সেই জায়গাটাকে কোনও মতেই চিহ্নিত করা যাচ্ছিল না।’’ সিআইডি সূত্রের খবর, বাবুর ফোনের একটি সিম ১৮-১৯টি মোবাইলে ব্যবহার করা হয়েছিল। ফলে মোবাইলের টাওয়ার্স অনুসরণ করেও তার অবস্থানস্থল চিহ্নিত করা মুশকিল হয়ে পড়ছিল।

শেষ পর্যন্ত ওই তল্লাটে বিভিন্ন ‘সোর্স’ই তাদের সাহায্য করেন বলে জানাচ্ছে সিআইডি। বাবুর ছবির স্কেচ দেখে তাকে চিনতে পারেন জয়নগরের এক জন। তবে তিনি বলেন, ‘বাবু নয়। ওই ছেলেটার নাম তো শামিম! এখানে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকত।’ শামিম নামটা তখন তদন্তকারীদের জানাই ছিল না। পরে নানা সূত্রের সাহায্যে পুলিশ নিশ্চিত হয়, শামিমই আসলে বাবু। খবর আসে, উস্তির এক অটোচালকের সঙ্গে বাবুকে দেখা গিয়েছে।

সেই অটোচালকের উপরে কয়েক দিন নজর রাখার পরে তাকে ব্যবহার করেই বাবুকে টোপ দেয় সিআইডি। মগরাহাট বাজারে শনিবার বিকেলে ডাকা হয় বাবুকে। সেখানেই তার যাবতীয় জারিজুরি গুঁড়িয়ে দিয়ে তাকে শ্রীঘরে পোরেন গোয়েন্দারা। বাবুকে জেরা করে গত দু’তিন বছরে দক্ষিণবঙ্গ থেকে পাচার হয়ে যাওয়া আরও কিছু নাবালিকার হদিস মিলতে পারে বলে গোয়েন্দাদের আশা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Teenager Trafficing police
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE