Advertisement
০১ মে ২০২৪
East Midnapore

করানো গেল না গর্ভপাত, জন্ম কন্যাসন্তানের

পরিচিত তিন কিশোরের গণধর্ষণের শিকার হয়েছিল বছর বারোর ওই নাবালিকা। নিয়মিত ধর্ষণের জেরে সে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে বলে অভিযোগ।

—প্রতীকী ছবি।

দিগন্ত মান্না
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৭:৫৮
Share: Save:

গর্ভপাত করানো গেল না। স্বাভাবিক প্রসব প্রক্রিয়ায় কলকাতার এক হাসপাতালে কন্যাসন্তানের জন্ম দিল পূর্ব মেদিনীপুরের প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দা গণধর্ষিতা নাবালিকা।

পরিচিত তিন কিশোরের গণধর্ষণের শিকার হয়েছিল বছর বারোর ওই নাবালিকা। নিয়মিত ধর্ষণের জেরে সে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে বলে অভিযোগ। পুলিশ নাবালক তিন অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে আদালতের নির্দেশে হোমে পাঠায়। ধর্ষিতা নাবালিকাকেও একটি হোমে রাখা হয়।

এত অল্পবয়সে মা হওয়ার শারীরিক ঝুঁকি, মানসিক ধাক্কা ও সামাজিক সমস্যার কথা ভেবে গর্ভপাতের আবেদন জানিয়ে কলকাতা হাই কোর্টের দ্বারস্থ হয় নাবালিকার পরিবার। দেশের আইন অনুযায়ী, ২৪ সপ্তাহের পরে গর্ভপাত করাতে হলে আদালতের অনুমতির প্রয়োজন। মেডিক্যাল বোর্ডের রিপোর্টের ভিত্তিতে গত ২১ অগস্ট কলকাতা হাই কোর্ট একটি নির্দিষ্ট হাসপাতালে নাবালিকার গর্ভপাত করানোর নির্দেশ দেয়।

কিন্তু তার পরেও কেন গর্ভপাত করানো গেল না?

চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, সাড়ে ছ’মাসে গর্ভস্থ ভ্রূণ প্রায় পূর্ণাঙ্গ সন্তানেরই রূপ নেয়। অনেক শিশু ছয়-সাড়ে ছয় মাসে জন্মও নেয়। ওই নাবালিকার ক্ষেত্রে সিজ়ার করে সাড়ে ছ’মাসের ভ্রূণ শরীর থেকে আলাদা করতে গেলে শারীরিক সঙ্কটের আশঙ্কা ছিল। নাবালিকার ভবিষ্যতের জন্যও তা ঠিক হত না। তাই আদালতের নির্দেশে গত ২২ অগস্ট নির্যাতিতাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলেও সেখানে তার সিজ়ার করা হয়নি। চিকিৎসকেরা স্বাভাবিক প্রসব প্রক্রিয়ার আশ্রয় নেন। এবং ২৪ অগস্ট ওই নাবালিকা ৯০০ গ্রাম ওজনের এক কন্যাসন্তানের জন্ম দেয়। যেহেতু নাবালিকার পরিবার গর্ভপাত করানোর দাবি জানিয়েছিল, তাই আইন অনুযায়ী, ওই সদ্যোজাতের অভিভাবক এখন রাজ্য সরকার। ঘটনার মূল অভিযুক্তকে চিহ্নিত করতে শিশুটির ডিএনএ পরীক্ষা করা হয়েছে। আপাতত শিশুটিকে ‘নিয়োনেটাল ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে’ রাখা হয়েছে। হাসপাতাল সূত্রের খবর, নাবালিকা ও শিশু সুস্থ রয়েছে। তবে গত শুক্রবার ওই নাবালিকাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। আপাতত তাকে একটি হোমে রাখা হয়েছে। নির্যাতিতার মা বলেন,"শিশুর কান্নার শব্দ শুনে খারাপ লাগছে। কিন্তু আমার মেয়ে যদি পরিণত হত এবং যদি সুস্থ ভালবাসার সম্পর্কের ফলে ওই সন্তান জন্মাত, তা হলে তাকে গ্রহণ করতাম। এখন আমাদের কিছু করার নেই। আইন মেনে ওই সন্তানকে কেউ গ্রহণ করলে আমাদের আপত্তি নেই।’’ শিশুর ডিএনএ পরীক্ষা নিয়ে তিনি বলেন, ‘‘তিন জন অভিযুক্তের মধ্যে শিশুর বাবা কে, সেটা জানতে চাই। তাতে বোঝা যাবে, মূল অভিযুক্ত কে। তবে অভিযুক্তদের সকলের চরম শাস্তি চাই।’’

নারী-শিশু ও মানবাধিকার আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত কর্মীদের অনেকেই এখন প্রশ্ন তুলেছেন, এই নাবালিকা এবং তার কন্যাসন্তানকে কতটা আগলে রাখবে সমাজ? অধ্যাপিকা তথা নারী অধিকার আন্দোলনের কর্মী শাশ্বতী ঘোষের কথায়, ‘‘এ রকম বহু কিশোরী প্রায় প্রতিদিন গা-গঞ্জ-শহরে একই রকম অত্যাচারের শিকার হয়ে মুখ লুকিয়ে হারিয়ে যায়। তাদের পরিবার ঘটনা গোপন করে হয়তো অন্য কোথাও তাকে সরিয়ে দেয় বা বিয়ে দিয়ে দেয়, বা তাকে পরিত্যাগ করে। এমনকি পরিবারের বা পাড়ার বা গ্রামের ‘সম্মানরক্ষায়’ ধর্ষণকারীকে বিয়ে করতেও বাধ্য করে। বিচার পাওয়ার পরিবর্তে অত্যাচার-পাচার-বারবার ধর্ষণের আবর্তে তলিয়ে যায় সেই সব কিশোরী। নাবালিকাদের সন্তানদের অনেকে দত্তক নেন, অনেকের আবার সেই সৌভাগ্য হয় না।’’

পূর্ব মেদিনীপুর জেলা শিশু সুরক্ষা অফিসার আলোক বেরা বলে, ‘‘নাবালিকার পরিবার গর্ভপাত করাতে চেয়েছিল। অর্থাৎ, নির্যাতিতার শরীর থেকে শিশুটিকে আলাদা করতে চেয়েছিল। চিকিৎসকেরা তাই করেছেন। শিশুটি জীবিত আছে। আইন অনুযায়ী, শিশুর বর্তমান অভিভাবক ‘কলকাতা চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটি’। তারা আইন মেনে শিশুটিকে দত্তক দিতে পারে। আমাদের এখন কাজ হল, নির্যাতিতা যাতে সমাজের মূল স্রোতে ফিরে আসে, তার জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ করা।’’

জেলা পুলিশের এক আধিকারিক বলেন, ‘‘অভিযুক্ত তিন জনের মধ্যে এক জনের সঙ্গে শিশুর ডিএনএ-র নমুনা মিলে গেলে আমরা নিশ্চিত হব, অপরাধ ওই তিন জনই সংগঠিত করেছিল। যদি ডিএনএ তিন জনের সঙ্গে না মেলে, তা হলে তদন্ত অন্য দিকে মোড় নেবে। তখন বুঝতে হবে যে, তিন জনের বাইরে কোনও অপরাধী রয়েছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE