Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
ছুটির জয়, বিচারের দফারফা

হোলির দিনে কাজ হলই না হাইকোর্টে

এক দিকে হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি। অন্য দিকে আইনজীবীদের সংগঠন। দু’পক্ষের টানাটানির দড়ির মাঝে ঝুলে ছিল কর্মসংস্কৃতি। এবং লড়াইয়ে শেষমেশ আইনজীবী সংগঠনের ‘ছুটি’র দাবিরই জয় হল। ধুলোয় লুটোল কর্মসংস্কৃতি। যার পরিপ্রেক্ষিতে ফের বড় হয়ে উঠল সেই প্রশ্নটাই ছুটির স্রোতে গা ভাসানো আইনজীবীরা কি নিজেদের পেশা ও দায়িত্বের প্রতি সুবিচার করছেন?

শুক্রবারের হাইকোর্ট চত্বর। —নিজস্ব চিত্র।

শুক্রবারের হাইকোর্ট চত্বর। —নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০১৫ ০৩:২৭
Share: Save:

এক দিকে হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি। অন্য দিকে আইনজীবীদের সংগঠন। দু’পক্ষের টানাটানির দড়ির মাঝে ঝুলে ছিল কর্মসংস্কৃতি।

এবং লড়াইয়ে শেষমেশ আইনজীবী সংগঠনের ‘ছুটি’র দাবিরই জয় হল। ধুলোয় লুটোল কর্মসংস্কৃতি। যার পরিপ্রেক্ষিতে ফের বড় হয়ে উঠল সেই প্রশ্নটাই ছুটির স্রোতে গা ভাসানো আইনজীবীরা কি নিজেদের পেশা ও দায়িত্বের প্রতি সুবিচার করছেন?

শুক্রবার হোলি উপলক্ষে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ছুটি ঘোষণা করেছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সিদ্ধান্তের দৌলতে রাজ্য সরকারি কর্মীরা বৃহস্পতিবার থেকে রবিবার টানা চার দিন ছুটি উপভোগের সুযোগ পেয়েছেন। একই পথে হেঁটে হাইকোর্টের বার অ্যাসোসিয়েশনও শুক্রবার কাজ বন্ধ রাখার দাবি তুলেছিল। কিন্তু প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুর তা পত্রপাঠ খারিজ করে দেন। তিনি বলেছিলেন, আইনজীবীরা শুক্রবার যদি একান্তই আদালতে আসতে অপারগ হন, তা হলে অন্য কোনও ছুটির দিনে কাজ করে পুষিয়ে দিন।

অ্যাসোসিয়েশন তা-ও মানেনি।

ফল যা হওয়ার তা-ই। হাইকোর্ট এ দিন নির্দিষ্ট সময়ে খুলেছে। কলকাতায় রয়েছেন যে সব বিচারপতি, তাঁরাও যথারীতি এজলাসে গিয়ে বসেছেন। কিন্তু তাঁদের সামনে সওয়াল করার মতো বিশেষ কাউকে পাওয়া যায়নি। অনেক আইনজীবী এ দিন হাইকোর্টমুখোই হননি। কেউ কেউ আদালতে এসেও এজলাসে ঢোকেননি। বার অ্যাসোসিয়েশনের ডাকে সাড়া দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা আছেন ছুটির পক্ষেই।

আইনজীবীরা এ দিন যে ভাবে হাইকোর্টকে কার্যত অচল করে দিলেন, তা দেখে প্রধান বিচারপতিও ক্ষোভ গোপন রাখতে পারেননি। এজলাসে রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল জয়ন্ত মিত্রকে উদ্দেশ করে তাঁর মন্তব্যে পরিষ্কার, ‘ছুটি’র এ হেন রমরমায় আদালত কতটা তিতিবিরক্ত। “বিচারপ্রার্থীদের অখুশি করে কী পাবেন? বিচারপ্রার্থীদের স্বার্থ দেখাই তো আইনজীবীদের কাজ! ওঁরা নিজেদের পেশার প্রতি সুবিচার করছেন না। মক্কেল যেখানে লক্ষ্মী, সেখানে আইনজীবীরা দায় এড়ান কী করে?” প্রশ্ন তুলেছেন প্রধান বিচারপতি চেল্লুর। তাঁর এ-ও পর্যবেক্ষণ, অন্য রাজ্যের তুলনায় কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবীরা অধিকতর দক্ষ ও পারদর্শী। “অথচ এ সবের (ছুটির দাবি) জন্যই তাঁদের ভাল দিকটা ঢাকা পড়ে যাচ্ছে।” আক্ষেপ করেন প্রধান বিচারপতি।

এ দিন প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চে জনস্বার্থ মামলাগুলোর শুনানি হওয়ার কথা ছিল। রাজ্য সরকারের তরফে অ্যাডভোকেট জেনারেল জয়ন্তবাবু ও গভর্নমেন্ট প্লিডার (জিপি) অভ্রতোষ মজুমদার হাজির ছিলেন। কিন্তু যাঁরা মামলা করেছেন, তাঁদের কৌঁসুলিরা অধিকাংশই আসেননি।

অবস্থা দেখে প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চের অন্য বিচারপতি জয়মাল্য বাগচিও বিরক্তি প্রকাশ করেন। তাঁর মতে, আদালতের কাজ বন্ধ রাখাটা কোনও গৌরবের ব্যাপার নয়। “নতুন প্রজন্মের অনেকেই কর্পোরেট সেক্টরে চলে যাচ্ছে। তার উপরে এমন পরিস্থিতি তৈরি হলে আইনি পেশায় আসার আগে নতুন প্রজন্ম দু’বার ভাববে।” মন্তব্য তাঁর। বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায়ও হতাশ। অ্যাডভোকেট জেনারেল তাঁর এজলাসে গেলে বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “এ ভাবে বছরে কমবেশি দু’শো ঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে কলকাতা হাইকোর্টে! মানে প্রায় তিরিশ দিন!”

পরিস্থিতি কি পাল্টাবে না?


সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন...

ক্ষোভ প্রকাশ করলেও প্রধান বিচারপতি অবশ্য হাল ছাড়ছেন না। তিনি বলেছেন, “আমি আশা করি, এটা বদলাবে।” অ্যাডভোকেট জেনারেলও বিষয়টিকে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ আখ্যা দিয়ে বলেছেন, প্রধান বিচারপতির বার্তা তিনি বার অ্যাসোসিয়েশনকে জানিয়ে দেবেন। যদিও জয়ন্তবাবুর দাবি, বার অ্যাসোসিয়েশনের যুক্তি একেবারে ফেলে দেওয়ার নয়। কী রকম?

অ্যাডভোকেট জেনারেলের বক্তব্য: ছুটি থাকায় রাজ্য সরকারের যে সব কর্মী হাইকোর্টে কাজ করেন, তাঁরা আসবেন না। রিগ্যাল রিমেমব্র্যান্স, জিপি অফিস, পাবলিক প্রসিকিউটর অফিস কার্যত বন্ধ। উপরন্তু কিছু জেলায় শুক্রবার হোলি। সেখানকার বিচারপ্রার্থীরাও আসবেন না। এ সব ভেবেই প্রধান বিচারপতিকে হোলির ছুটি মঞ্জুরের আর্জি জানানো হয়েছিল বলে দাবি জয়ন্তবাবুর। তাঁর মন্তব্য, “বিচারপতি ও আইনজীবীদের মধ্যে কোনও আড়াআড়ি বিভেদ নেই। একে অন্যের পরিপূরক।”

পরে প্রধান বিচারপতির মনোভাব সম্পর্কে বার অ্যাসোসিয়েশনকে অবহিত করেন জয়ন্তবাবু। তিনি বলেন, “প্রধান বিচারপতি-সহ প্রবীণ বিচারপতিরা চেয়েছেন, এ দিনের বদলে গ্রীষ্ম, পুজো অথবা শীতের ছুটিতে এক দিন হাইকোর্ট খোলা থাকুক। অনুমান করছি, অ্যাসোসিয়েশন সদর্থক কিছু করবে।”

অ্যাসোসিয়েশনের বক্তব্য কী?

সংগঠনের সম্পাদক রানা মুখোপাধ্যায় বলেন, “আগামী সোমবার সভা ডেকেছি। সেখানে এ বিষয়ে ইতিবাচক কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেষ্টা হবে।” শুক্রবার আদালতে গরহাজির আইনজীবীদের সিংহভাগ কিন্তু মনে করছেন, এটা কোনও দড়ি টানাটানির বিষয় নয়। তাঁদের মতে, প্রধান বিচারপতির উচিত ছিল অ্যাসোসিয়েশনের আর্জি মঞ্জুর করা।

এমতাবস্থায় সমস্যায় পড়েছেন সেই আইনজীবীরা, যাঁদের সঙ্গে রাজনীতির সংশ্রব নেই। এমনই এক জন বলেন, ‘‘আমাদের পিছনে কোনও রাজনৈতিক দলের ছাপ নেই। আমরা

তাই অসহায়। কাজ করতে হলে ঝাঁকের সঙ্গে মিশে থাকতে হবে। নচেৎ সমস্যায় পড়ব।” আর এক জনের প্রশ্ন, “কুমিরের সঙ্গে বিবাদ করলে জলে টেকা যায়? এখানেও তা-ই।” তবে কেউ কেউ মনে করেন, এই জাতীয় কর্মবিরতি বন্ধ করতে হলে একটু সাহস দেখাতেই হবে। না হলে আখেরে পেশার গায়েই কুড়ুল মারা হবে।

গোটা ঘটনাপ্রবাহে আইনজ্ঞদের একাংশও বীতশ্রদ্ধ। কলকাতা হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় বা বম্বে হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায় আইনজীবীদের গরহাজিরার কঠোর সমালোচনা করেছেন। ভগবতীবাবু এ-ও বলছেন, “মনে রাখতে হবে, আইনজীবী ছাড়াও বিচারপ্রার্থী সওয়াল করতে পারেন।” আবার হাইকোর্টের আইনজীবী অরুণাভ ঘোষের অভিমত, স্বাধীন পেশায় লোকে যে হেতু ইচ্ছে মতো কাজ করতে পারেন, তাই এ ক্ষেত্রে সামাজিক সচেতনতার প্রশ্নটাই মুখ্য।

একই সঙ্গে এমন কর্মকাণ্ডের পিছনে বিশেষ একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও দেখতে পাচ্ছেন অরুণাভবাবু। সেটা কী?

ওঁর ব্যাখ্যা: সামনেই হাইকোর্টের বার অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচন। “ওই ভোটকে সামনে রেখে টক্কর শুরু হয়েছে, কে কত বিপ্লবী হতে পারেন!” অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তারা অবশ্য এই অভিযোগ মানতে চাননি।

সরকারি ছুটির দিনে হাইকোর্ট ছুটি দেয়নি এমন নজির কিন্তু মজুত। প্রবীণ আইনজীবী ও প্রাক্তন বিচারপতিদের অনেকে জানিয়েছেন, যুক্তফ্রন্ট আমলে এক মন্ত্রীর মৃত্যুতে সরকার ছুটি দিলেও হাইকোর্ট ছুটি ঘোষণা করেনি। তাতে তদানীন্তন সরকার ও সরকারপন্থী দু’শিবিরের লোকজন রুষ্ট হয়েছিলেন বটে, কিন্তু এখনকার মতো অচলাবস্থা তৈরি হয়নি। রাজ্যের আইনি মহলের অন্দরে এ-ও আক্ষেপ শোনা যাচ্ছে, আইনজীবীদের একাংশ তাঁদের সিদ্ধান্ত আদালতের উপরে চাপিয়ে দিতে চাইছেন। নিম্ন আদালতের একাধিক ঘটনায় তো বটেই, হাইকোর্টের ক্ষেত্রেও প্রবণতাটি ইদানীং প্রকট।

এতেই সিঁদুরে মেঘ দেখছেন অনেকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

high court holi holiday
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE