Advertisement
E-Paper

৩ দিনে এফআইআর তাপসের বিরুদ্ধে

তৃণমূল সাংসদ তাপস পালের উস্কানিমূলক বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সিআইডি তদন্তের নির্দেশ দিল কলকাতা হাইকোর্ট। ৭২ ঘণ্টার মধ্যে তাদের এফআইআর করতে বললেন বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত। একই সঙ্গে জানিয়ে দিলেন, এই তদন্ত হবে হাইকোর্টের তত্ত্বাবধানে। তাই উচ্চ আদালতের অনুমতি ছাড়া সিআইডি এই মামলার চার্জশিটটি নিম্ন আদালতে পেশ করতেও পারবে না। তদন্ত কতটা এগোল, তা ১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে হাইকোর্টকে জানানোর নির্দেশও দিয়েছেন বিচারপতি দত্ত।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০১৪ ০৩:৩৩

তৃণমূল সাংসদ তাপস পালের উস্কানিমূলক বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সিআইডি তদন্তের নির্দেশ দিল কলকাতা হাইকোর্ট। ৭২ ঘণ্টার মধ্যে তাদের এফআইআর করতে বললেন বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত। একই সঙ্গে জানিয়ে দিলেন, এই তদন্ত হবে হাইকোর্টের তত্ত্বাবধানে। তাই উচ্চ আদালতের অনুমতি ছাড়া সিআইডি এই মামলার চার্জশিটটি নিম্ন আদালতে পেশ করতেও পারবে না। তদন্ত কতটা এগোল, তা ১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে হাইকোর্টকে জানানোর নির্দেশও দিয়েছেন বিচারপতি দত্ত।

গত জুন মাসে তৃণমূল সাংসদ তাপস পাল নাকাশিপাড়া থানা এলাকায় একের পর এক সভায় উস্কানিমূলক বক্তৃতা দেন বলে অভিযোগ। নাকাশিপাড়ার চৌমুহায় তিনি বলেন, “আমি প্রচুর মস্তানি করেছি। একটা কেউ বিরোধী মস্তানি করতে আসে, আমাদের ছেলেদের ঢুকিয়ে ‘রেপ’ করে দেব। এই তাপস পাল ছেড়ে কথা বলবে না। তাপস পাল নিজের রিভলভার বের করে গুলি করে মারবে।” এর পর সে দিনই তেহট্টের গোপীনাথপুরে এবং নাকাশিপাড়ার তেঘড়িতে আরও দুই সভায় বক্তৃতা দেন তাপস। গোপীনাথপুরে বলেন, “যারা আজ মানুষকে খুন করে, তারা মানুষ হতে পারে না। মানুষ জন্ম দেয়নি। ওর মা কুকুরের সঙ্গে শুয়েছিল। তাই ওর জন্ম হয়েছিল।” বলেন, “মেয়েদের বলছি, বঁটি চেনেন? বঁটি দিয়ে গলা কাটতে হয়। আপনারা বঁটিটা দিয়ে পারলে কেটে দিন নলিটা। নয়তো আমি নিজে যদি পারি গুলি করে মারব।” আর তেঘড়িতে বলেন, “নিজেদের কাছে কুড়ুল রাখুন। ভোজালি রাখুন। আপনারা মারুন। কে আপনাদের জেলে নিয়ে যায় আমি দেখব।”

এক জন সাংসদ হয়ে যে ভাবে তিনি প্রকাশ্য সভায় ‘রেপ’ (ধর্ষণ) করতে দলের ছেলেদের উস্কানি দিয়েছেন, যে ভাবে খুন করার কথা বলেছেন, তা প্রকাশ্যে আসতেই রাজ্য থেকে দিল্লি, সর্বত্র সমালোচনার ঝড় ওঠে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত তাপসের বিরুদ্ধে এফআইআর করেনি পুলিশ। সোমবার সেই নির্দেশই দিলেন বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত।

এক জন অভিনেতা হিসেবে তাপস পাল মহিলাদের সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন, তা যেমন তাঁকে দুঃখ দিয়েছে, তেমনই পুলিশের ভূমিকাতেও তিনি হতাশ ৪৩ পাতার নির্দেশে এই মন্তব্য করেছেন বিচারপতি দত্ত। তাঁর পর্যবেক্ষণ, “তৃণমূল সাংসদ আইন নিজের হাতে তুলে নিতে চেয়েছেন। তা তিনি করতে পারেন না। আইনের শাসন কড়া হাতে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ওই বক্তব্য পেশ করার পরে সাংসদ নিজের দলের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। জনগণের কাছে চাননি।” তাঁর আরও মন্তব্য, “অভিনেতা-সাংসদের জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য বিভিন্ন উপায় রয়েছে। কিন্তু যে ভাবে তিনি জনপ্রিয়তা অর্জন করতে চেয়েছেন এবং তাঁর ওই বক্তব্য পেশ করার পরে সমর্থকেরা যে ভাবে হাততালি দিয়েছেন, তা অত্যন্ত দুঃখজনক।”

এর পাশাপাশি পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন বিচারপতি। বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন, “সাংসদ আদালতগ্রাহ্য অপরাধ করার পরেও পুলিশ পরিকল্পিত ভাবে তাঁকে বাঁচাতে চেয়েছে।” বিচারপতি দত্তের আক্ষেপ, দেশে খুন, ধর্ষণ, অত্যাচার, নিপীড়ন-সহ নানা অপরাধ যে ভাবে ঘটছে, তা আগে কখনও ঘটেনি। অনেক অপরাধের শাস্তি হচ্ছে না রাজনৈতিক মদত থাকার ফলে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব যাঁদের হাতে, তাঁরাই তা পালন করছেন না। রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতাটাই তাঁদের কাছে জরুরি হয়ে উঠছে। বিচারপতি মনে করেন, সংসদের বাইরেও এক জন সাংসদের আচরণ দৃষ্টান্তমূলক হওয়া উচিত। নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়ার প্রবণতা বন্ধ না হলে রাজ্যের পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ হবে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। রাজনৈতিক নেতাদের লজ্জাজনক বক্তব্য বা মন্তব্য রাজ্যে অপরাধকে উৎসাহিত করছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুলিশ মুখ ঘুরিয়ে থাকছে।

বিচারপতির প্রশ্ন, তাপস পালের মতো এক জন রাজনীতিবিদ যদি আইন ভঙ্গকারী হন ও সাংসদের ওই ধরনের উস্কানিমূলক বক্তব্য পেশের খবর পেয়েও আইনের রক্ষকর্তারা যদি চোখ বুজে থাকেন, তা হলে কোনও সভ্য দেশ কি তা সহ্য করবে? হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ, তাপস পালের বক্তব্য সভ্যতার সকল সীমা পেরিয়েছে। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ানো দুর্ভাগ্যজনক। নাগরিকদের স্বার্থে বা মামলাকারীর স্বার্থের কথা মাথায় রেখে প্রশাসনের উচিত ছিল আইনি ব্যবস্থা নেওয়া। রাজ্য সরকার যদি দায়িত্বজ্ঞানহীন ভূমিকা পালন না করত, তা হলে বিষয়টি এত দূর গড়াত না বলে মনে করেন তিনি। তবে আশা প্রকাশ করেন, এই ধরনের পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি হবে না।

এর আগে তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের বিরুদ্ধেও উস্কানিমূলক বক্তৃতা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। গত পঞ্চায়েত ভোটে অনুব্রতর বক্তৃতার পরেই পাড়ুইয়ে নির্দল প্রার্থী হৃদয় ঘোষের বাড়িতে হামলা হয়। হৃদয়বাবুর বাবা সাগর ঘোষ সেই হামলায় প্রাণ হারান। প্রকাশ্য মঞ্চে খুনের কথা কবুল করে হুমকি দেওয়ার অভিযোগ ওঠে তৃণমূল বিধায়ক মনিরুলের বিরুদ্ধেও। এঁদের কারও ক্ষেত্রেই পুলিশ এখন পর্যন্ত কোনও ব্যবস্থা নেয়নি।

তাপস পালের ক্ষেত্রে এ দিন পুলিশকে এফআইআর করে তদন্ত শুরুর সেই গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশটিই দিলেন বিচারপতি দত্ত।

একই সঙ্গে বিচারপতি দত্ত মনে করেন, আদালতের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আদালত একা হাতে প্রশাসনের যাবতীয় কালিমা ঘোচাতে পারবে না। আদালতের এই নির্দেশ অন্তত তাপস পালের মতো রাজনীতিবিদদের চোখ খুলে দিক। পুলিশও জানুক, বিচার ব্যবস্থা সদাই নজর রাখে প্রশাসনের সব কাজে।

তাদের কাছে দায়ের হওয়া তাপস পালের বক্তব্য সংক্রান্ত একটি জনস্বার্থের মামলা গত সপ্তাহেই কলকাতা হাইকোর্টের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। এরই পাশাপাশি কলকাতা হাইকোর্টে পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ তুলে দু’টি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট তাদের মামলাটি হাইকোর্টে পাঠিয়ে দেওয়ায় সোমবারই যে তাপস-কাণ্ডের রায় ঘোষণা হবে, তা এ দিন সকালেই পরিষ্কার হয়ে যায়। সকাল থেকেই বিচারপতি দীপঙ্কর দত্তের এজলাসে উপচে পড়ে ভিড়। বিকেল চারটের পরে এই সংক্রান্তটি নির্দেশের ঘোষণা করেন বিচারপতি।

এর আগে তাপস পালের ফোন খোলা ছিল। কিন্তু বিচারপতির নির্দেশ প্রকাশ্যে আসার পরে তাঁর সঙ্গে আর যোগাযোগ করা যায়নি। যত বারই ফোন করা হয়, দেখা যায় তা বন্ধ। এর আগে শনিবারই তৃণমূল ভবনে গিয়ে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের সঙ্গে দেখা করেন তাপস। বস্তুত, অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া, সে জন্য সংসদের অধিবেশনে যোগ দিতে না পারার পরে সেই প্রথম প্রকাশ্যে এলেন তাপস।

হাইকোর্টের নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে মুকুল এ দিন বলেন, “এই মামলা সুপ্রিম কোর্ট থেকে হাইকোর্টে গিয়েছে। শেষ পর্যন্ত কী রায় হয়েছে, তা না দেখে কোনও মন্তব্য করব না।” কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়া বলেন, “আইন আইনের পথে চলবে। তবে আদালত যা নির্দেশ দিয়েছে, আশা করি প্রশাসন তাকে মান্যতা দেবে।” বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, “আশা করি এর পরে ঠিক মতো এফআইআর হবে। তাঁর ওই ভাষণের পরে ওই এলাকায় আমাদের এক জন খুন হয়েছেন। নারী নিগ্রহের ঘটনাও হয়েছে। সেখানে এফআইআরে তৃণমূল সাংসদের প্ররোচনামূলক বক্তব্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আশা করি, এ বার ঠিক ধারায় মামলা করে ওঁকে গ্রেফতার করা হবে।”

বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ এই রায়ে খুশি। কারণ, তাপস পালের বক্তব্যের বিরুদ্ধে বিজেপি-ই প্রথম নাকাশিপাড়া থানায় এফআইআর দায়ের করেছিল। রাহুল এ দিন বলেন, “আমাদের ডাকে সাড়া দিয়ে তার পরে বহু মানুষ থানায় থানায় এফআইআর করে। এখন হাইকোর্ট সেই এফআইআর গ্রহণ করার কথা বলায় আমরা খুশি। আমরা চাই তাপসবাবুর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক।” এই রায়ে বাংলার মহিলা সমাজ ও সংস্কৃতির জয় হয়েছে বলে রাহুলবাবুর অভিমত। অন্য দিকে, নদিয়ার পুলিশ সুপার অর্ণব ঘোষকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “আইন মোতাবেকই তদন্ত চলছিল। তবে আদালত যেমনটা বলবে, তেমনটাই হবে।”

high court fir tapas pal
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy