Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

ক্ষতিপূরণের টাকায় কি ক্লাব-খয়রাতি, কটাক্ষ বিচারপতির

জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণের জন্য অধিগৃহীত জমির ক্ষতিপূরণের টাকা বিলি করা হয়নি বলে অভিযোগ। অথচ রাজ্যের ১১ হাজারেরও বেশি ক্লাবকে ঢালাও অর্থসাহায্য করা হচ্ছে। এই বৈপরীত্যের দিকে আঙুল তুলল কলকাতা হাইকোর্ট।

(ইনসেটে) বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায়।

(ইনসেটে) বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায়।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ ডিসেম্বর ২০১৫ ০৪:০৭
Share: Save:

জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণের জন্য অধিগৃহীত জমির ক্ষতিপূরণের টাকা বিলি করা হয়নি বলে অভিযোগ। অথচ রাজ্যের ১১ হাজারেরও বেশি ক্লাবকে ঢালাও অর্থসাহায্য করা হচ্ছে। এই বৈপরীত্যের দিকে আঙুল তুলল কলকাতা হাইকোর্ট। বৃহস্পতিবার বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর্যবেক্ষণ, ‘‘জমি অধিগ্রহণের জন্য কেন্দ্র রাজ্যকে ক্ষতিপূরণের টাকা দিয়ে দিয়েছে। তা সত্ত্বেও রাজ্য জমিদাতাদের ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে না। আমাকে কি তা হলে মনে করতে হবে, সেই টাকাই বিলোনো হয়েছে নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়াম থেকে!’’

পয়লা ডিসেম্বরই এক অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে ১১ হাজারেরও বেশি ক্লাবকে ১৬০ কোটি বিলি করেছে রাজ্য সরকার। করদাতাদের টাকা এই ভাবে ক্লাবগুলিকে বিলি করা যায় কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল রাজ্যের বিরোধী দলগুলি। এই টাকার উৎস নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন কেউ কেউ। এ দিন বিচারপতি নিজে এজলাসে বসে ওই টাকার উৎস নিয়ে কটাক্ষ করায় অস্বস্তিতে শাসক দল। দলের কোনও শীর্ষস্থানীয় নেতাই বিচারপতির পর্যবেক্ষণ নিয়ে সর্বসমক্ষে মুখ খুলতে চাননি। তবে মামলার গণ্ডির বাইরে গিয়ে বিচারপতি এমন মন্তব্য করায় ঘনিষ্ঠ মহলে উষ্মা প্রকাশ করেন তৃণমূল নেতাদের অনেকেই। প্রকাশ্যে এক রাজ্য নেতা শুধু বলেন, ‘‘এ নিয়ে যা বলার, অর্থমন্ত্রীই বলতে পারবেন।’’

তবে বিরোধীরা বিচারপতির পর্যবেক্ষণটিকে হাতিয়ার করে সরকারকে ফের বিঁধেছেন। বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের বক্তব্য, ‘‘সরকার যে বিভিন্ন কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা দান-খয়রাতি করছে, সে কথা তো আমরা বলেই আসছি। আসলে এটা প্রতারক সরকার! সে জন্যই জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণ খাতে কেন্দ্রের দেওয়া টাকা জমিদাতাদের হাতে পৌঁছয়নি।’’ সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য তথা শিলিগুড়ির মেয়র অশোক ভট্টাচার্যর দাবি, ‘‘আদালতের প্রশ্ন যথার্থ। এই সরকার ধারাবাহিক ভাবে এক খাতের টাকা অন্য দিকে বেহিসেবি খরচ করে চলেছে।’’ তিনি অভিযোগ করেন, বৃহস্পতিবারই স্বাস্থ্য দফতরের একটা বৈঠকে গিয়ে তিনি দেখেছেন, একটা প্রকল্পে ১৮০ কোটি টাকা আসা সত্ত্বেও আসল কাজে খরচ হয়েছে মাত্র ৮ কোটি। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর মন্তব্য, ‘‘একের পর এক কেন্দ্রীয় প্রকল্প রাজ্য সরকার নিজের নামে চালিয়ে দিচ্ছে। প্রকল্পের টাকা লুঠ হচ্ছে। আর অন্য দিকে নিজেরা কৃতিত্ব নিতে চাইছে!’’

কোন মামলার প্রেক্ষিতে এ দিন রাজ্য সরকারের টাকা বিলির প্রসঙ্গ তুললেন বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায়?

জমিদাতাদের আইনজীবী অরিন্দম দাস জানান, ২০১০ সালে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণ প্রকল্পে মুর্শিদাবাদের বেলডাঙা থেকে ফরাক্কা পর্যন্ত দফায় দফায় জমি অধিগ্রহণের বিজ্ঞপ্তি দেয় জেলা প্রশাসন। অনেকের জমি অধিগ্রহণ করা হয়। প্রশাসনের পক্ষ থেকে সেই সময় জমিদাতাদের বলা হয়েছিল, ক্ষতিপূরণের পরিমাণ নিয়ে সন্তুষ্ট না হলে মুর্শিদাবাদের জেলাশাসকের কাছে তাঁরা আবেদন জানাতে পারেন। ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত আবেদন বা অভিযোগের আইনি সালিশি করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট জেলাশাসকের। এর পরে অনেক জমিদাতাই ক্ষতিপূরণের টাকার ব্যাপারে জেলাশাসকের কাছে অভিযোগ জানান। কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই জেলাশাসক সালিশি করেননি বলে অভিযোগ। সুবিচারের আশায় রবিউল ইসলাম-সহ জনা ২০ জমিদাতা হাইকোর্টে মামলা করেন।

গত ১৫ অক্টোবর মামলার প্রথম শুনানির দিনে জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের আইনজীবী দীপঙ্কর দাসের বক্তব্য ছিল, ২০১০ সালেই ক্ষতিপূরণের টাকা রাজ্যের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। রাজ্যকে এ-ও বলা হয়েছে, প্রয়োজনে এর চেয়ে বেশি টাকা দিতেও জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ রাজি। কারণ, জমি-বিবাদে প্রকল্পের কাজ বন্ধ হয়ে রয়েছে এবং সেই কারণে প্রকল্পের খরচও দিনদিন বাড়ছে। এ দিন ফের মামলাটি ওঠে। বিচারপতির নির্দেশে আদালতে হাজির হন হাইকোর্টে রাজ্যের সিনিয়র স্ট্যান্ডিং কাউন্সেল প্রণব দত্ত। তিনি আদালতে জানান, ‘‘ক্ষতিপূরণের টাকা তো দিতেই হবে।’’

এর পরেই বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করেন, ‘‘জেলাশাসক তো ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত সালিশিও করছেন না। গরিব জমিদাতাদের হয়রানি বাড়ছে। উন্নয়নমূলক একটি প্রকল্প, রাজ্যের উত্তর থেকে দক্ষিণে যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ একটি রাস্তার সম্প্রসারণআটকে রয়েছে। তা হলে কি মনে করব রাজ্যের ভূমিকা অসহযোগিতামূলক?’’ এই প্রসঙ্গে নেতাজি ইন্ডোরে ক্লাবগুলিকে টাকা দেওয়ার প্রসঙ্গ টেনে আনেন বিচারপতি। তাঁর নির্দেশ, ক্ষতিপূরণ দেওয়া নিয়ে কী করা হচ্ছে জানিয়ে আগামী ৮ ডিসেম্বর রাজ্যকে বক্তব্য জানাতে হবে।

মুর্শিদাবাদ জেলা প্রশাসন কী বলছে এ নিয়ে? মুর্শিদাবাদের অতিরিক্ত জেলাশাসক (ভূমি ও ভূমিসংস্কার) সুরজিৎ রায়ের দাবি, ক্ষতিপূরণ বাবদ কেন্দ্রের দেওয়া টাকা জেলা ট্রেজারিতে বিশেষ খাতে রাখা রয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘২০০৯-১১ জমির যে বাজারদর ছিল, সেই বাজারদর জানিয়ে জমি অধিগ্রহণের বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছিল। অনেকেই বেশি দর চেয়ে জেলাশাসকের কাছে আবেদন জানান। বাড়তি দর দিলেও অনেকে সন্তুষ্ট হননি।’’ জেলা প্রশাসন সূত্রের খবর, বহরমপুরে ভাগীরথীর পূর্ব-পাড় লাগোয়া কয়েকটি মৌজায় অকৃষি জমি রয়েছে। কিন্তু সেগুলি শহর-ঘেঁষা বলে এক রকম দর দেওয়া হয়েছে। অন্য দিকে ভাগীরথীর পশ্চিম-পাড় লাগোয়া তিনফসলি জমি। সেখানকার জন্য অন্য দর। এই নিয়ে জটিলতা। প্রশাসনের দাবি, পশ্চিম-পাড়ের লোকজন পূর্ব-পাড়ের চেয়ে কম দরে টাকা নিতে অস্বীকার করছেন। কিন্তু জেলা প্রশাসন কেন সালিশি ডেকে দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করল না, তা নিয়ে অবশ্য কেউ মন্তব্য করতে চাননি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

compensation highcourt sanjib
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE