নদীতে সে ভাবে ইলিশ মাছের দেখা নেই। তাই কাজ নেই মৎস্যজীবীদেরও।—নিজস্ব চিত্র।
চাহিদা আছে, কিন্তু জোগান নেই— ভরা মরসুমে তাই আক্ষরিক অর্থেই মহার্ঘ কোলাঘাটের ইলিশ। পরিস্থিতি এমনই যে, মোবাইলে ‘বুকিং’ করেও মিলছে না রূপনারায়ণের ‘রুপোলি শস্য’।
কোলাঘাটের তিন নম্বর রেলসেতুর কাছে দীর্ঘ দিনের মাছের ব্যবসা শ্রীমন্ত দাসের। বর্ষা আসতেই ঘন ঘন তাঁর মোবাইল ফোন আসা শুরু হয়ে গিয়েছে। আর্তি একটাই, কোলাঘাটের ইলিশ। দাম যাই হোক না কেন। কিন্তু ফোনের ও পারের আর্তির উত্তরে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলা ছাড়া উপায় নেই শ্রীমন্তবাবুর। তিনি জানালেন, কী করব বলুন। চাহিদা তো একশোটি। কিন্তু জোগান তো সাকুল্যে পাঁচ-দশটি। তাই কয়েক দিন অপেক্ষা করতে বলা ছাড়া উপায় কী! ইলিশের জন্য রসনাপ্রিয় বাঙালি দীর্ঘ দিন অপেক্ষা করতেও রাজি।
বছর কয়েক আগেও বর্ষায় কোলাঘাটে রূপনায়ারণের তীর গমগম করত। কয়েকশো মৎস্যজীবী পরিবারের দিন গুজরান হত রূপনারায়ণের ইলিশ মাছ ধরে। গত কয়েক বছর ধরেই ছবিটা বদলাতে শুরু করে। পনেরো বছর বয়স থেকে ইলিশ ধরছেন কোলাঘাটের দেনানের পালপাড়ার বাসিন্দা বিশ্বনাথ পাল। বছর সত্তরের বিশ্বনাথবাবু বলেন, ‘‘এক দিনে একটি নৌকায় এক থেকে দেড় কুইন্ট্যাল পর্যন্ত মাছ ধরেছি। তখন মাছ প্রতি ২-৫ টাকা দরে বিক্রি হত। আর এখন প্রতি কিলোগ্রামে ২ হাজার টাকা দাম দিয়েও কোলাঘাটের ইলিশ পাওয়া মুশকিল।’’ শ্রীমন্তবাবুও বলছেন, ‘‘মোবাইলে কলকাতা-সহ বিভিন্ন জেলা থেকে প্রতিদিন ইলিশ কিনতে চেয়ে একশোরও বেশি ফোন আসে। ৫০ টির বেশি নৌকো নদীতে জাল পাতলেও সবাই এখন ইলিশ পায় না।’’ তাঁর কথায়, ‘‘অপেক্ষা করতে বলি। ইলিশ ধরা পড়লে তাঁদের ফোন করে জানিয়ে দিই।’’
এমন আকালের কারণ কী?
স্থানীয় মৎস্যজীবী বিশ্বনাথ পাল, পঞ্চানন দোলইদের মতে, কোলাঘাটের কাছে রূপনারায়ণের বুকে পরপর পাঁচটি সেতু থাকায় নদীর স্বাভাবিক স্রোত বাধা পাচ্ছে। সেতুর স্তম্ভ সংলগ্ন নদীগর্ভে জমছে পলি। নদীর নাব্যতা কমে গিয়ে জেগে উঠছে চর। ভরা কোটাল ছাড়া অন্য সময় নদীতে সে ভাবে জলের স্রোত থাকে না। ইলিশ গভীর জলের মাছ হওয়ায় এখানে আসছে না। তাঁদের আরও অভিযোগ, সমুদ্রে ছোট ফাঁসযুক্ত জাল ব্যবহার করে ইলিশের পোনা ধরে নেওয়া হচ্ছে। গেঁওখালিতেই হুগলি-রূপনারায়ণ-দামোদর সঙ্গম। এখানে হুগলি থেকে ইলিশ-ঝাঁক রূপনারায়ণে ঢোকে। তার আগেই অধিকাংশ মাছ ধরে নেওয়ায় কোলাঘাট পর্যন্ত ইলিশ প্রায় আসছেই না।
সমস্যার কথা স্বীকার করে পূর্ব মেদিনীপুর জেলা মৎস্য দফতরের সহ-অধিকর্তা (সামুদ্রিক) রামকৃষ্ণ সর্দার বলেন, ‘‘নদীর নাব্যতা কমার পাশাপাশি সমুদ্র থেকে মহিষাদলের গেঁওখালি হয়ে রূপনারায়ণে আসার পথে প্রচুর জাল পাতার দরুন ইলিশ আসার পথে বাধা তৈরি হচ্ছে।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘এ ছাড়াও নদীতে দূষণের মাত্রা বৃদ্ধি ও চিংড়ি মাছ ধরার সময় ইলিশ-সহ অন্যান্য মাছের চারা নষ্ট হওয়ায় ক্ষতি হচ্ছে।’’ মৎস্য দফতরের সহ-অধিকর্তা জানান, ১৯৮৪ সাল থেকে মাছের চারা ধরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ ছাড়াও ছোট ইলিশ ধরা বন্ধ করতে মৎস্যজীবীদের ৯০ মিলিমিটারের কম মাপের ফাঁস যুক্ত জাল ব্যবহার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ২৩ সেন্টিমিটারের চেয়ে কম দৈর্ঘ্যের ইলিশ মাছ ধরাও নিষিদ্ধ। তবে এ নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে প্রচার চালানো হচ্ছে।
কোলাঘাটের রূপনারায়ণে ইলিশ আসা কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে জল দূষণ অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র। তিনি বলেন, ‘‘জল দূষণ ইলিশ মাছ কমে যাওয়ার ক্ষেত্রে একটা কারণ হতে পারে। সমুদ্রে ব্যাপক পরিমাণে ছোট ফাঁসের জালে মাছ ধরার প্রবণতাও এ জন্য দায়ী।’’ তাঁর কথায়, ‘‘সামগ্রিক ভাবে গঙ্গা অববাহিকায় ইলিশের সংখ্যা আগের চেয়ে কমেছে। কোলাঘাটের কাছে রূপনারায়ণেও জালে ইলিশ কম পড়ছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy