Advertisement
E-Paper

এ কেমন পার্টি লাইন, তোপ দাগলেন হাবিব

কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্নে সিপিএমের মধ্যে বিতর্ক এখন তুঙ্গে। প্রকাশ কারাট ও তাঁর শিবিরের সঙ্গে সম্মুখ সমর চলছে বঙ্গ ব্রিগেডের। এমন বিতর্কের মাঝেই সিপিএমের রাজনৈতিক-কৌশলগত লাইনকে তুলোধোনা করে পলিটব্যুরোকে নোট পাঠালেন বর্ষীয়ান ইতিহাসবিদ ইরফান হাবিব।

সন্দীপন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৩ জুলাই ২০১৬ ০৪:৩৯

কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্নে সিপিএমের মধ্যে বিতর্ক এখন তুঙ্গে। প্রকাশ কারাট ও তাঁর শিবিরের সঙ্গে সম্মুখ সমর চলছে বঙ্গ ব্রিগেডের। এমন বিতর্কের মাঝেই সিপিএমের রাজনৈতিক-কৌশলগত লাইনকে তুলোধোনা করে পলিটব্যুরোকে নোট পাঠালেন বর্ষীয়ান ইতিহাসবিদ ইরফান হাবিব।

দেশের পরিস্থি্তি এবং রাজ্যওয়াড়ি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করে যে নোট হাবিব লিখেছেন, তার প্রতিপাদ্য এক কথায় বলতে গেলে বিস্ফোরক! মার্ক্সবাদী এই ইতিহাসবিদ প্রশ্ন তুলেছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে আরএসএস এবং বিজেপি যে দেশের সামনে সব চেয়ে বড় বিপদ, তা বুঝতে সিপিএমের মতো দলের অসুবিধা হচ্ছে কেন? কেন বারবার ধর্মনিরপেক্ষ সব শক্তিকে একজোট করে সঙ্ঘ পরিবারের রাজনীতির বিরুদ্ধে বাধা হয়ে দাঁড়াতে ব্যর্থ হচ্ছে সিপিএম? বাংলায় কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতাই যে বামপন্থীদের সামনে একমাত্র রাস্তা ছিল, তা-ও স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছেন হাবিব। পার্টি লাইন নিয়ে প্রশ্ন তুলে হাবিবের পাঠানো এই নোট সীতারাম ইয়েচুরি, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, সূর্যকান্ত মিশ্রদের জন্য যতটা উৎসাহব্যঞ্জক, ততটাই অস্বস্তিকর কারাট ও তাঁর অনুগামীদের জন্য!

পশ্চিমবঙ্গ-সহ কয়েকটি রাজ্যের নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে পর্যালোচনার জন্য দিল্লিতে সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক হয়েছিল ১৮ থেকে ২০ জুন। তার পরেই কেন্দ্রীয় কমিটি বিবৃতি জারি করে জানিয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের হাত ধরার সিদ্ধান্ত দলের রাজনৈতিক লাইনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। সেই বিবৃতি দেখেই হতাশা গোপন করেননি সস্ত্রীক হাবিব! আলিগড় থেকে সরাসরি সিপিএমের পলিটব্যুরোর কাছে নোট পাঠিয়ে জানতে চেয়েছেন, দলের একটা পার্টি কংগ্রেসে কী লাইন নেওয়া হল, সেই চোখ দিয়েই যাবতীয় পরিস্থিতিকে বিচার করতে হবে— এমন অনড় অবস্থান নিয়ে কোনও রাজনৈতিক দলের পক্ষে কি বেঁচে থাকা সম্ভব? পার্টি লাইনের বারংবার ব্যর্থতাও কেন কেন্দ্রীয় কমিটির চোখ খুলে দিচ্ছে না, জানতে চেয়েছেন। সেই সঙ্গেই তাঁর আশা, কমিউনিস্ট পার্টিতে ৬০ বছরেরও বেশি পুরনো সদস্য হিসাবে তাঁদের এই মতামত যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়ে বিবেচনা করা হবে!

সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি নোটের প্রাপ্তিস্বীকার করে জানিয়েছেন, এর পরিপ্রেক্ষিতে তাঁরা কী করবেন, এখনও ঠিক হয়নি। তাঁর কথায়, ‘‘হাবিবের নোট পেয়েছি। ওঁর মতামত অবশ্যই সম্মাননীয়। আমাদের প্রতিক্রিয়া কী হবে, সেটা দেখতে হবে।’’ দলীয় সূত্রে বলা হচ্ছে, হাবিবের ওই নোট সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির মুখপত্রে প্রকাশ করে দলের তরফে জবাবও দেওয়া হতে পারে। সে ক্ষেত্রে কলম বাগিয়ে জবাবের জন্য তৈরি থাকবেন খোদ কারাট!

হাবিব অবশ্য কারাটের জন্য কোনও স্বস্তির বালাই রাখেননি! কেন্দ্রের বর্তমান বিজেপি সরকার যে আর পাঁচটা বুর্জোয়া পার্টির সংসদীয় ক্ষমতায় বসা নয়, তাদের হাতে যে দেশের অর্থনীতি, শিক্ষা ও গণতন্ত্র বিপন্ন, সে সবের উদাহরণ দিয়ে হাবিব লিখেছেন, ‘এই অবস্থায় নিশ্চিত ভাবেই পার্টির প্রাথমিক লক্ষ্য হওয়া উচিত বিজেপি-কে বিচ্ছিন্ন করা। বিজেপি-র পরিকল্পনা ব্যর্থ করতে সব গণতান্ত্রিক শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে বৃহত্তর যুক্তফ্রন্ট গড়ে তোলা। এবং এই ভাবেই ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে বিজেপি-কে পরাস্ত করার পথ তৈরি করা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে, পার্টির ‘অফিসিয়াল’ কৌশলগত লাইন এর ঠিক উল্টো দিকে যাচ্ছে’!

রাজ্যভিত্তিক উদাহরণ দিতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের কথা তুলেছেন হাবিব। বলেছেন, ‘কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতার পথে না গেলে বাংলায় পার্টির পরাজয় আরও ব্যাপক হতো। তৃণমূলের দাপট আরও বাড়তো এবং তাদের হাতে পার্টির সদস্যদের আরও বেশি আক্রান্ত হতে হতো। সর্বোপরি, বিজেপি-কে আমরা প্রধান বিরোধী শক্তির আসনে বসিয়ে দিতাম’! ঠিক এই যুক্তি দিয়েই কারাটদের ‘সংশোধনী’র বিরোধিতা করে আসছেন সূর্যবাবুরা। একই সঙ্গে হাবিব লিখেছেন, ‘এটা ঠিক যে, কংগ্রেসের সঙ্গে যৌথ কর্মসূচি তৈরি করে তৃণমূল শাসনের বিকল্প ভাবনা মানুষের সামনে তুলে ধরা যায়নি। সেটা ভুল’। এই ভুল মানতে সূর্যবাবুদেরও কোনও আপত্তি নেই। তাঁরা ইতিমধ্যেই দলের অন্দরে বলেছেন, কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতাকে আরও দৃঢ় ও গ্রহণযোগ্য করার জন্য যা যা করার দরকার ছিল, ততটা সময় পাওয়া যায়নি।

হাবিব প্রশ্ন তুলেছেন, বিহারে নীতীশ কুমারেরা যখন বিজেপি-বিরোধী মহাজোট গড়লেন, সিপিএম সেই ডাক অগ্রাহ্য করে সিপিআই (এম-এল) লিবারেশনকে সহযোদ্ধা বাছল। বিজেপি পরাস্ত হল। কিন্তু সিপিএম একটা আসনও পেল না! উল্টে বিজেপি-বিরোধী ভোটকে ভাগ করার দায় চাপল ঘাড়ে! পূর্ব ভারতেই অসমে কংগ্রেস সরকারকে ফেলে দেওয়ার ডাক দিয়ে ভোটের প্রচারে যাওয়া হল। সেখানে বিকল্প সরকার গড়ার ক্ষমতা তো বামেদের ছিল না। কংগ্রেস-বিরোধিতার জোয়ারে ডেকে আনা হল বিজেপি সরকারকে, যারা এখন পাশের পশ্চিমবঙ্গের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে! তামিলনাড়ুতেও ডিএমকে-কংগ্রেসের জোটে সামিল না হয়ে ভোটপ্রাপ্তির শতাংশ ভয়াবহ হল! দলের ‘অফিসিয়াল’ লাইন অক্ষরে অক্ষরে মানতে গিয়ে এমন ভরাডুবি দেখেও কেন্দ্রীয় কমিটি শিক্ষা নিচ্ছে না— আক্ষেপ করেছেন প্রবীণ ইতিহাসবিদ।

এমন কড়া চাবুকে কারাটদের কী প্রতিক্রিয়া হয়, তারই এখন অপেক্ষা গোটা সিপিএমে!

Irfan Habib CPM party line
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy