Advertisement
E-Paper

গঞ্জিকার বাক্সে আস্ফালন, থিম ‘অপারেশন সিঁদুর’, জলযাত্রায় ক্রমবিবর্তন, শ্রাবণের তারকেশ্বর হন্টনে এখন কার্নিভালের মেজাজ

বাঁকের নকশা বদলাতে শুরু করেছিল অনেক আগেই। সময়ের সঙ্গে মাটি থেকে প্লাস্টিকের ঘটের রমরমা বেড়েছে। গত কয়েক বছর ধরে রথে করে মূর্তি নিয়ে যাওয়ারও হিড়িক দেখা যাচ্ছিল। তবে ১৪৩২ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাসে তারকেশ্বর হন্টনের পথ দেখছে আরও পরিবর্তন।

শোভন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১০ অগস্ট ২০২৫ ০৮:৫৬
Hooghly is witnessing many changes during the Tarakeswar Yatra in the month of Shravan

শ্রাবণের জলযাত্রায় তারকেশ্বরের পথে হনুমানের মূর্তি। —নিজস্ব চিত্র।

এই শ্রাবণের এক শনিবার। রাত ১১টা ১৫ মিনিটের হাওড়া-ব্যান্ডেল লোকালের ভেন্ডার বগি ‘বাবা ভক্ত’দের দখলে। শ্রাবণের শনি-রবিবার তেমনই হয়। ট্রেনের কামরার ভিতরে ‘পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে’ নিয়মমতো ঘোষণা হচ্ছে, ‘ট্রেন কম্পার্টমেন্টে ধূমপান দণ্ডনীয় অপরাধ’। সেই আওয়াজ ঘুরপাক খাচ্ছে গাঢ় ধোঁয়ার কুণ্ডলীর মধ্যে।

জনা চল্লিশের একটি দল। সামনে খোলা গঞ্জিকার বাক্স। এলইডি টুনি বাল্ব দিয়ে সাজানো। বাক্সের ভিতরে বসানো টেরাকোটার শিবমূর্তি। দক্ষিণ ২৪ পরগনার ঘুঁটিয়ারি শরিফ থেকে আগত ওই দলের গন্তব্য তারকেশ্বর।

আবার এই শ্রাবণেরই এক রবিবারের দুপুরে শেওড়াফুলির ‘সুষমা’ সিনেমা হলের সামনে জিটি রোডের পাশে বিশ্রাম নিচ্ছিল যুবকের দল। ঠিক বিশ্রাম নয়। দম নেওয়া। হাতে হাতে ঘুরছে ছিলিম। সঙ্গে ব্লু টুথ বক্সে তারস্বরে বাজছে ওড়িয়া গান, ‘আমাকু সাইড দিও রে, আমি তো কাউরিবালা!’ এই গান এ বারের তারকেশ্বর যাত্রায় ‘সুপারহিট’! দম নিতে নিতেই রাস্তা জুড়ে উদ্দাম নাচ। সরাতে এসেছিলেন এক সিভিক ভলান্টিয়ার। কিন্তু তাঁকে হতোদ্যম হয়ে ফিরতে হল। দমদার নাচ চলল অন্তত মিনিটকুড়ি। তার পরে আবার হন্টন।

টেরাকোটার শিবমূর্তি, এলইডি টুনি বাল্ব দিয়ে সাজানো  গঞ্জিকার বাক্স।

টেরাকোটার শিবমূর্তি, এলইডি টুনি বাল্ব দিয়ে সাজানো গঞ্জিকার বাক্স। —নিজস্ব চিত্র।

গত রবিবার রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ বৈদ্যবাটি গভর্মেন্ট কোয়ার্টারের সামনে চায়ের দোকানে বসে-থাকা স্থানীয়েরা নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করছিলেন। দূর থেকে ভেসে আসছে ‘মা তুঝে সালাম’-এ ব্যবহৃত এআর রহমানের তৈরি ‘বন্দেমাতরম’। শ্রাবণের তারকেশ্বর যাত্রায় বন্দে মাতরম? চায়ের দোকান বিস্মিত! রাস্তা দিয়ে তখন ‘ভোলেবাবা পার করেগা’র জনস্রোত। সেই ধ্বনি ভেদ করে কানে আসছে দূরাগত ‘বন্দেমাতরম’।

মিনিট পনেরোর মধ্যে অবশ্য নতুন বিস্ময় জন্ম নিল। রথে চেপে এগিয়ে এল এক আশ্চর্য ছবি। ভ্যানের উপরে বসানো উঁচু চৌকো বাক্স। সামনে এক মহিলার মুখের অবয়ব। সিঁথিতে গাঢ় সিঁদুর। মাথার উপরের অংশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে দু’টি যুদ্ধবিমান। কোনওদিকে ভারতের মানচিত্র, কোনওদিকে সেনাবাহিনীর ছবি। বাক্সের মাথায় জোড়া কামান। তারকেশ্বর যাত্রায় ঢুকে পড়ল ‘থিম’। সে থিমের নাম ‘অপারেশন সিঁদুর’।

বাঁকের নকশা বদলাতে শুরু করেছিল অনেক আগেই। সময়ের সঙ্গে মাটি থেকে প্লাস্টিকের ঘটের রমরমা বেড়েছে। গত কয়েক বছর ধরে রথে করে মূর্তি নিয়ে যাওয়ারও হিড়িক দেখা যাচ্ছিল। তবে ১৪৩২ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাসে তারকেশ্বর হন্টনের পথ দেখছে আরও বদল। বদলাচ্ছে শিবভক্তদের গাঁজার বাক্স, বদলাচ্ছে নাচের গান, বদলাচ্ছে স্লোগানও।

তারকেশ্বর যাত্রার আলোকসজ্জায় ‘অপারেশন সিঁদুর’।

তারকেশ্বর যাত্রার আলোকসজ্জায় ‘অপারেশন সিঁদুর’। —নিজস্ব চিত্র।

বেশ কয়েক বছর হল শ্রাবণের জলযাত্রায় তারকেশ্বরের পথে হনুমানের মূর্তি, বজরংবলীর আগ্রাসী মুখ আঁকা পতাকা (যা মূলত রামনবমী এবং হনুমান জয়ন্তীর অবদান) দেখা যায়। ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনিও নতুন নয়। তবে এ বার নানা ধরনের নতুন স্লোগান শোনা যাচ্ছে। ‘রাস্তায় রাস্তায় বাম্পার, বাবার কত টেম্পার’-এর মতো পুরনো স্লোগানের সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে নতুন বুলি, ‘জল নিয়েছি ঘটে, বাবা যেন পটে’। প্রমীলাবাহিনী স্লোগান দিচ্ছে, ‘জয় মা তারা জয় মা কালী, আমরা হলাম বাবার শালি (শ্যালিকা)’।

এগুলো নিছকই মজা। তবে এর বাইরে কিছু উস্কানিমূলক স্লোগানও ভাইরাল হয়েছে। যা অতীতে শোনা যায়নি। সঙ্গে উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে রূপান্তরকামী বা তৃতীয় লিঙ্গের পুণ্যার্থীদের সংখ্যা। পরিবর্তন? তা তো বটেই। এলাকার বাসিন্দা তথা ছোট ব্যবসায়ী সঞ্জয় ঘোষের কথায়, ‘‘তারকেশ্বর যাত্রায় গত কয়েক বছর ধরেই জাঁকজমক বেড়েছে। তবে এ বার জলযাত্রা যেন কার্নিভালের আকার নিয়েছে। পরের বার না প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়!’’

শ্রাবণের এই তারকেশ্বর যাত্রাকে পটভূমি করেই ১৯৭৭ সালে তৈরি হয়েছিল ‘বাবা তারকনাথ’। যে ছবির মুখ্যচরিত্রে অভিনয় করেছিলেন বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায় এবং সন্ধ্যা রায়। ছবিতে দেখানো হয়েছিল, স্বামীর মঙ্গলের জন্য কণ্টকাকীর্ণ পথ পেরিয়ে স্ত্রীর (সন্ধ্যা রায়) তারকেশ্বর যাত্রা। যে ছবি বক্স অফিসে ঝড় তুলে দিয়েছিল। অনেকে বলেন, তার বহু বছর পরেও ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে মেদিনীপুরের মতো গ্রামীণ আসনে তৃণমূল প্রার্থী সন্ধ্যাকে বাড়তি সুবিধা দিয়েছিল ‘বাবা তারকনাথ’। তবে প্রায় পাঁচ দশক আগের সেই ছবির সঙ্গে এখনকার পরিস্থিতির কোনও মিলই নেই। এলাকার একটি বড় ক্লাবের অন্যতম কর্তা প্রদীপ মুখোপাধ্যায় যেমন বলছেন, ‘‘গত দু’দশক ধরেই বদল হচ্ছিল শ্রাবণীমেলায়। এখন তা তীব্র ভাবে চোখে পড়ছে। আগে ভক্তির একটা বিষয় ছিল। এখন তাকে ছাপিয়ে যাচ্ছে ফূর্তি এবং দেখনদারি!’’

একটি বেসরকারি সংস্থার বিপণন বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মী শুভজিৎ ভক্ত আবার ‘ভক্তি বনাম ফূর্তি’র নিরিখে শ্রাবণীমেলাকে দেখতে চাননি। তাঁর বক্তব্য, ‘‘গত কয়েক বছরে তারকেশ্বর যাত্রায় মানুষের ঢল যে ভাবে বেড়েছে, তাতে গোটা এলাকার অর্থনৈতিক বৃদ্ধি হয়েছে। এ বছর বহু হোটেলে খাবারের সঙ্কট তৈরি হতেও দেখেছি। তাঁরা দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারেননি। এই সময়টায় বহু মানুষ বাড়তি কিছু রোজগার করতে পারেন। সেই টাকা তো বাজারেই ‘রোল’ হয়।’’

হুগলির এই জনপদে পরিচিত বচন হল— ‘শ্রাবণ মাসে টাকা ওড়ে’। কারণ, শ্রাবণে তারকেশ্বরে লক্ষ লক্ষ জোড়া পা পড়ে। অসংগঠিত ক্ষেত্রের বহু শ্রমিক এই শ্রাবণে শনি-রবিবার নিজেদের কাজ ফেলে শ্রাবণীমেলায় যুক্ত হন। কারণ, উড়ন্ত টাকা ধরতে হবে। রাজমিস্ত্রির সঙ্গে জোগাড়ের কাজ করা নান্টু দাস যেমন বলেই দিলেন, ‘‘মেলায় তিন ডবল রোজগার। দশের মাল পঞ্চাশে বেচে দেওয়া যায়! পুজোর খরচ উঠে আসে।’’ নান্টুর মতো অনেকেরই জীবনে শ্রাবণেই বেজে ওঠে আশ্বিনের আলোকমঞ্জির।

ভিড়কে সবসময়ই রাজনৈতিক দলগুলি ‘ব্যবহার’ করে। শ্রাবণের ভিড়ের সামনে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতে চায় তারা। বৈদ্যবাটি-শেওড়াফুলিতেও দেখা যাচ্ছে তৃণমূল, বিজেপি, কংগ্রেস জল খাওয়াচ্ছে পুণ্যার্থীদের। তবে দলীয় ভাবে বামেদের উপস্থিতি নেই। থাকার কথাও নয়। তাঁরা ঈশ্বরভক্ত নন। হওয়ার কথাও নয়। তবে দুর্গাপুজোয় বিভিন্ন বড় বাজেটের মন্ডপের ধারেপাশে সিপিএমের বইয়ের স্টল দেওয়ার মতো উদ্যোগ কি শ্রাবণীমেলার ভিড়ের পথে নেওয়া যেত না? তাতে সাপও মরত, লাঠিও ভাঙত না। অভিজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, সেটা সম্ভব হত না। একে তো দুর্গাপুজোর ভিড়ের সঙ্গে এই ভিড়ের তুলনা চলে না। দ্বিতীয়ত, সিপিএমের সেই সংগঠনও আর নেই।

গত কয়েক বছর ধরে বাঁকের সঙ্গে সঙ্গে রথে করে মূর্তি নিয়ে যাওয়ারও হিড়িক চোখে পড়ার মতো।

গত কয়েক বছর ধরে বাঁকের সঙ্গে সঙ্গে রথে করে মূর্তি নিয়ে যাওয়ারও হিড়িক চোখে পড়ার মতো। —নিজস্ব চিত্র।

তারকেশ্বরে যাঁরা হেঁটে জল ঢালতে যান, তাঁদের ৮০ ভাগই জল তোলেন বৈদ্যবাটি নিমাইতীর্থ ঘাট থেকে। তবে অনেকে কালীঘাট থেকে জল তুলে নিয়ে আরও দীর্ঘপথ হাঁটেন। তাঁদেরও যেতে হয় বৈদ্যবাটির উপর দিয়ে। বৈদ্যবাটি থেকে তারকেশ্বর— ৩৬ কিলোমিটার রাস্তায় পুণ্যার্থীদের সেবায় কেউ জল দেন, কেউ শরবত, কেউ লুচি-আলুর দম বা খিচুড়ি খাওয়ান। এ বার সেই মেনুতেও বদল। ২ অগস্ট, শনিবার সিঙ্গুরের ডাকাত কালীবাড়ির কাছে পূণ্যার্থীদের খাওয়ানোর বন্দোবস্ত করেছিলেন বেলুড়ের কয়েক জন ব্যবসায়ী। মেনুতে ছিল সয়াবিনের বিরিয়ানি আর আলুর দম। মোট সাড়ে তিন হাজার পুণ্যার্থী পাত পেড়ে খেয়েছেন সেই নতুন মেনুর ভোজ।

রাজ্যে প্রাচীনতম কার্নিভাল হল হুগলির চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পুজোর বিসর্জন। অনেকে বলেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেড রোডে দুর্গা কার্নিভালের ‘আইডিয়া’ হুগলি থেকেই পেয়েছিলেন। ঘটনাচক্রে, রাজ্যের তৃতীয় কার্নিভালের জন্মও হল হুগলিতে। তবে এটি ‘বেসরকারি’। এবং ‘স্বতঃস্ফূর্ত’। এর পিছনে কোনও সংগঠিত উদ্যোগ নেই।

তা হলে আছে কী? কিসের জোরে চলে এই বাৎসরিক কার্নিভাল?

আছে বাবার অভয়মন্ত্র— দম মারো দম! কার্নিভাল চলছে সেই গুরুমন্ত্রের জোরে। অন্য সময় গাঁজায় ‘কেসের’ ভয় থাকলেও শ্রাবণে সেই ভয় নেই। বাবার নামে গাঁজায় দম দেওয়া যায় প্রকাশ্যে। বুক ফুলিয়ে। গাঁজার বাক্সে আলো লাগিয়ে।

Tarakeswar Temple Shravan
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy