Advertisement
০৬ মে ২০২৪
Tourism in Murshidabad

হোটেল, রিসর্টে ‘গা-ঢাকা’ দিয়েছেন পঞ্চায়েতে জয়ীরা, তিলধারণের জায়গা নেই হাজারদুয়ারি, মায়াপুরে

শুধু হাজারদুয়ারি বা নবদ্বীপ-মায়াপুর নয়, মুর্শিদাবাদ ও নদিয়ার অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র— নসিপুর, মতিঝিল, ফরাক্কা, কল্যাণীর চর, বেথুয়াডহরি, পলাশি, শিকারপুর সর্বত্রই একই অবস্থা!

গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।

গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।

প্রণয় ঘোষ
বহরমপুর ও কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ০৫ অগস্ট ২০২৩ ২১:০৬
Share: Save:

ভোটে বিপুল খাটাখাটনির পরে বেড়াতে যাওয়ার সুযোগ মেলেনি। টুকটাক কাজের চাপে নাভিশ্বাস উঠছিল নদিয়ার করিমপুরের বাসিন্দা অভিরাজ সাহা এবং তাঁর স্ত্রী সুদেষ্ণার। শিক্ষক দম্পতি ভেবেছিলেন, সপ্তাহান্তে ছেলেমেয়েকে নিয়ে হাজারদুয়ারি ঘুরে আসবেন। কিন্তু সে আর হল কোথায়! অনলাইন-অফলাইন মিলিয়ে পঞ্চাশেরও বেশি হোটেলে খোঁজ নিয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু কোথাও কোনও ঘর ফাঁকা নেই। সব হোটেলেরই এক কথা, ‘‘১২ অগস্ট পর্যন্ত ঘর দিতে পারব না দাদা!’’

সত্তরোর্ধ্ব মাকে নিয়ে এই রবিবার নবদ্বীপ-মায়াপুর ঘুরে আসতে চেয়েছিলেন তেহট্টের স্নেহাশিস মজুমদার। হোটেলের নাগাল পেতে গিয়ে নাকাল হতে হয়েছে তাঁকেও। স্নেহাশিস বললেন, ‘‘অনেকগুলো হোটেল দেখেছি। কেউ ঘর ভাড়া দিতে চাইছে না। কী কারণ, কিছুই বুঝতে পারছি না। এখন তো সিজ়নও নয়!’’ ‘অফ সিজ়নে’ও হোটেল খালি না-পাওয়ায় হতবাক অভিরাজ, স্নেহাশিসেরা। শুধু হাজারদুয়ারি বা নবদ্বীপ-মায়াপুর নয়, মুর্শিদাবাদ ও নদিয়ার অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র— নসিপুর, মতিঝিল, ফরাক্কা, কল্যাণীর চর, বেথুয়াডহরি, পলাশি, শিকারপুরেরও একই অবস্থা!

শুখা মরসুমেও ‘পর্যটক’দের এমন ঢল দেখে ‘অভিভূত’ হোটেল ব্যবসায়ীরা। মায়াপুরের লজ মালিক বিমল বাইন বলছেন, ‘‘একসঙ্গে একগাদা বুকিং। দলে দলে লোক আসছে। কেন আসছে, কী জন্য বুকিং করছে— রেজিস্টারে তা লিখতে হয়। যাঁরা আসছেন, সকলেই লিখছেন, পর্যটক। আমরা সবই জানি। সবই বুঝতে পারছি। অত ভেবে লাভ কি! যা বুঝতে পারছি, ১২ তারিখ পর্যন্ত এ রকমই চলবে।’’ হোটেল মালিকদের একাংশ জানাচ্ছেন, যাঁরা ঘর ভাড়া নিচ্ছেন, তাঁদের অধিকাংশই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রী।

নদিয়া ও মুর্শিদাবাদ মিলিয়ে বহু পঞ্চায়েতে এখন ত্রিশঙ্কু দশা। বিরোধীদের একটা অংশের দাবি, অনেক জায়গায় এক-দু’টি আসনে পিছিয়ে প়়ড়েও বোর্ড গঠনে মরিয়া হয়ে উঠেছে শাসকদল তৃণমূল। এই পরিস্থিতিতে দলের জয়ী সদস্যদের ‘লুকিয়ে’ রাখতে বাধ্য হচ্ছে তারা। জয়ী প্রার্থীদের বিভিন্ন হোটেল, রিসর্ট, লজে ঘর ভাড়া করে রাখা হচ্ছে। তাঁদের বাইরে বেরোতে, পরিবারের লোকেদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেও নিষেধ করা হয়েছে। ১৬ অগস্টের মধ্যে রাজ্যে ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের বোর্ড গঠনের নির্দেশ দিয়েছে নবান্ন। মুর্শিদাবাদে সেই প্রক্রিয়া শুরু হবে ৯ অগস্ট থেকে। ১০-১১ তারিখের মধ্যে তা মিটে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। হাতে এক দিন বাড়তি রেখেই ১২ অগস্ট পর্যন্ত হোটেল বুকিং সেরে রাখা হয়েছে। এ কথা আনুষ্ঠানিক ভাবে স্বীকার না করলেও মুর্শিদাবাদ জেলা কংগ্রেসের মুখপাত্র জয়ন্ত দাস বলেন, ‘‘জেলা জুড়ে যে ভাবে কংগ্রেস-সহ বিরোধী দলের জয়ী সদস্যদের অপহরণ করে দলবদলে বাধ্য করা হচ্ছে, তাতে এ রকমটা হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।’’

তবে যে শুধু বিরোধী দলের নেতা-নেত্রীরাই হোটেল, রিসর্টে ভিড় করেছেন, তা নয়। খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছে, বহু জায়গায় শাসক তৃণমূলের নেতা-নেত্রীরাও বিভিন্ন হোটেলে গিয়ে উঠেছেন। তৃণমূল সূত্রেই খবর, যে সব জায়গায় শাসকদল দুর্বল, বিরোধীদের দাপট বেশি, সেই সব পঞ্চায়েতে দলের জয়ী সদস্যদের বাধ্য হয়েই ‘লুকিয়ে’ রাখতে হচ্ছে। যদিও এই দাবিকে অস্বীকার করে জঙ্গিপুর সাংগঠনিক জেলা তৃণমূলের চেয়ারম্যান কানাইচন্দ্র মণ্ডল বলছেন, ‘‘ভোটের পর থেকেই কর্মীরা ক্লান্ত। মাথা হালকা করতেই ওরা বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে থাকছে। এর সঙ্গে বোর্ড গঠনের কোনও সম্পর্ক নেই।’’

হোটেল মালিকদের একাংশের অভিযোগ, রাজনৈতিক দলগুলির ‘রিসর্ট-রাজনীতি’র জেরেই দুই জেলার হোটেল, লজে তিলধারণের জায়গা নেই। হাজারদুয়ারির রিসর্টের মালিক আনসার কবিরাজ বলেন, ‘‘সব চেনা লোক। প্রভাবশালী নেতা। কেউ এক সপ্তাহ, কেউ ১০ দিনের জন্য গোটা হোটেল বুক করেছে। ভাড়া কবে দেবে, আদৌ পাব কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে। কিছু বলারও উপায় নেই। ব্যবসা যদি লাটে তুলে দেয়!’’

সপরিবার বেথুয়াডহরি বেড়াতে এসে হোটেলে ঘরের অভাবে রাত্রিযাপন না করেই শুক্রবার ফিরে যেতে হয়েছে বেলঘরিয়ার আশিস মজুমদারকে। তিনি বলেন, ‘‘ছোট-বড় মাঝারি সব হোটেল হাউসফুল। কিন্তু কাউকেই পর্যটক বলে মনে হচ্ছে না। কাউকে বাইরে দেখছি না, অথচ মালিক বলছে বুকিং কমপ্লিট। অগত্য বাড়ি ফিরে আসতে হল।’’ মেয়ের বিয়ের জন্য লজ ভাড়া করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন তেহট্টের কানাইনগরের বাসিন্দা রফিকুল ইসলামও। নাজিরপুর, হরিপুর, করিমপুর এলাকাতেও তন্নতন্ন করে খুঁজে একটিও লজ মেলেনি। রফিকুল বলেন, ‘‘এ যে কী সমস্যায় পড়েছি! ১০ তারিখে (অগস্ট) মেয়ের বিয়ে। আমি তো ভেবেই পাচ্ছি না, কী করব। এ কী জ্বালাতনে পড়া গেল!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Murshidabad Nadia TMC Congress
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE