Advertisement
E-Paper

অনলাইন ভর্তি তো কী? টাকা কেমন ভাবে তুলতে হয় ‘দাদা’রা জানেন...

গত ১৮ জুন বঙ্গবাসী কলেজে প্রথম তালিকা প্রকাশিত হয়। তার ১৮ নম্বরে সুরজিতের নাম ছিল। কিন্তু, কেন ভর্তি হতে পারলেন না?

সোমনাথ মণ্ডল

শেষ আপডেট: ০৩ জুলাই ২০১৮ ১৮:৩২
শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়, তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সভানেত্রী জয়া দত্তের সঙ্গে তোলাবাজি কাণ্ডে ধৃত জয়পুরিয়া কলেজের প্রাক্তন জিএস তিতান সাহা।—নিজস্ব চিত্র।

শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়, তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সভানেত্রী জয়া দত্তের সঙ্গে তোলাবাজি কাণ্ডে ধৃত জয়পুরিয়া কলেজের প্রাক্তন জিএস তিতান সাহা।—নিজস্ব চিত্র।

দত্তপুকুরের নিবাধুই হাইস্কুলের ছাত্র সুরজিৎ মণ্ডল। উচ্চমাধ্যমিকে ৪০২ নম্বর পেয়ে বঙ্গবাসী কলেজে বাণিজ্য বিভাগে ভর্তি হওয়ার জন্য অনলাইন ফর্ম ভর্তি করেছিলেন। কিন্তু ভর্তি হওয়া আর হয়নি।

গত ১৮ জুন ওই কলেজে প্রথম তালিকা প্রকাশিত হয়। তার ১৮ নম্বরে সুরজিতের নাম ছিল। কিন্তু, কেন ভর্তি হতে পারলেন না? সুরজিৎ তাঁর অভিজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, “ভর্তির জন্য তিনটি তারিখ দেওয়া হয়েছিল। ২২, ২৩ এবং ২৫ জুন। ভর্তির জন্য ২২ তারিখ টাকা জোগাড় করতে পারিনি। তাই আমি ২৩ তারিখ গিয়েছিলাম। ভোরবেলা থেকে লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম। বেলা ১১টার সময় গেট খুলল। কিন্তু একটু পরেই দরজা বন্ধ করে ইউনিয়নের দাদারা বললেন, আর ভর্তি হবে না। ফিরে এলাম।”

এখানেই শেষ নয়। সে দিন সুরজিৎ কলেজের বাইরে থাকা পুলিশকর্মীদের সাহায্যও চেয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশকর্মীরা ইউনিয়নের এক ‘দাদা’র কাছে সুরজিৎকে পাঠিয়ে দেন। তার পরের অভিজ্ঞতা? সুরজিতের কথায়, “আমাকে ইউনিয়নের এক দাদা বলেন, ১৮ হাজার টাকা লাগবে। তা হলে ভর্তির ব্যবস্থা করা হবে। আমাকে একটা ফোন নম্বরও দেওয়া হয়। বলা হয় পরে ফোন করতে।”

আরও পড়ুন
ওষুধ একটাই— মমতা

সুরজিতের বাবা সঞ্জয় মণ্ডল পেশায় রংমিস্ত্রি। মাসে মেরেকেটে হাজার ছয়েক টাকা রোজগার। অনেক কষ্টে ভর্তির জন্য সাতাশশো টাকা জোগাড় করেছিলেন। কিন্তু, ইউনিয়নের ‘দাদা’র কথামতো ১৮ হাজার টাকা দিতে পারেননি তিনি। তাই তার ছেলের আর ভর্তি হওয়া হয়নি। একই অভিজ্ঞতা সমীরণ ঘোষ, তুহিন ঘোষ, সৌরভ হালদার, সোমনাথ পালদের। ওঁদের প্রত্যেকের নাম বঙ্গবাসীর প্রথম তালিকায় ছিল। কিন্তু তাঁরা কেউ ভর্তি হতে পারেননি। কারণ, ইউনিয়নের ‘দাদা’দের দাবি মতো টাকা দিতে পারেননি তাঁরা।

তৃণমূল নেতা মদন মিত্রের সঙ্গে তৃণমূল ছাত্রপরিষদের নেতারা।—নিজস্ব চিত্র।

আসলে ছাত্রনেতা এবং কলেজ কর্মীদের একাংশের ‘যৌথ সিন্ডিকেট’-এর বোঝাপড়াতেই চলছে কলেজে কলেজে ভর্তি করানোর লাখ লাখ টাকার ‘ব্যবসা’। অনলাইন ফর্ম ফিল-আপ হলেও ‘দাদা’দের হাতযশে বদলে যাচ্ছে মেধা তালিকাতে থাকা নামও! যদিও শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় নাকি বুঝতেই পারছেন না, অনলাইন-এ কী ভাবে দুর্নীতি হচ্ছে!

খোঁজখবর নিয়ে জানা গেল, কী ভাবে দুর্নীতি হচ্ছে। মূলত তিনটি কারণ—

১) অনলাইন ফর্ম ফিল-আপ হলেও মেধা তালিকায় আগে থেকেই কিছু ভুয়ো নাম ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কোনও ছাত্রনেতার সঙ্গে ‘চুক্তি’ চূড়ান্ত হওয়ার পর, যিনি টাকা দিচ্ছেন তালিকায় ভুয়ো নামের জায়গায় তাঁর নাম উঠে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে মেধা নয়, ‘দাদা’দের দাবি মতো টাকা দিতে পারলেই কলেজে ভর্তি নিশ্চিত

কী ভাবে সম্ভব হচ্ছে এটা?

আসলে অনলাইন-এ ফর্ম ফিল-আপ হওয়ার পর ভেরিফিকেশন করে মেধা তালিকায় নাম তোলার দায়িত্বে রয়েছেন সংশ্লিষ্ট কলেজের কর্মীদের একাংশ। তাঁদের বেশির ভাগই তৃণমূলের নেতা অথবা ছাত্র পরিষদের প্রাক্তন কর্মী। যাঁরা দলের সুপারিশেই একটা সময়ে কলেজে চাকরি পেয়েছিলেন। মূলত তাঁরাই মেধা তালিকায় নাম তোলার গোটা প্রক্রিয়াটাই নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন। সেখানে কোনও নজরদারি চালানোর উপায় নেই অধ্যক্ষের।

জয়পুরিয়া কলেজে কাউন্সেলিং-এ ঢুকছেন পড়ুয়ারা...

২) ধরা যাক, ফর্ম ফিল-আপ করে কোনও পড়ুয়ার নাম মেধা তালিকায় উঠেছে। তিনি ভাবছেন, কাউন্সেলিং-এর মাধ্যমে ভর্তি হবেন। আসলে সেখানেও বিপত্তি! অভিযোগ, কলেজের ‘দাদা’দের সঙ্গে আগে রফা না করলে কাউন্সেলিং-এর সময় অনেক পড়ুয়াকে কলেজে ঢুকতেই দেওয়া হচ্ছে না। কলেজের গেট থেকেই ফিরে যেতে হচ্ছে তাঁদের। ওই আসনে ভর্তি হচ্ছেন ‘দাদা’দের পছন্দ মতো প্রার্থী।

৩) অনেক পডুয়াই আছেন, যাঁরা কম নম্বর পেয়েছেন। কিন্তু, তিনি পছন্দের মতো বিষয় নিয়ে ভর্তি হতে চাইছেন। এই ধরনের পড়ুয়াদের পাকড়াও করতে কলেজের বাইরেই সিন্ডিকেটের সদস্যেরা ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাঁরা বিষয় অনুযায়ী টাকা দাবি করছেন। এবং সেই টাকা দিয়ে কাজও মিটছে।

ওই ‘দাদা’রা আবার এক কলেজে ভর্তি হতে না পারলে অন্য কলেজে ভর্তি করিয়ে দেওয়ার ‘গ্যারান্টি’ও দিচ্ছেন। সেখানেও বিপদ লুকিয়ে রয়েছে। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, কোনও কলেজে ভূগোল অর্নাসে সিট রয়েছে ৪০টি। কিন্তু, ভর্তি হয়ে গিয়েছেন ২০০ জন! এর ফলে পরবর্তী ক্ষেত্রে বিপদের মুখে পড়বেন ওই পড়ুয়ারাই।

আরও পড়ুন
ভর্তিতে টাকার খেলা মানতেই নারাজ পার্থ

এ সব জেনে বুঝে শিক্ষা দফতর কী করছে? মঙ্গলবার শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “কলেজে ভর্তির প্রক্রিয়ায় ছাত্রনেতা অথবা ওই কলেজের কোনও অশিক্ষককর্মী যুক্ত আছে কি না, সে বিষয়ে আমি ঢুকতে চাইছি না। আমাদের লক্ষ্য, মেধার ভিত্তিতেই কলেজে ছাত্র ভর্তি করা। সেটাই হচ্ছে।”

তবে বাস্তব পরিস্থিতি যে সেটা নয়, তা মেনে নিয়ে এসএফআই-এর রাজ্য সম্পাদক সৃজন ভট্টাচার্য বলেন, “কাউন্সেলিং-এর শেষ লগ্নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় তোলাবাজি রুখতে কড়া হুঁশিয়ারি দিলেও, তার আগেই সিন্ডিকেটের দাদাদের সুবাদে বহু পড়ুয়া টাকার বিনিময়ে ভর্তি হয়ে গিয়েছেন। বহু বার শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে এ নিয়ে বৈঠক হয়েছে। কোনও সমাধান সূত্র বেরোয়নি।”

College Admission Mamata Banerjee Admission Extortion Syndicate Partha Chaterjee
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy