E-Paper

বানভাসি হাওড়ায় ‘ঘুঘুর বাসা’ পুর নিকাশি দফতরে

তিমধ্যেই ২০ লক্ষ টাকা খরচের বিল পুরসভার বিভিন্ন অফিসারের টেবিলে অনুমোদন পেয়ে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য পৌঁছে গিয়েছে কন্ট্রোলার অব ফিনান্সের টেবিলে!

দেবাশিস দাশ

শেষ আপডেট: ০৫ অগস্ট ২০২৫ ১০:০৫
হাওড় পৌরসভা প্রধান কার্যালয়।

হাওড় পৌরসভা প্রধান কার্যালয়। —ফাইল চিত্র।

ঘটনা এক: হাওড়া পুরসভার ৪০ নম্বর ওয়ার্ডে একটি ১০০ ফুটের নিকাশি নালা তৈরির জন্য বরাদ্দ হয়েছিল ২০ লক্ষ টাকা। কয়েক মাস পরে দেখা যায়, ওই নিকাশি নালা তৈরির জন্য একটি ইটও গাঁথা হয়নি। অথচ, ইতিমধ্যেই ২০ লক্ষ টাকা খরচের বিল পুরসভার বিভিন্ন অফিসারের টেবিলে অনুমোদন পেয়ে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য পৌঁছে গিয়েছে কন্ট্রোলার অব ফিনান্সের টেবিলে!

ঘটনা দুই: ৫০টি ওয়ার্ড থেকে জমা জল সরাতে হাওড়া পুরসভার হাতে রয়েছে ৩৬টি পাম্প। পাম্পগুলি চালানো এবং রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব রয়েছে একাধিক ঠিকাদার সংস্থার কাঁধে। কিন্তু অভিযোগ, গোটা শহর যখন বর্ষার জমা জলে ভাসছে, তখন অধিকাংশ পাম্পই বন্ধ করে রাখা হয়েছে। অন্য দিকে, পুরসভার লগ বুকে রহস্যজনক ভাবে ‘সব পাম্প চলছে’ বলে সই করে দিচ্ছেন দায়িত্বে থাকা ইঞ্জিনিয়ারেরা। তার পরে মোটা অঙ্কের বিল হয়ে বিভিন্ন টেবিল ঘুরে তা পৌঁছে যাচ্ছে পুরসভার অর্থ দফতরে।

ঘটনা তিন: মাস দুয়েক আগে হাওড়ার বেলগাছিয়া ভাগাড়ে ভয়াবহ ধসে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল বি রোড, সি রোড ও বামনগাছির মূল নিকাশি নালাটি। সেই নর্দমা যুদ্ধকালীন তৎপরতায় মেরামতের কাজ শুরু করেছিল পুরসভা চিহ্নিত একটি ঠিকাদার সংস্থা। অভিযোগ, কাজ যখন প্রায় শেষের মুখে, তখন অন্য একটি ঠিকাদার সংস্থার চার কর্মীকে এক ইঞ্জিনিয়ারের মদতে কাজ দ্রুত শেষ করার অছিলায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। শুধু তা-ই নয়, কাজ শেষের পরে বরাদ্দ টাকার ৪০ শতাংশ দ্বিতীয় সংস্থাটিকে দিতে বাধ্য করেন ওই ইঞ্জিনিয়ার।

উপরোক্ত তিনটি ঘটনাই প্রমাণ করে দিচ্ছে, হাওড়া পুরসভার নিকাশি দফতরে কত বড় ঘুঘুর বাসা তৈরি হয়েছে। অভিযোগের আঙুল উঠেছে দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে দায়িত্বে থাকা ইঞ্জিনিয়ারদের একাংশের সঙ্গে ঠিকাদার সংস্থাগুলির গোপন যোগসাজশের দিকে। পূর্বোক্ত তিনটি ঘটনা কার্যত হিমশৈলের চূড়া মাত্র। আর সেই কারণেই কোটি কোটি টাকা নিকাশিতে খরচ করার পরেও চলতি বর্ষায় বানভাসি হয়েছে গোটা হাওড়া শহর। আর ভরাডুবি হয়েছে পুরসভা পরিচালনার দায়িত্বে থাকা তৃণমূল প্রশাসকমণ্ডলীর।

পুরসভা সূত্রের খবর, ২০১১ সালের পর থেকে বছরে হাওড়ার নিকাশি ব্যবস্থার উন্নতির জন্য ১০-১২ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। কিন্তু তার পরেও দেখা যাচ্ছে, চলতি বছরে বৃষ্টির কারণে টানা ২০-২১ দিন ধরে জলবন্দি হয়ে আছেন বাসিন্দারা। কয়েকটি ওয়ার্ডে আবার নর্দমা উপচে হাঁটু সমান কালো পাঁক-জল জমে রয়েছে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে। এ হেন পরিস্থিতিতে নাজেহাল বাসিন্দারা বার বার পুরসভায় অভিযোগ জানিয়েও রেহাই পাচ্ছেন না। পুরসভার তরফে দাবি, সব ক’টি পাম্পই চালানো হচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে জল নামছে না কেন? তা ছাড়া, নিকাশির সংস্কারের পিছনে যখন লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ হচ্ছে, তখন পাম্পের খরচ বাড়ছে কেন?

হাওড়া পুরসভার এক পদস্থ কর্তা বলেন, ‘‘খবর নিয়ে দেখেছি, অধিকাংশ পাম্পই চলে না। অথচ, লগ বুকে লেখা হচ্ছে, পাম্প চলেছে। এ জন্য প্রতি বছর পাম্পের বিল লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। গত বছর যে বাবদ ৮৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছিল, এ বছর ইতিমধ্যে বিল হয়েছে ১ লক্ষ ১৫ হাজার টাকা। আসলে এক শ্রেণির ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে ঠিকাদারদের বোঝাপড়ায় এই দুর্নীতি চলছে বলে জানতে পেরেছি। কয়েক জন ইঞ্জিনিয়ারকে চিহ্নিতও করেছি।’’ হাওড়া পুরসভার চেয়ারপার্সন সুজয় চক্রবর্তী বলেন, ‘‘পুরো ব্যাপারটা নিয়ে তদন্ত করে দেখা হবে।’’

দীর্ঘ দিন ধরে পুরসভার নিকাশি দফতরের দায়িত্বে থাকা এগ্‌জ়িকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার পীযূষকান্তি ভঞ্জ অবশ্য বলছেন, ‘‘পাম্প সব ঠিকঠাকই চলছে। সারা ক্ষণ তো আর পাম্প চলতে পারে না। মাঝে মাঝে বন্ধ রাখতে হয়। তাই লোকে বলছে যে, পাম্প চলছে না।’’ নিকাশি দফতরের ওই ইঞ্জিনিয়ারের আবার দাবি, নিকাশি সংস্কারের অনেক কাজই হয়েছে। শুধুই যে টাকা খরচ হয়েছে, এমন নয়। গঙ্গার জলস্তর এ বছর অনেকটা উঁচুতে থাকায় জমা জল সহজে নামছে না বলে তাঁর দাবি।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Howrah

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy