কচিকাঁচাদের ঘুড়ি, লাটাই বিলি চুঁচুড়ায়। —নিজস্ব চিত্র।
আকাশে পেঁজা মেঘ। বিশ্বকর্মা পুজোয় ঘুড়ির লড়াই। সারা আকাশ জুড়ে রংবেরঙের ঘুড়ি— সবই যেন জানান দেয় হাজির পুজোর মরসুম। হাওড়া ও হুগলির বিভিন্ন এলাকায় বিশ্বকর্মা পুজোর দিন ঘুড়ি ওড়ানোর প্রচলন আছে। তবে গত কয়েক বছরে ধরেই এই ছবি কেমন যেন ফিকে হতে শুরু করেছে। ব্যস্ত জীবনে ঘুড়ি ওড়ানোর সময় কমছে বলেই দাবি অনেকের। তাতে সায় দিচ্ছেন ঘুড়ি ব্যবসায়ীরাও।
হুগলির গোস্বামী বাগান বাজারে ঘুড়ি ব্যবসায়ীরা জানান, সেখানে পাঁচটি ঘুড়ির দোকান ছিল। বছরভর ভিড় লেগে থাকত। বিশ্বকর্মা, সরস্বতী পুজো আর পৌষ সংক্রান্তিতে দোকানে কর্মীরা মিলে ঘুড়ি বিক্রি করতে গিয়ে হিমসিম খেতেন। এখন সেই ব্যস্ততা নেই। পাঁচের জায়গায় দোকান কমে দাঁড়িয়েছে তিনে। শুধু তাই নয়, সারা বছর বিক্রি একেবারেই হয় না বলে ব্যবসায়ীদের দাবি। শেওড়াফুলির দুই ঘুড়ি বিক্রেতা তপন সাহা ও প্রভাত দে-র কথায়, ‘‘পুজো পার্বণে একটু বিকিকিনি হয়। না হলে কিছুই নেই। আসলে সকলেই এত ফোন নিয়ে ব্যস্ত! আকাশের দিকে তাকানোর সময়ও নেই।’’
হাওড়ার আন্দুলের ঘুড়িপ্রেমী অপূর্ব সোমের কথায়, ‘‘বাবা-কাকাদের থেকে ঘুড়ি ওড়ানোর হাতেখড়ি। তবে আমার ছেলের এতে কোনও আগ্রহ নেই। ঘুড়ি ওড়াতে হলে খাটুনি আছে। মনে পড়ে, বিশ্বকর্মা পুজোর আগে বন্ধুদের সঙ্গে পাড়ার রাস্তা জুড়ে কাঁচ গুঁড়ো করে সুতোয় মাঞ্জা দিয়েছি। তারপর বাঁশি, শাঁখ, ড্রাম বাজিয়ে ছাদে উঠে চলত ঘুড়ির লড়াই। সে সব দিন হারিয়ে যাচ্ছে।’’
গত কয়েক বছরে এই মাঞ্জারই জায়গা নিয়ে নিচ্ছিল নাইলনের সুতো, যা চিনা মাঞ্জা নামেও পরিচিত ছিল। তবে ওই সুতোয় পাখি, পশু থেকে শুরু করে জখম হচ্ছিলেন সাধারণ মানুষও। প্রাণহানির ঘটনাও কম ঘটছিল না। তবে লাগাতার পুলিশি ধরপাকড়ে এখন সেই সুতোর ব্যবহার কমেছে।
উত্তরপাড়ার বছর সতেরোর এক তরুণের কথায়, ‘‘আমি কখনও ঘুড়ি ওড়াইনি। ওতে কোনও মজাও পাই না।’’ এরই উল্টো সুর শহরের এক অঙ্কের শিক্ষকের গলায়। ঘুড়ি প্রসঙ্গে তিনি মুহূর্তে ফিরে গেলে ছেলেবেলায়। বললেন, ‘‘দেদার ঘুড়ি উড়িয়েছি রীতিমতো উৎসব করে। ঘুড়ি লুটতে বেপাড়ায় যেতাম বলে বাড়ি ফিরে দাদাদের হাতে মার খেয়েছি। কিন্তু এখনকার ছেলেদের মধ্যে সেই উৎসাহ কোথায়? শুধুমাত্র মোবাইলেই বন্দি এখনকার কিশোররা।’’
বাঁশবেড়িয়ার পুরপ্রধান আদিত্য নিয়োগী খামারপাড়ার শিশুদের বিশ্বকর্মা পুজো উপলক্ষে ঘুড়ি, লাটাই, সুতো উপহার দেন। তিনি বলেন, ‘‘এ দিনটা এলেই পুরনো কথা মনে পড়ে। ঘুড়ি ওড়ানোর সঙ্গে কত স্মৃতি জড়িয়ে। সে কারণেই ছোটদের ঘুড়ি ওড়াতে উৎসাহ দিই।’’
এই এলাকারই ৯০ বছরের বৃদ্ধ শ্যামাশিস দাস বলন, ‘‘সুকুমার রায়ের গল্প ‘গোপালের পড়া’-তে পড়া ফাঁকি দিয়ে ঘুড়ি বানাতে গিয়ে মামার কাছে বেদম মার খেয়েছিল গোপাল। তেমন গোপাল আর এখন মেলা ভার! সকলেই ব্যস্ত। কারও সময় নষ্ট করার সময়ই নেই!’’
(তথ্য সহায়তা: সুব্রত জানা, গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রকাশ পাল, সুশান্ত সরকার, কেদারনাথ ঘোষ ও সুদীপ দাস)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy