Advertisement
০৩ মে ২০২৪

ছুঁলেই কেটে ফেলব সব ক’টাকে

রোদ আর গরমে কাহিল হয়ে ঝিমোচ্ছিল রানিনগরের সীমান্ত ঘেঁষা জনপদ, ডিহিরমাঠ। মঙ্গলবার দুপুরে গ্রামের শেষ প্রান্তের বাড়িটা থেকে আচমকা ছিটকে এল এক মহিলার আর্তনাদ— ‘বাঁচাও...।’

জেসমিনের শোকার্ত পরিবার।

জেসমিনের শোকার্ত পরিবার।

নিজস্ব সংবাদদাতা
ডোমকল শেষ আপডেট: ১২ মে ২০১৬ ০১:৫২
Share: Save:

রোদ আর গরমে কাহিল হয়ে ঝিমোচ্ছিল রানিনগরের সীমান্ত ঘেঁষা জনপদ, ডিহিরমাঠ। মঙ্গলবার দুপুরে গ্রামের শেষ প্রান্তের বাড়িটা থেকে আচমকা ছিটকে এল এক মহিলার আর্তনাদ— ‘বাঁচাও...।’

সেই সময় পাশের আমবাগানে বসে জনাকয়েক লোক তাস খেলছিলেন। হাতের তাস মাটিতে ফেলে তাঁরা ছুটে এসে দেখেন, চাঁদিফাটা রোদে বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে নাগাড়ে কেঁদে চলেছে সাড়ে চার বছরের এক শিশু। আদুল গায়ে দরদর করে ঘামছে সে। লোকজন দেখে ঘরের বন্ধ দরজার দিকে হাত তুলে সেই শিশু শুধু বলেছে, ‘‘বাবা মাকে মারছে।’’

ততক্ষণে ছুটে এসেছেন পড়শিরাও। তাঁরা ছুটে গিয়ে দরজা খোলার চেষ্টা করেন। কিন্তু দরজা ভিতর থেকে বন্ধ! ধাক্কা দিয়ে দরজা ভাঙার চেষ্টা করতেই ভিতর থেকে শোনা যায় হুঙ্কার, ‘‘কাউকে আস্ত রাখব না। আমাকে ছুঁলেই কেটে ফেলব।’’ সে হুমকি উপেক্ষা করেই সকলে দরজা ভাঙেন ঠিকই। কিন্তু বছর বত্রিশের সোহেল শেখের সে মূর্তি দেখে কেউ তার কাছে ঘেঁষতে সাহস পাননি।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানাচ্ছেন, ঘরের মধ্যে পড়ে রয়েছে সোহেলের স্ত্রী জেসমিন বিবির (২৭) দেহ। রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারদিক। আর সোহেল মাথার উপরে বনবন করে ঘোরাচ্ছে ধারাল হাঁসুয়া। সে ভাবেই সোহেল ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। তারপর একছুটে এলাকা থেকে পালায়। খবর পেয়ে পুলিশ এসে জেসমিনের দেহ উদ্ধার করে।

পুলিশ জানিয়েছে, জেসমিনকে হাঁসুয়া দিয়ে এলোপাথাড়ি কুপিয়ে খুন করেছে সোহেল। জেলার পুলিশ সুপার সি সুধাকর বলেন, ‘‘একটি খুনের মামলা রুজু করা হয়েছে। অভিযুক্তের খোঁজে তল্লাশিও চলছে। প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে, বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের জেরেই এই খুন।’’ ঘর থেকে জেসমিনকে উদ্দেশ্য করে লেখা এক যুবকের চিঠিও উদ্ধার করা হয়েছে। তবে বুধবার রাত পর্যন্ত সোহেলের নাগাল পায়নি পুলিশ।


সাফিউল্লা ইসলাম উপরে, জেসমিন। — ফাইল চিত্র

বছর দশেক আগে জেসমিনের সঙ্গে বিয়ে হয় সোহেলের। তাদের নয় ও সাত বছরের দুই ছেলে রয়েছে। পেশায় দিমনজুর সোহেলকে ভাল ছেলে বলেই জানতেন এলাকার লোকজন। তবে বছরখানেক থেকে তার স্বভাবে বেশ কিছু পরিবর্তন দেখা যায়। সম্প্রতি সে জুয়ার আসরেও বসত। গত কয়েক মাস থেকে প্রায়ই বাড়িতে এসে স্ত্রীর সঙ্গে অশান্তি করত।

মঙ্গলবার সকাল থেকেই সেই ঝামেলা চরমে ওঠে। ঘটনার সময় সোহেলের ছোট ছেলে বাড়িতে ছিল। বড় ছেলে ছিল শেখপাড়ায়। সোহেলের সাড়ে বছরের ছোট ছেলের সঙ্গে কথা বলে পুলিশ জানতে পেরেছে, ঘটনার কিছুক্ষণ আগে হন্তদন্ত হয়ে বাড়িতে ঢোকে সোহেল। সেই সময় জেসমিন ঘরের কাজ করছিলেন। সঙ্গে ছিল ছোট ছেলে। সোহেল ঘরে ঢুকেই ছেলেকে বাইরে বের করে দিয়ে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেয়। তারপর ঘরে রাখা হাঁসুয়া দিয়ে এলোপাথারি কোপায় জেসমিনকে। ঘটনাস্থলেই মারা যান জেসমিন।

ঘটনার পরে ছুটে আসেন জেসমিনের বাবা সাদেক শেখ। তিনি জানান, বিয়ের সময় সোহেলের কোনও দাবিদাওয়া ছিল না। কিন্তু পরে তার টাকার চাহিদা বেড়েই চলছিল। সম্প্রতি সে জুয়ার ঠেকে প্রচুর পয়সা নষ্ট করত। জেসমিনকে প্রায়ই বাবার বাড়ি থেকে টানা আনতে পাঠাত। সাদেক বলেন, ‘‘আমার দুই মেয়ে। আমরা মারা যাওয়ার পরে সবই তো ওরা পাবে। তাই তেমন কিছু মনে করতাম না। জেসমিনের নামে ওই এলাকায় দু’বিঘা জমিও কিনে দিয়েছি। কিন্তু তারপরেও সোহেল যে এ ভাবে মেয়েটাকে মেরে ফেলবে ভাবিনি।’

তবে জেসমিনের বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের কথা মানতে চাননি সাদেক। তাঁর কথায়, ‘‘এই বিষয়টি নিয়ে অশান্তি থাকলে আমরা নিশ্চয় টের পেতাম। সোহেলও এটা নিয়ে আমাকে জানাত।’’ তিনি জানান, জুয়া খেলা নিয়ে সোহেলের সঙ্গে অশান্তি করে গত বৃহস্পতিবার জেসমিন তাঁর বাড়িতে চলে গিয়েছিলেন। শনিবার সোহেলও যায় শ্বশুরবাড়ি। সেখানে গিয়ে সে সকলের কাছে ক্ষমা চেয়ে রবিবার স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ি ফেরে। সাদেকের অভিযোগ, ‘‘জেসমিনের গলায় একটা সোনার হার ছিল। জুয়া খেলার জন্য সেই হারটাই চেয়েছিল সোহেল। মেয়ে সেটা দিতে চায়নি বলেই তাকে খুন করেছে সোহেল।’’ স্থানীয় বাসিন্দা মিরাজুল শেখ, বুলুয়ারা বিবিদের কথায়, ‘‘এখনও হাঁসুয়া হাতে সোহেলের সেই দৃশ্যটা মনে পড়লে হাড় হিম হয়ে যাচ্ছে। সব থেকে কষ্ট হচ্ছে ছেলে দু’টোর জন্য।’’ ঘটনার পরে অবশ্য সোহেলের দুই ছেলেকেই নিজের বাড়িতে নিয়ে গিযেছেন সাদেক। সাদেক বলছেন, ‘‘বড়টাকে কোনও রকমে খাওয়ানো গিয়েছে। কিন্তু ছোটটা মুখে কিছুই তুলছে না। ঘুমের ঘোরেও সে কেঁপে কেঁপে উঠছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Murder
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE