Advertisement
০৮ ডিসেম্বর ২০২৪
Abhishek Banerjee

আমি নয়, আমরায় বিশ্বাস করি, জীবনে চ‍্যালেঞ্জ আসা ভাল, স্থায়িত্বকে পছন্দ করি না! কেন বললেন অভিষেক

নিজের লোকসভা কেন্দ্র ডায়মন্ড হারবারে আগামী ২ জানুয়ারি থেকে ৭৫ দিন ব্যাপী স্বাস্থ্যশিবির শুরু করছেন অভিষেক। সেই উপলক্ষেই শনিবার আমতলার ‘সমন্বয়’ প্রেক্ষাগৃহে চিকিৎসকদের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন।

I believe in teamwork, says Abhishek Banerjee

অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: ফেসবুক।

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০২৪ ২০:৫৮
Share: Save:

জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন বিষয়ে সংসদে তৃণমূলের অবস্থান কী হবে? বৃহস্পতিবার তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘‘কোনও ব্যক্তিবিশেষ তা ঠিক করবেন না। সংসদীয় দলের নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত নেবেন। তার পর তাঁরা আমায় জানাবেন। আমি মতামত দেব। আমিই সংসদীয় দলের চেয়ারপার্সন!’’

শনিবার তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘‘আমি ‘আমি’তে বিশ্বাস করি না। ‘আমরা’য় বিশ্বাস করি। টিমওয়ার্কে বিশ্বাস করি।’’

প্রসঙ্গ ভিন্ন। পরিস্থিতিও ভিন্ন। কিন্তু ঘটনা পরম্পরায় ৪৮ ঘণ্টার ব্যবধানে শনিবার অভিষেকের ‘আমি’র পাল্টা ‘আমরা’ তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে তৃণমূলের ভিতরে-বাইরে। প্রসঙ্গত, গত সোমবার তৃণমূলের জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠকের একগুচ্ছ সিদ্ধান্তের পর এই প্রথম প্রকাশ্যে মুখ খুললেন অভিষেক। ওই বৈঠকে যে সমস্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, তা থেকে এমন ধারণাই তৈরি হয়েছিল যে, দলের উপর তাঁর ‘নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব’ প্রতিষ্টা করলেন মমতা। যার উল্টো পিঠের মর্মার্থ হল, অভিষেকের ‘মাঠ’ ছোট করে দেওয়া হয়েছে। তৃণমূলের ‘অঘোষিত’ দু’নম্বরকে দিল্লির মুখপাত্রদের তালিকায় রাখা নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা শুরু হয়েছিল দলের মধ্যে। কর্মসমিতির বৈঠকের পরে আনুষ্ঠানিক ভাবে সেই ঘোষণা করেছিলেন মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। পরদিন মঙ্গলবার তৃণমূলের মুখপত্রের প্রভাতী সংখ্যাতেও অভিষেককে ‘দিল্লির মুখপাত্র’ হিসাবেই উল্লেখ করা হয়েছিল। যদিও, চন্দ্রিমার ঘোষণার পরেই অভিষেক-ঘনিষ্ঠদের বক্তব্য ছিল, তাঁকে ‘দিল্লির মুখপাত্র’ করা হয়নি। জাতীয় রাজনীতি এবং সংসদ বিষয়ক বিভিন্ন প্রশ্নে ‘দলের অবস্থান’ ব্যাখ্যা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তার পরেই দেখা যায়, বুধবার সংসদীয় দলের বৈঠকে দলের ‘লাইন’ ঠিক করার ভূমিকা নিয়েছেন অভিষেক। কিন্তু ঠিক তার পরের দিনই মমতা বলেন, কোনও ‘ব্যক্তিবিশেষ’ সংসদে দলের অবস্থান ঠিক করবেন না। সেই প্রেক্ষিতেই অভিষেকের ‘আমি-আমরা’ বক্তব্য বাড়তি ‘তাৎপর্য’ পেয়ে যাচ্ছে।

বস্তুত, অভিষেক শনিবার যা বলেছেন, তার প্রায় প্রতিটি বাক্যেই ‘তাৎপর্য’ নিহিত রয়েছে। তাঁর লোকসভা কেন্দ্র ডায়মন্ড হারবারে অনুষ্ঠিতব্য স্বাস্থ্যশিবির উপলক্ষে চিকিৎসকদের সঙ্গে বৈঠক করেন অভিষেক। সেখানেই তিনি ‘আমি-আমরা’র কথা বলেন। ডায়মন্ড হারবারে যে কাজ হয়েছে, সে প্রসঙ্গে বলতে গিয়েই ‘টিমওয়ার্কের’ কথা উল্লেখ করেন তৃণমূল সাংসদ। কিন্তু পাশাপাশি এ-ও বলেন যে, ‘‘জীবনে চ্যালেঞ্জ আসা ভাল। আমি স্থায়িত্বকে পছন্দ করি না। যদি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন না হন, তা হলে জীবনের মূল্য কী! সব কিছু যদি হাতের নাগালে চলে আসে, তা হলে উদ্দীপনা থাকে না।’’ অভিষেকের এই ‘চ্যালেঞ্জ’ সংক্রান্ত বাক্য নিয়েও আলোচনা শুরু হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, কিসের চ্যালেঞ্জ? কার কাছ থেকে চ্যালেঞ্জ? তাঁকে কোন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে? ‘স্থায়িত্ব’ পছন্দ করেন না বলতেই বা তিনি কী বুঝিয়েছেন? ‘সব কিছু হাতের নাগালে’ বলতে গিয়ে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক যা বলেছেন, তা নিয়েও আলোচনা শুরু হয়েছে দলের অন্দরে। দলের এক প্রথম সারির নেতার ব্যাখ্যা, ‘‘তৃণমূলের মধ্যে অনেকে মনে করেন, অভিষেক দলের মধ্যে পদ বা গুরুত্ব পেয়েছেন উত্তরাধিকার সূত্রে। হাতের নাগালে বলতে উনি সম্ভবত সেই বিষয়েই ইঙ্গিত করেছেন।’’

দলের অনেকেই অভিষেকের শনিবারের বক্তব্যের সঙ্গে জুড়ে দিচ্ছেন শাসক শিবিরের অন্দরের গত এক সপ্তাহের কিছু বেশি সময়ের ঘটনাপ্রবাহকে। সেই ‘মনোভাব’ আরও উস্কে দিয়েছেন অভিষেক স্বয়ং। কারণ, তিনি নিজেই বক্তৃতার শেষে বলেছেন, ‘‘আবেগপ্রবণ হয়ে অনেক কথা বলে ফেললাম।’’ পাশাপাশিই তিনি বলেছেন, ‘‘আমি যা মনে করি সেটাই বলি। অনেকে আমায় বলেন, আমি ডিপ্লোম্যাটিক (কূটনীতিক) হয়ে কথাবার্তা বলতে পারি না। হয়তো তাই। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি কাজ করে দেখাতে হবে।’’ অর্থাৎ, তিনি তাঁর ‘অবস্থান’ (হয় কাজ করে দেখান নতুবা বিদায় নিন) থেকে সরে আসছেন না। ঘটনাচক্রে, লোকসভা ভোটের পরে সরকারের ‘কাজ’ নিয়েই অভিষেক সবচেয়ে আগে সরব হয়েছিলেন। দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হিসাবে তিনি ‘পারফরম্যান্স রিপোর্ট’-ও তৈরি করে পাঠিয়েছিলেন দলের সর্বময় নেত্রী মমতার কাছে। সেই অনুযায়ী তৃণমূলে রদবদলের কথা ছিল। যা এখনও পর্যন্ত হয়ে ওঠেনি।

প্রসঙ্গত, যে ভাবে দলের প্রবীণদের জাতীয় কর্মসমিতিতে যুক্ত করা হয়েছে এবং মুখপাত্রের তালিকা থেকে নবীনদের একাংশকে বাদ দেওয়া হয়েছে, তাকে ‘দলের সিদ্ধান্ত’ বলেই অভিহিত করেছেন অভিষেক। পাশাপাশিই তিনি বলেছেন, ‘‘দল যাঁদের মনে করেছে, তাঁদের নিয়েছে। কিন্তু আগামী দিনে তাঁদের নিজেদের যোগ্যতা, দক্ষতা প্রমাণ করতে হবে।’’ অর্থাৎ, সেই ‘পারফরম্যান্স’-এর উপরেই জোর।

বক্সীকে জিজ্ঞাসা করুন

দু’বছর আগে তৃণমূলের যে জাতীয় কর্মসমিতি তৈরি হয়েছিল, তাতে ছিলেন সুখেন্দুশেখর রায়। রাজ্যসভার সাংসদ সুখেন্দু আরজি কর পর্ব থেকে ‘বেসুরো’। জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠকে তাঁকে ডাকা হয়নি বলে দাবি করেছিলেন তিনি। আবার তৃণমূলের তরফে আনুষ্ঠানিক ভাবে জানানো হয়নি, তাঁকে কর্মসমিতি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে কি না। কারণ, বৈঠকের পরে চন্দ্রিমা কেবল সংযোজনের কথাই বলেছিলেন। বিয়োজনের উল্লেখ করেননি। সুখেন্দুর প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে অভিষেক বলেন, ‘‘জাতীয় কর্মসমিতিতে এ নিয়ে কোনও আলোচনা বা সিদ্ধান্ত হয়নি। ওই বৈঠকের চিঠি পাঠিয়েছিলেন সুব্রত বক্সী। এ বিষয়ে তাঁকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করুন!’’ উল্লেখ্য, বক্সী তৃণমূলের রাজ্য সভাপতি। রাজ্য সভাপতি কী ভাবে জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠক ডাকেন, সেই প্রশ্নও দলের অন্দরে ছিল। অনেকের মতে, অভিষেক সেটাকেই উস্কে দিতে চেয়েছেন। কারণ, বক্সীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ‘মধুর’।

এক্তিয়ার নয়

তৃণমূল সূত্রে জানানো হয়েছিল, গত বুধবার সংসদীয় দলের বৈঠকে অভিষেক বলেছিলেন, সংসদে ‘ব্যক্তিগত’ ভাবে কেউ কিছু বলতে বা করতে পারবেন না। মুলতুবি প্রস্তাব আনা হোক বা অন্য কোনও পদক্ষেপ করতে হলে আগে তা দলকে জানাতে হবে। অনেকেই মনে করেছিলেন, অভিষেকের লক্ষ্য ছিলেন মহুয়া মৈত্র এবং সৌগত রায়। কারণ, মহুয়া আদানি নিয়ে ‘উচ্চকিত’ ছিলেন। যদিও তৃণমূল দলগত ভাবে আদানি নিয়ে ‘উদ্যোগী’ হয়নি। কারণ, তারা মনে করেছে, দুর্নীতির ‘ছাপ’ ভোটের বাক্সে পড়ে না। দ্বিতীয়ত, আদানি ‘ইস্যু’ মূলত কংগ্রেস তথা রাহুল গান্ধীর। তৃণমূল তার ‘লেজুড়’ হতে চায় না। যে ভাবে আদানি-প্রশ্নে রোজ সংসদ অচল হয়ে থাকছে, তা-ও তৃণমূল সমর্থন করে না বলে জানিয়েছিলেন দলের লোকসভার নেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু এর মধ্যেই দমদমের সাংসদ সৌগত বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা চেয়ে লোকসভার স্পিকারকে চিঠি লিখেছেন। যদি তৃণমূলের সংসদীয় দলের অনেকেই তা জানেন না বলে দাবি। সেই প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে অভিষেক বলেন, ‘‘এটা আমার এক্তিয়ার নয়। এ নিয়ে যা বলার সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলবেন।’’

সেতুবন্ধন ১

আগামী ২ জানুয়ারি থেকে ৭৫ দিন ব্যাপী স্বাস্থ্যশিবির শুরু করছেন অভিষেক। সেই উপলক্ষেই শনিবার আমতলার সমন্বয় প্রেক্ষাগৃহে চিকিৎসকদের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন এলাকার সাংসদ। ১,২০০ চিকিৎসক উপস্থিত ছিলেন সেই কর্মসূচিতে। যে কর্মসূচিকে আরজি কর পরবর্তী পরিস্থিতিতে চিকিৎসকদের সঙ্গে ‘সেতুবন্ধন’-এর উদ্যোগ বলেই ব্যাখ্যা করেছিলেন ওয়াকিবহালেরা। বাস্তবেও তেমনই ঘটেছে। অভিষেক আহূত ‘ডক্টর্স সামিট’-এর ছত্রে ছত্রে জুড়ে ছিল আরজি কর। সঞ্চালক চিকিৎসক অভীক ঘোষ ‘সেবাশ্রয়’ কর্মসূচির ‘পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন’ প্রদর্শনের পরে প্রথম বক্তা হিসাবে নাম ঘোষণা করেন বজবজের বিধায়ক অশোক দেবের। কিন্তু অশোককে থামিয়ে দেন অভিষেক। তাঁর নির্দেশে আরজি করের নির্যাতিতার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নীরবতা পালনের পরে শুরু হয় কর্মসূচি। শনিবারের কর্মসূচি থেকেই অভিষেক ঘোষণা করেছেন, পয়লা বৈশাখের আগে কলকাতার নজরুল মঞ্চ বা নেতাজি ইন্ডোরে পাঁচ হাজার চিকিৎসককে নিয়ে তিনি আরও বড় আকারের সম্মেলন করবেন।

সেতুবন্ধন ২

তৃণমূল সাংসদ অভিষেক জানিয়েছেন, আরজি করে চিকিৎসক তরুণীর ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনার পরে তিনি ঠিক করেছেন, ধর্ষণ-বিরোধী কঠোর আইন প্রণয়নের জন্য তিনি সংসদে প্রাইভেট মেম্বার্স বিল আনবেন (প্রতি শুক্রবার অধিবেশনের দ্বিতীয়ার্ধ্বে ওই বিল আনা যায়। সাংসদেরা একক ভাবে ওই বিল আনতে পারেন)। তাঁর কথায়, ‘‘কেন্দ্রীয় সরকার চাইলে এক দিনে ধর্ষণের অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোরতম আইন আনতে পারে। কিন্তু সেটা তারা করছে না। আমি সংসদে ওই বিষয়ে প্রাইভেট মেম্বার্স বিল আনব! আমার সঙ্গে কেউ থাকুক বা না-থাকুক!’’ পাশাপাশি, রাজ্য বিধানসভা পাশ-হওয়া ‘অপরাজিতা’ বিলের কথাও উল্লেখ করেছেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘এই বিলে রাষ্ট্রপতি ছাড়পত্র দিলে তা আইন হয়ে যাবে। কঠোর আইন না হলে ধর্ষণ রোধ করা যাবে না। আন্দোলন, প্রতিবাদ হোক। কিন্তু ওটা দিয়ে ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধ ঠেকানো যাবে না।’’

সেতুবন্ধন ৩

দু’বছর আগে নিজের কেন্দ্রের বাসিন্দাদের সমস্যা সমাধানে একটি ‘হেল্পলাইন নম্বর’ চালু করেছিলেন অভিষেক। সেই কর্মসূচির নাম দিয়েছিলেন ‘এক ডাকে অভিষেক’। সেই নম্বরটিই এ বার কাজ করবে সারা রাজ্যের চিকিৎসকদের ‘সমস্যা’ সমাধানে। বৈঠকে অভিষেক বৈঠকে উল্লেখ করেন, চিকিৎসকদের অনেক সময়ে ‘অপ্রীতিকর’ পরিস্থির মধ্যে পড়তে হয়। কেউ কোনও সমস্যায় পড়লে ওই নম্বরে ফোন করলে অভিষেকের টিম যথাসম্ভব সাহায্য করবে। তৃণমূল সাংসদ জানিয়েছেন, শুধুমাত্র চিকিৎসকদের সমস্যা সমাধানে তিনি ১০ জনের পৃথক একটি টিম গঠন করছেন। তাঁরা সব সময় চিকিৎসকদের পাশে থাকবেন।

অন্য বিষয়গুলি:

Abhishek Banerjee Tmc Leader
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy