Advertisement
E-Paper

বাবা থাকলে পারতে না! ডাকাতকে বলল কচি মেয়ে

সবে তিন মাস হয়েছে, বাবা মারা গিয়েছেন। ন’বছরের মেয়েটা এখনও ঘুমের মধ্যে কেঁদে ওঠে। মাঝরাত্তিরে ডাকাতদল যখন ঘরে ঢুকে লুঠপাট চালাচ্ছে, একরত্তি ঋতরাজ্ঞী বলে ফেলেছিল, ‘‘বাবা থাকলে এমন করতে পারতে না!’’

বিতান ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৩:২৮
ভেঙে পড়েছেন গীতা বর্মন। -নিজস্ব চিত্র

ভেঙে পড়েছেন গীতা বর্মন। -নিজস্ব চিত্র

সবে তিন মাস হয়েছে, বাবা মারা গিয়েছেন। ন’বছরের মেয়েটা এখনও ঘুমের মধ্যে কেঁদে ওঠে। মাঝরাত্তিরে ডাকাতদল যখন ঘরে ঢুকে লুঠপাট চালাচ্ছে, একরত্তি ঋতরাজ্ঞী বলে ফেলেছিল, ‘‘বাবা থাকলে এমন করতে পারতে না!’’

এত বড় ‘অপরাধ’টা ক্ষমা করেনি ডাকাতরা। ওইটুকু মেয়েকে বেদম গালাগালি করে, গলায় ভোজালি ঠেকিয়ে, মুখে বালিশ চাপা দিয়ে, হাত মুচড়ে খুলে নিয়ে গিয়েছে ইমিটেশনের আংটি। শুক্রবার রাতে বেলঘরিয়ার আদর্শনগরের ঘটনা।

বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে এমনিতেই মন খারাপ করে বসে থাকে মেয়েটা। ঠিক করে খেতে চায় না। স্বপ্ন দেখে ডুকরে ওঠে। কষ্টে কুঁকড়ে থাকা সেই মনটাকেই আবার খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করে দিয়ে গেল ডাকাতেরা। পঁয়তাল্লিশ মিনিটের ওই বিভীষিকার পরে ট্রমা বা আতঙ্ক গ্রাস করেছে তাকে। ঋতরাজ্ঞীকে ডাক্তাররা ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছেন।

ঋতরাজ্ঞীর মা আর ঠাকুমা? শনিবার সন্ধেতেও স্বাভাবিক হতে পারেননি তাঁরাও। তিন মাস আগে হারিয়েছেন রাজীবকে। ঋতরাজ্ঞীর বাবা। উত্তর ২৪ পরগনা জেলাশাসকের দফতরে কাজ করতেন। বছরখানেক আগে মারাত্মক ডায়াবেটিস ধরা পড়ল। বিকল হয়ে গেল দু’টি কিডনিই। বছর কয়েক আগে এই অসুখই হয়েছিল রাজীবের বাবারও। তিনি বাঁচেননি। বাঁচলেন না ছেলেও। সেই শোক, টাকার টানাটানি, সঙ্গে ভবিষ্যতের চিন্তা। তার মধ্যে বাড়িতে এই আকস্মিক ডাকাতি টাকাপয়সা-গয়নাগাটি যেটুকু ছিল তো নিলই, পাশাপাশি ভেঙে দিয়ে গেল কোনও মতে ঘুরে দাঁড়ানোর মনের জোরটুকুও। বাচ্চা মেয়েটাকে কী করে একটু স্বাভাবিক রাখা যায়, সেই ভাবনায় এমনিতেই জেরবার হচ্ছিলেন সকলে। এখন কচি মনের উপরে নতুন করে এই আঘাতকে কী করে সারিয়ে তুলবেন, জুড়ে গেল সেই দুশ্চিন্তাও।

আদর্শ নগরের এক দিকে রামকৃষ্ণ মিশনের ফাঁকা জমি, অন্য দিকে বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে। কর্পোরেশন স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষিকা, ঋতরাজ্ঞীর ঠাকুমা উমা বর্মনের একতলা বাড়িতে বাসিন্দা তিন জন। উমা (৭০), পুত্রবধূ গীতা (৩৮) এবং শিশুকন্যা ঋতরাজ্ঞী। ওঁরা ভয় পান বলে গীতার দিদি রেখা মিত্র রাতটুকু এখানে কাটান। পরিবারে রোজগার বলতে উমার হাজার সাতেক টাকা পেনশন। দু’দিন আগে দু’মাসের পেনশন তুলে ঘরে রেখেছিলেন।

গীতাদেবীর অভিযোগ, শুক্রবার রাত ২টো নাগাদ সাত জন ডাকাতের একটি দল বাড়িতে চড়াও হয়। সামনে কোলাপসিবল গেটের দু’টি তালা তারা চাড় দিয়ে ভাঙে। এর পর ঘরে ঢোকার মূল দরজাটির ছিটকিনিও ধাক্কা দিয়ে ভেঙে ফেলে। দু’কামরার বাড়ির প্রথম ঘরটিতে ঘুমিয়েছিলেন উমাদেবী আর ভিতরের ঘরে বাকি তিন জন। অভিযোগ, প্রথমে উমাদেবীর গলা টিপে ধরে আলমারির চাবি দিতে বলে এক দুষ্কৃতী। মাথায় পাইপগানের নল চেপে ধরে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। বাকিরা মাঝের দরজায় ধাক্কা দিতে থাকে। শাশুড়ির কিছু হয়েছে ভেবে দরজা খুলে দেন গীতা। হুড়মুড়িয়ে জনা পাঁচেক ডাকাত ঢুকে পড়ে ভিতরে। ঋতরাজ্ঞীর গলায় ভোজালি ধরে হুকুম করে, ‘‘গয়না-টাকা-মোবাইল বের করে দিন!’’ রেখাদেবী বাধা দিয়ে বলেন, ‘‘ওইটুকু মেয়ের গলায় ভোজালি ধরেছেন কেন? কেটে যাবে তো!’’ দুষ্কৃতীরা সপাটে থাপ্পড় কষিয়ে দেয় তাঁকে। আলমারি হাঁটকে যা নেওয়ার নিয়ে তিন মহিলার হাতে, গলায় যেটুকু গয়না ছিল, সেটুকুও খুলে নেয় তারা।

গীতাদেবী অনুরোধ করেছিলেন, ‘‘মেয়েটাকে কিছু করবেন না।’’ কিন্তু ততক্ষণে এক জনের নজর চলে গিয়েছে ঋতরাজ্ঞীর মধ্যমায় নতুন আংটিটার দিকে। শুক্রবারই এক আত্মীয়া কিনে দিয়েছিলেন ঝুটো আংটি। সোনা ভেবে সেটিকে খুলে নেওয়ার চেষ্টা করলে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে ঋতরাজ্ঞী। অমনি সজোরে একখানা চড় এসে পড়ে তার নরম গালে। দুঃখী মেয়েটা তখনই বলে ফেলেছিল বাবার কথা। যেই না বলা, শুরু হয়ে গেল অকথ্য গালাগাল। কান্নার আওয়াজ চাপতে মুখে বালিশ ঠেসে ধরল ডাকাতরা। ওইটুকু মেয়ের হাত মুচড়ে সত্যিই খুলে নিয়ে গেল আংটি। শনিবারও ঋতরাজ্ঞীর নীল হয়ে থাকা গালে পাঁচ আঙুলের ছাপ।

গীতাদেবীর কথায়, ‘‘শ্বশুর আর স্বামীর চিকিৎসা করাতে গিয়ে আমরা নিঃস্ব হয়ে গিয়েছি। তবু মেয়েটাকে আগলে রাখতাম। কেউ কোনও দিন ওর গায়ে হাত তোলেনি।’’ কত সাধ করে দু’জনে নাম রেখেছিলেন ‘ঋ়তরাজ্ঞী’। বাবার বড় আদরের মেয়ে যে! বাবাই স্কুলে নিয়ে যেতেন! প্রতি রবিবার বাবার হাত ধরে বাজারও যেত মেয়ে। সেই মেয়েকে কি না মার খেতে হল ডাকাতের হাতে! মানতে পারছেন না বাড়ির কেউই।

গীতা-উমা-রেখা ডাকাতদের মুখ দেখতে পাননি। ‘‘ওদের মুখ ঢাকা ছিল। কিন্তু বাংলায় কথা বলছিল,’’ জানালেন ওঁরা। দুষ্কৃতীরা চলে যাওয়ার পর এক দাদাকে খবর দেন গীতা। তিনিই পুলিশকে জানান। প্রথমে নিমতা থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। পরে বেলঘরিয়া থানার পুলিশও পৌঁছয়। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের অনুমান, বাড়িতে শুধু মহিলারা আছেন জেনেই হানা দিয়েছিল ডাকাতেরা। রাজীবের কর্মস্থল থেকে মোটা টাকা পাওয়া গিয়েছে বলে ভেবেছিল তারা। ব্যারাকপুর কমিশনারেটের গোয়েন্দা প্রধান অজয় ঠাকুর বলেন, ‘‘তল্লাশি শুরু হয়েছে। সব থানাকে সচেতন করা হয়েছে।’’ এলাকাবাসীর অভিযোগ, আদর্শনগর চিরকালই অপরাধের মুক্তরাজ্য। বারবার বলেও এলাকায় টহলদারি বাড়ানো হয়নি।

MostReadStories
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy