কোনও হাসপাতাল বা নার্সিংহোমে রোগীর অস্ত্রোপচার হয়েছে। রোগীর শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে শুরু করল অস্ত্রোপচার চলাকালে বা তা শেষ হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে। দ্রুত তাঁকে ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ)-এ রাখার দরকার পড়ল। কিন্তু দেখা গেল, হাসপাতালে সেই পরিকাঠামো নেই। রোগীকে অন্য জায়গায় ‘রেফার’ করা দরকার। শুরু হয়ে গেল সেই তোড়জোড়...।
এত দিন দেশ জুড়ে শত শত হাসপাতাল বা নার্সিংহোম চলেছে এই প্রক্রিয়াতেই। কিন্তু পরিস্থিতি আমূল বদলে গিয়েছে বৃহস্পতিবারের পরে। আশঙ্কার মেঘ আইসিইউ-বিহীন হাসপাতাল বা নার্সিংহোম মালিকদের মুখে। ব্যবসা বন্ধ করতে হবে কি না, সেই চিন্তায় তাঁরা দিশাহারা।
সব কিছুর মূলে বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়। কলকাতার এক রোগীর পরিবারের তরফে ২৩ বছর আগে দায়ের করা চিকিৎসা-গাফিলতির মামলায় রায় দিতে গিয়ে শীর্ষ আদালত বলেছে, আইসিইউ নেই, এমন হাসপাতাল বা নার্সিংহোমে কোনও অস্ত্রোপচার করা যাবে না। কারণ, তাতে রোগীর প্রাণের ঝুঁকি থাকে। দরকার পড়লেও সময়মতো আইসিইউয়ে রেখে তাঁর চিকিৎসা চালানো সম্ভব হয় না।
এতেই মাথায় হাত পড়েছে এ রাজ্যের অনেক নার্সিংহোম এবং হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষের। এমনকী সমস্যায় পড়ে গিয়েছে রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরও। কারণ, সারা বাংলায় এমন অনেক সরকারি গ্রামীণ হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, মহকুমা হাসপাতাল রয়েছে, যেখানে এখনও আইসিইউ নেই। প্রশ্ন উঠছে, তা হলে কি সেই সব জায়গায় সিজার (অস্ত্রোপচার করে প্রসব) বা অন্যান্য অস্ত্রোপচার বন্ধ হয়ে যাবে? স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীর উত্তর, ‘‘আমি সুপ্রিম কোর্টের রায়ের প্রতিলিপি দেখিনি। ফলে এখনই এই বিষয়ে কিছু বলতে পারব না।’’ প্রশ্ন উঠছে পুরসভা পরিচালিত কিছু মাতৃসদনের ক্ষেত্রেও। সেখানে সিজার হয়, কিন্তু আইসিইউ নেই। কী উপায় হবে?
আরও পড়ুন: বাংলা, ইংরেজি, হিন্দিতে ‘বাংলা’ই চাইছে রাজ্য
নার্সিংহোম-মালিকেরা জানাচ্ছেন, এ রাজ্যে প্রায় সাড়ে বাইশ হাজার নার্সিংহোম রয়েছে। এবং তার ৮০ শতাংশেই আইসিইউ নেই। নার্সিংহোমে আইসিইউ পরিকাঠামো থাকলে বেড়ে যাবে চিকিৎসার খরচ। কতটা? যেখানে আইসিইউ নেই, সেখানে সিজার করতে খরচ হয় আট হাজার টাকা। কিন্তু আইসিইউ থাকলেই খরচ বেড়ে হবে কুড়ি হাজার। অ্যাপেনডিক্স অপারেশনে এমনিতে চার হাজার টাকা লাগে। আইসিইউ পরিকাঠামো থাকলে তার খরচ বেড়ে হবে প্রায় পনেরো হাজার। অনেকেই সেই বাড়তি টাকা দিতে পারবেন না। মার খাবে নার্সিংহোম।
এক নার্সিংহোম-মালিক জানান, সরকারি হাসপাতালে সকলে জায়গা পান না। তাঁরা অপেক্ষাকৃত কম টাকায় পরিষেবা পেতে বেসরকারি হাসপাতাল বা নার্সিংহোমে যান। ‘‘সেই পথটাও বন্ধ হয়ে গেলে তো তাঁদের চিকিৎসাই হবে না। আর সরকারি হাসপাতালগুলিতে জায়গা পেতে মারামারি চরমে পৌঁছবে,’’ বললেন ওই নার্সিংহোম-মালিক। বেঙ্গল নার্সিংহোম অ্যাসোসিয়েশনের তরফে শেখ আলহাজারউদ্দিন বলেন, ‘‘বিষয়টি পুনর্মূল্যায়ন করার জন্য আমরা আদালতে আর্জি জানাব।’’
মাস দুয়েক আগে রাজ্যের নতুন স্বাস্থ্য-বিধির কয়েকটি ধারা পরিবর্তনের দাবিতে ধর্মঘট করেছিল কিছু নার্সিংহোম। তখন বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম, দক্ষিণ ২৪ পরগনা-সহ কয়েকটি জেলায় স্বাস্থ্য পরিষেবা ভেঙে পড়েছিল। সরকারি হাসপাতালে পর্যাপ্ত পরিষেবা না-পেয়ে অসংখ্য রোগীকে ফিরে যেতে হয়। তাই আইসিইউ পরিকাঠামো না-থাকলে যদি নার্সিংহোমে অস্ত্রোপচার বন্ধ হয়ে যায়, তা হলে পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে, সেই বিষয়ে চিকিৎসক শিবিরের একাংশ চিন্তিত। ‘‘সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পুরোটা এখনও জানি না। আগে পুরো নির্দেশ জানতে হবে। তার পরে দেখতে হবে, কী করা যায়,’’ অ্যাসোসিয়েশন অব হসপিটালস অব ইস্টার্ন ইন্ডিয়ার তরফে বললেন এমপি মেটা।