Advertisement
E-Paper

একই দিনে মালদহে রাজ্যপাল, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এবং মহিলা কমিশন! ধুলিয়ানে শান্তি বৈঠকে কাটল তাল

শুক্রবার মালদহে গিয়েছিলেন রাজ্যপাল। একই দিনে ওই জেলায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এবং জাতীয় মহিলা কমিশনের প্রতিনিধিরা। শনিবার তাঁদের সকলের যাওয়ার কথা রয়েছে মুর্শিদাবাদে। তবে আলাদা ভাবে।

গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০২৫ ০০:০২
Share
Save

সংশোধিত ওয়াকফ আইনের বিরোধিতায় সপ্তাহব্যাপী উত্তেজনার পরে আপাতত ‘শান্ত’ মুর্শিদাবাদের শমসেরগঞ্জ, সুতি, ধুলিয়ানের মতো এলাকা। দক্ষিণ মালদহ লোকসভার অন্তর্গত এবং মুর্শিদাবাদ জেলার ওই এলাকাগুলির পরিস্থিতি বুঝতে এবং ক্ষতিগ্রস্তদের অবস্থা জানতে একই দিনে হাজির হয়েছিল জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এবং জাতীয় মহিলা কমিশনের প্রতিনিধি দল। শুক্রবার, একই দিনে মালদহে যান রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসও। তার মধ্যে ধুলিয়ানে পিতা-পুত্র খুনে নতুন তথ্য উঠে এল পুলিশ সূত্রে। আবার স্থানীয় প্রশাসন এবং ব্যবসায়ীদের নিয়ে ধুলিয়ানের ‘শান্তি বৈঠকে’ উঠল ভিন্ন দাবি। কী ঘটল সারা দিন?

শুক্রবার সকালে বন্দে ভারত এক্সপ্রেসে মালদহে পৌঁছোয় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের একটি প্রতিনিধিদল। বৈষ্ণবনগরের পারলালপুর হাই স্কুলে আশ্রয় শিবির পরিদর্শন করে তারা। মূলত ধুলিয়ানে অশান্তির ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলি সেখানে উঠেছে। তিন সদস্যের প্রতিনিধি দল বেশ কিছু সময় ধরে ওই পরিবারগুলির সঙ্গে কথা বলে। পাশাপাশি, অশান্তির দিনের ঘটনা এবং বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে খোঁজখবর করে তারা। অন্য দিকে, বেলা ১২টা নাগাদ মালদহের বৈষ্ণবনগরে জাতীয় মহিলা কমিশনের প্রতিনিধি দল পৌঁছোয়। তারাও পারলালপুরের আশ্রয় শিবিরে গিয়েছিল। কিন্তু কমিশনের সদস্যেরা আশ্রয়শিবির ছাড়তেই পুলিশকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখান ঘরছাড়ারা। তাঁদের অভিযোগ, নিজেদের আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করতে পারছেন না। তা ছাড়া এখনও আতঙ্ক-ভয়ে বাড়ি যেতে পারছেন না। বস্তুত, সংশোধিত ওয়াকফ আইনের প্রতিবাদের নামে শুরু হওয়া গোলমালের জেরে গত শুক্রবার বিকেল থেকে নৌকায় গঙ্গা পেরিয়ে ধুলিয়ানের বেতবোনা, বাজারপাড়া ও হাতিচিত্রা এলাকার কমপক্ষে ৪০০ জন আশ্রয় নেন পারলালপুর হাই স্কুলে। শুক্রবার সকালে আশ্রয় শিবিরে থাকা বিশ্বজিৎ প্রামাণিকের পরিবারের পাঁচ জন এবং পারুল মণ্ডল নামে এক মহিলাকে প্রশাসনের তরফে গাড়ি করে পারলালপুরের ফেরিঘাট পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া হয়। বিশ্বজিৎ বলেন, ‘‘পুলিশ-প্রশাসন আশ্বাস দেওয়ায় বাড়িতে ফিরলাম। এখন এলাকায় বিএসএফ এবং পুলিশ রয়েছে। কিন্তু তারা ফিরে গেলে, কী হবে জানি না! আতঙ্ক আছেই।’’ জয়ধন মণ্ডল নামে আর এক জন অবশ্য আশ্রয় শিবির থেকে বাড়ি ফিরেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘পুলিশ-প্রশাসনের আশ্বাসে ফিরলাম। কিন্তু একটা আতঙ্ক ভিতরে কাজ করছে।’’ জাফরাবাদের বাসিন্দা শরৎ দাস বলেন, “বাড়ির মহিলাদের আনা হয়নি। ভয়ে ভয়ে ছেলেরাই ফিরেছি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে, মহিলাদের নিয়ে আসব।”

মালদহে জাতীয় মহিলা কমিশনের প্রতিনিধিরা

মুর্শিদাবাদের অশান্তির ঘটনায় স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে পদক্ষেপ করেছে জাতীয় মহিলা কমিশন। বৈষ্ণবনগরে একটি স্কুলে আশ্রয় নেওয়া পরিবারগুলির সঙ্গে কথা বলেন মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন বিজয়া রাহাতকর। সকলের অভিজ্ঞতা এবং কষ্টের কথা শোনার পর বিজয়ার মন্তব্য, ‘‘মহিলাদের সঙ্গে কী ভাবে এ সব হতে পারে! মহিলারা যা বললেন, তা কল্পনার বাইরে। যৌন নিপীড়নও হয়েছে। আমি তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছি। আরও কথা বলতে হবে।’’ জাতীয় মহিলা কমিশনের সদস্য অর্চনা মজুমদারের মন্তব্য, “মহিলারা বলছেন, আমরা শুধু সেন্ট্রাল ফোর্স (কেন্দ্রীয় বাহিনী) চাই। আমরা সম্মান নিয়ে বাঁচতে চাই। ওখানে মেয়েদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে, ‘বাড়িতে থাকলে ধর্ষণ হয়ে যাবি। চলে যা।’’’ তাঁর অভিযোগ, ‘‘ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। তবে আমরা যা যা করার করব।” অন্য দিকে, ঘরছাড়া মহিলারা দাবি করেছেন, তাঁদের সঙ্গে যা হয়েছে, সে সব তাঁরা জানিয়েছেন জাতীয় মহিলা কমিশনের সদস্যদের। শনিবার মুর্শিদাবাদের হিংসা কবলিত এলাকাগুলি পরিদর্শন করবেন জাতীয় মহিলা কমিশনের প্রতিনিধিরা। এর মধ্যে শুক্রবার শমসেরগঞ্জের ট্রাফিক গার্ডের ভস্মীভূত অফিসে তদন্তে গিয়েছেন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা। ঘটনাস্থল থেকে নমুনা সংগ্রহ করেছেন তাঁরা।

মালদহে রাজ্যপাল, বিক্ষোভ!

মুর্শিদাবাদের অশান্তিতে যাঁরা ঘরছাড়া হয়েছেন বলে অভিযোগ, তাঁদের একাংশকে নিয়ে গত বৃহস্পতিবার রাজভবনে গিয়েছিলেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার-সহ অন্যেরা। রাজ্যপালের কাছে তাঁরা পাঁচ দফা দাবি পেশ করেন। শমসেরগঞ্জ এবং ধুলিয়ানে গিয়ে পরিস্থিতি দেখার অনুরোধ করেন। সুকান্তের দাবি, সেই অনুরোধে সাড়া দিয়েই রাজ্যপাল মালদহ-মুর্শিদাবাদ সফরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তবে রাজ্যপালের সফর প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় মন্তব্য করেন, ‘‘আমি রিকোয়েস্ট করব, বাইরে থেকে এখন কেউ যাবেন না। আমিও তো যেতে পারতাম। যাইনি। আমি গেলে অন্যেরাও যেতে চাইবেন। আমাদের (রাজ্য) মহিলা কমিশনের টিমও যেতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি বলেছি, এখনই যেতে হবে না।’’ মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেছিলেন, ‘‘ওখানে শান্তির বাতাবরণ ফিরে এসেছে। এখন কাজ কনফিডেন্স বিল্ডিং (আস্থা তৈরি করা)। সেই কাজ চলছে।’’ তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তিনি মুর্শিদাবাদে যাবেন বলেও জানিয়েছেন মমতা। কিন্তু তাঁর অনুরোধ না-রেখেই শুক্রবার মালদহে যান রাজ্যপাল। তবে বৈষ্ণবনগরে ঘরছাড়াদের আশ্রয় শিবিরে রাজ্যপাল পৌঁছোনোর পর শুরু হয় বিক্ষোভ। তিনি যখন শিবিরের ভিতরে ঘরছাড়াদের সঙ্গে কথা বলছেন, তখন বাইরে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করেন স্থানীয়দের একাংশ। বিক্ষোভকারীদের দাবি, ঘরছাড়াদের সঙ্গে রাজ্যপালের কী কথা হল, তা সংবাদমাধ্যমের সামনে জানাতে হবে। শুধু তা-ই নয়, অনেকেই পুলিশি ব্যারিকেড টপকে ক্যাম্পের মধ্যে ঢুকে রাজ্যপালের সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। পরিস্থিতি ক্রমশ হাতের বাইরে যাচ্ছিল। বিক্ষোভকারীদের মধ্যে অনেকেই মহিলা ছিলেন। তাঁদের আটকাতে আনা হয় মহিলা পুলিশ। মোতায়েন করা হয় র‌‍্যাফ। আনা হয় কাঁদানে গ্যাসের শেল। যদিও শেল ফাটানোর খবর মেলেনি। পরে রাজ্যপাল বলেন, ‘‘সমাজের একটা নির্দিষ্ট সম্প্রদায় এখানে আক্রান্ত হয়েছে। এক দল মারবে, আর এক দল আক্রান্ত হবে, এটা কখনও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় হতে পারে না।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘এখানে যে অশান্তি হয়েছে, তা কোনও সুস্থ মানুষের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। আমি এখানে মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি, বাচ্চাদের সঙ্গে কথা বলেছি, এখানে ভয়ের পরিস্থিতি রয়েছে। এর মধ্যে মানুষ বেঁচে থাকতে পারেন না।’’ রাত সাড়ে ৯টা নাগাদ মালদহ থেকে মুর্শিদাবাদে পৌঁছোন রাজ্যপাল। রাতটুকু ফরাক্কার গঙ্গাভবন গেস্ট হাউসে থেকে শনিবার শমসেরগঞ্জে যাওয়ার কথা তাঁর।

বাড়ি ফিরুন, আর্জি জেলাশাসকরে

শুক্রবার শমসেরগঞ্জ থানার বিস্তীর্ণ এলাকা ঘুরে দেখেন মুর্শিদাবাদের জেলাশাসক রাজর্ষি মিত্র। তাঁর সঙ্গে ছিলেন জঙ্গিপুর পুলিশ জেলার সুপার আনন্দ রায়। ঘরছাড়া পরিবারগুলিকে দ্রুত ঘরে ফেরার আর্জি জানিয়ে জেলাশাসক বলেন, ‘‘সকলে যাতে আবার সুস্থ ভাবে থাকেন, সে জন্য প্রশাসনের তরফে যাবতীয় সাহায্য করা হচ্ছে।’’ তিনি জানান, শমশেরগঞ্জের বেদবোনা, পালপাড়া, সাহাপাড়া, জাফরাবাদ প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকা এবং ধুলিয়ান পুরসভার ঘোষপাড়া সংলগ্ন এলাকার পরিস্থিতি বিস্তারিত ভাবে খতিয়ে দেখা হয়েছে। অনেকে বাড়ি ফিরেছেন। বাকিরাও যেন বাড়ি ফেরেন। বাড়িঘর মেরামত করার জন্য যে সমস্ত ইমারতি দ্রব্য দরকার, জেলা প্রশাসনের তরফে সেগুলো দেওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি। জঙ্গিপুর পুলিশ জেলার সুপার আনন্দ জানান, জঙ্গিপুর মহকুমার বিভিন্ন এলাকায় যে হিংসার ঘটনা ঘটেছে, তাতে মোট ১২২টি মামলা রুজু করা হয়েছে। এখনও পর্যন্ত ২৭৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ধৃতদের এক জন ভিন্‌রাজ্যের বাসিন্দা।

বাবা-ছেলে ব্যক্তিগত আক্রোশে খুন?

ধুলিয়ানে বাবা-ছেলের খুনের ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছেন ইনজামাম হক নামে এক ব্যক্তি। পেশায় ইলেকট্রিক মিস্ত্রি ইনজামামের উপর ওই পিতা-পুত্রের ব্যক্তিগত আক্রোশ ছিল বলে পুলিশের দাবি। জানা যাচ্ছে, নিহতদের বাড়ির সামনে একটি বৈদ্যুতিন খুঁটিতে কাজ করা নিয়ে কিছু দিন আগে বচসা হয়েছিল ইনজামামের। পরে তা মিটেও যায়। তবে রাগ পুষে রেখেছিলেন ইনজামাম। অশান্তির সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বাবা-ছেলেকে আক্রমণ করেন তিনি। ওই খুনের ঘটনায় আরও কয়েক জন জড়িত। তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। জঙ্গিপুর পুলিশ জেলার সুপার বলেন, ‘‘তদন্তে অনেকগুলি দিক উঠে এসেছে। ইনজামাম হক খুন হওয়া দুই ব্যক্তির পূর্বপরিচিত ছিলেন বলে প্রাথমিক ভাবে জানা গিয়েছে। আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলেছে, সেগুলো এখনই বলা সম্ভব নয়।’’

ধুলিয়ানে শান্তি বৈঠক

শুক্রবার ধুলিয়ান পুরসভা লাগোয়া মিলন মন্দিরের সামনে শান্তি বৈঠক ডাকা হয় স্থানীয় রাজনৈতিক দল এবং ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে। সেখানে ছিলেন জঙ্গিপুরের তৃণমূল সাংসদ খলিলুর রহমান, সাগরদিঘির বিধায়ক বাইরন বিশ্বাস, শমসেরগঞ্জের তৃণমূল বিধায়ক আমিরুল ইসলাম, তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ সামিরুল ইসলাম প্রমুখ। সেখানে পুলিশের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় বাহিনীর স্থায়ী ক্যাম্পের দাবি জানান স্থানীয় মন্দির কমিটির সদস্য ষষ্ঠীচরণ ঘোষ। তিনি বলেন, ‘‘শমসেরগঞ্জের কাছেই বাংলাদেশ। জঙ্গিরা বা মৌলবাদীরা এখানের ছোট ছোট শিশুদের ‘ব্রেনওয়াশ’ করছে। তাই এখানে এই ধরনের হামলা হল। পুলিশ কী করেছে, প্রত্যেকে জানে। তাই কেন্দ্রীয় বাহিনীকে থাকতে হবে। প্রশাসনের উচিত এখানে কেন্দ্রীয় বাহিনীর স্থায়ী ক্যাম্প করার জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা নেওয়া।” এ নিয়ে চাপানউতোর তৈরি হয়। পরে শমসেরগঞ্জের বিধায়ক বলেন, “গণতান্ত্রিক ভাবে প্রত্যেকের অধিকার আছে কিছু বলার। এখন আমরা এলাকার শান্তির বিষয়টিতে গুরুত্ব দিচ্ছি। প্রশাসন যা দেখার দেখবে।”

Murshidabad Governor CV Ananda Bose Maldah

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}