Advertisement
E-Paper

মৌখিকে পাশের শর্ত জুড়ে তাজ্জব তালিকা

অভিযোগের পালা যেন আর শেষ হচ্ছে না। অনিয়মের অভিযোগ। যাতে ফের বিদ্ধ পশ্চিমবঙ্গের পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি), সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা বজায় রাখার গুরু দায়িত্ব যাদের হাতে। ডব্লিউবিসিএসের ইন্টারভিউয়ের ক্ষেত্রে সেই পিএসসি বোর্ডেরই একাংশের নিয়ম বহির্ভূত কাজের অভিযোগ ঘিরে ক’দিন আগে তুমুল শোরগোল উঠেছিল, যার জেরে কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান ইস্তফা পর্যন্ত দিয়েছেন। তার রেশ না-কাটতেই এ বার রাজ্যের আইন অফিসার নিয়োগ নিয়ে দানা বেঁধেছে নতুন বিতর্ক।

অত্রি মিত্র

শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:২১

অভিযোগের পালা যেন আর শেষ হচ্ছে না।

অনিয়মের অভিযোগ। যাতে ফের বিদ্ধ পশ্চিমবঙ্গের পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি), সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা বজায় রাখার গুরু দায়িত্ব যাদের হাতে। ডব্লিউবিসিএসের ইন্টারভিউয়ের ক্ষেত্রে সেই পিএসসি বোর্ডেরই একাংশের নিয়ম বহির্ভূত কাজের অভিযোগ ঘিরে ক’দিন আগে তুমুল শোরগোল উঠেছিল, যার জেরে কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান ইস্তফা পর্যন্ত দিয়েছেন। তার রেশ না-কাটতেই এ বার রাজ্যের আইন অফিসার নিয়োগ নিয়ে দানা বেঁধেছে নতুন বিতর্ক।

সরকারি সূত্রের খবর: ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল লিগ্যাল সার্ভিস’ পরীক্ষার জন্য ২০১৩-র অগস্টে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল পিএসসি। ২২২৪ জন প্রার্থীর থেকে বাছাই করে ২৩ জনের চূড়ান্ত তালিকা তৈরি হয়েছে। এঁদের নিয়োগপত্র পাঠাতে আরও কয়েক মাস লাগবে। কিন্তু তার আগেই ওই তালিকা তৈরির পদ্ধতি সম্পর্কে উঠেছে প্রশ্ন। পিএসসি-র তথ্য বলছে, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা মিলিয়ে তুলনায় কম নম্বর পেয়েও অনেকের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়েছে, যেখানে তাঁদের চেয়ে বেশি নম্বর পাওয়া অনেকে বাদ পড়েছেন।

যেমন, পার্থ দাস (নাম পরিবর্তিত)। লিখিত ও মৌখিক মিলিয়ে হাজার নম্বরের পরীক্ষায় পেয়েছেন ৫০৮। তবু তালিকায় তাঁর নাম নেই। এ দিকে ৪০৩ নম্বর পেয়েই যোগ্যতার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হয়েছেন আর এক জন। পিএসসি-সূত্রের খবর, সাধারণত লিগ্যাল সার্ভিস পরীক্ষায় ৯০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষা নেওয়া হয়। তার ফলাফলের ভিত্তিতে ইন্টারভিউয়ে ডাকা হয়। সেই মৌখিক পরীক্ষা বা ‘পার্সোন্যালিটি টেস্ট’ ১০০ নম্বরের।

মোট এই হাজার নম্বরে কে কত পেলেন, তার ভিত্তিতে চূড়ান্ত বাছাই হওয়ার কথা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এ বার লিগ্যাল সার্ভিসের নিয়োগ তালিকায় (জেনারেল ক্যাটেগরি) শীর্ষ স্থানাধিকারীর প্রাপ্ত নম্বর ৪৯৪.৫, সবচেয়ে কম নম্বর ৪০৩। অথচ ৫০৪, ৪৭৯ বা ৪৫৩ নম্বর পাওয়া ছেলে-মেয়েরা বাদ পড়েছেন! সব মিলিয়ে যাঁদের সংখ্যা প্রায় তিরিশ।

কেন এমন হল?

কমিশনের দাবি, লিখিত পরীক্ষায় যথেষ্ট নম্বর পেলেও মৌখিকে চল্লিশের কম পাওয়ায় ওঁরা দৌড় থেকে ছিটকে গিয়েছেন। কিন্তু ২০১৩-র ওই বিজ্ঞাপনে উল্লিখিত যোগ্যতামানে তো এ রকম কিছু বলা ছিল না!

প্রশাসনের অন্দরের খবর: বিজ্ঞাপন দেওয়ার প্রায় ছ’মাস বাদে, ২০১৪-র ১৭ থেকে ২২ ফেব্রুয়ারির মধ্যে লিখিত পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল, যার ফল বেরোয় গত ১৭ ডিসেম্বর। তার ভিত্তিতে ৯৪ জনকে মৌখিক পরীক্ষায় ডাকা হয়। কিন্তু তার আগেই, ১৯ সেপ্টেম্বর পিএসসি-র বোর্ডে সিদ্ধান্ত হয়ে যায়, ডব্লিউবিসিএস এবং জুডিশিয়াল সার্ভিস ব্যতীত বাকি সব পরীক্ষায় মৌখিকে আলাদা ভাবে অন্তত ৪০ নম্বর পেয়ে ‘পাশ’ করলে তবেই প্রার্থীর লিখিত নম্বর বিবেচনায় আসবে।

সেই নিয়মেই লিখিত পরীক্ষায় বেশি নম্বর পেয়েও মৌখিকে ‘ফেল’ করার সুবাদে অনেকে বাদ পড়েছেন বলে পিএসসি সূত্রের দাবি। কমিশনের এক কর্তার কথায়, ‘‘এতে কোনও অনিয়ম নেই।’’ অন্য দিকে পরীক্ষার্থীদের একাংশের অভিযোগ, কমিশন এ ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ লঙ্ঘন করেছে।

সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ কী? ২০০৮-এ দিল্লির হেমানি মালহোত্র মামলায় সুপ্রিম কোর্টের তদানীন্তন প্রধান বিচারপতি কে জি বালকৃষ্ণন এবং বিচারপতি জেএম পাঞ্চাল রায় দিয়েছিলেন, লিখিত পরীক্ষার নম্বর বাদ দিয়ে শুধু মৌখিকের নম্বরের ভিত্তিতে মেধা-তালিকা তৈরি করা যাবে না। ‘‘উপরন্তু মৌখিকের জন্য আলাদা পাশ নম্বর থাকলে বিজ্ঞপ্তিতেই তা জানিয়ে দেওয়ার নিয়ম। এ ক্ষেত্রে তা হয়নি।’’— অনুযোগ করছেন লিগ্যাল সার্ভিসের পরীক্ষার্থী রাজু বিশ্বাস।

বস্তুত লিখিত পরীক্ষা হয়ে যাওয়ার পরে মৌখিক পরীক্ষা সম্পর্কে পৃথক সিদ্ধান্ত আদৌ নেওয়া যায় কি না, রাজ্য প্রশাসনের একাংশ সেই প্রশ্ন তুলেছে। এক আধিকারিকের কথায়, ‘‘পার্সোন্যালিটি টেস্টে পাশ করাটা চাকরিলাভের মূল শর্ত হলে লিখিত পরীক্ষার আর দরকার কী?’’

এবং এখানেই মিলছে অনিয়মের গন্ধ। কী রকম? প্রশাসনের একাংশের বক্তব্য, লিখিত পরীক্ষার খাতা দেখেন বাইরের লোক। সেখানে ‘অন্য কিছু’ করার সুযোগ নেই। কিন্তু মৌখিক পরীক্ষা নেন পিএসসি-র কর্তারা। তাই পার্সোনালিটি টেস্টে নম্বর দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ইচ্ছে-অনিচ্ছের প্রতিফলন হওয়ার সুযোগ রয়েছে। ‘‘নিজের পছন্দের লোক নিতে গেলে মৌখিক পরীক্ষা বিরাট হাতিয়ার।’’— মন্তব্য নবান্নের এক কর্তার।

ছিটকে যাওয়া প্রার্থীদের অনেকের অভিযোগ, এ বারের লিগ্যাল সার্ভিসে তা-ই হয়েছে। পিএসসি’র চেয়ারম্যান সইদুল ইসলাম যদিও সব শুনে এ প্রসঙ্গে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। কমিশন-সচিব পূর্ণচন্দ্র শিটের বক্তব্য, ‘‘আমার কিছু জানা নেই। তাই কিছু বলতে পারব না।’’ পিএসসি বোর্ডের অন্যতম সদস্য দেবপ্রিয় মল্লিক বলেন, ‘‘পিএসসি-র নিজস্ব নিয়ম-কানুন আছে। তার বাইরে কিছু হতেই পারে না।’’ কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট যে অন্য রকম রায় দিয়েছে?

দেবপ্রিয়বাবুর জবাব, ‘‘সুপ্রিম কোর্টের আদেশ লঙ্ঘনের প্রশ্ন ওঠে না। যদি তেমন কিছু হয়ে থাকে, তা হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’

চিকিৎসক তথা সমাজকর্মী দেবপ্রিয়বাবু রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের দাদা। পিএসসি বোর্ডের আর এক বিশিষ্ট সদস্য দীপঙ্কর দাশগুপ্ত বিষয়টি শোনার আগেই ‘ব্যস্ত আছি’ বলে ফোন কেটে দেন। পিএসসি-র এক প্রাক্তন চেয়ারম্যানের পর্যবেক্ষণ, ‘‘এই ধরনের মেধা-তালিকা সম্পূর্ণ বেআইনি। কেউ কোর্টে গেলে পুরো প্যানেল খারিজ হয়ে যেতে পারে।’’ তাঁর মতে, মৌখিক পরীক্ষায় ন্যূনতম যোগ্যতামান অর্জনের শর্ত বিজ্ঞাপনেই উল্লেখ করে দেওয়া উচিত ছিল।

ঘটনাটি যে সময়কার, তখন পিএসসি’র চেয়ারম্যান ছিলেন শেখ নুরুল হক, যিনি ক’দিন আগে দায়িত্ব ছেড়েছেন। নবান্নের খবর, ডব্লিউবিসিএস ইন্টারভিউয়ের বেশ আগে প্রার্থীদের নাম-ঠিকানা সংবলিত তথ্য (প্রেসি শিট) চেয়ে চাপ দিয়েছিলেন বোর্ডের একাংশ। তাই নিয়ে টানাপড়েনের পরিণামেই নুরুল সরে গিয়েছেন। তিনি লিগ্যাল সার্ভিসে অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে মুখ খুলতে না-চাইলেও তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলের দাবি, মৌখিকে পাশ নম্বর বলবত করার প্রস্তাবও নুরুল আটকানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু নানা চাপে সিদ্ধান্তের শরিক হতে বাধ্য হন।

গত তিন-চার বছরে পশ্চিমবঙ্গে সরকারি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতার অভিযোগ কম নয়। প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগে লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে চাকরি বিলি হয়েছিল বলে অভিযোগ। এসএসসি মারফত মাধ্যমিক শিক্ষক নিয়োগেও অনিয়মের নালিশ সাংবাদিক সম্মেলন করে জানিয়েছেন এক ডব্লিউবিসিএস অফিসার। এ ছাড়া সিভিক ভলান্টিয়ার, ভিলেজ পুলিশ নিয়োগে বিস্তর টাকার খেলা হয়েছে বলে অভিযোগ মিলেছে। হোমগার্ড নিয়োগে ‘কেলেঙ্কারি’র জেরে তো এক ডিজি-র বিরুদ্ধে এক এসপি লিখিত অভিযোগ পর্যন্ত দায়ের করেছেন, যার তদন্তও শুরু হয়েছে। তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন পিএসসি’র লিগ্যাল সার্ভিস। এর জল কত দূর গড়ায়, সেটাই আপাতত দেখার।

wbpsc atri mitra west bengal lagal service psc oral test legal service written exam
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy