Advertisement
E-Paper

হেনস্থার দাওয়াই বাঁধন কি, বিতর্ক শিক্ষামহলে

ক্লাস শেষ। বই হাতে বেরিয়ে যাচ্ছেন মাস্টারমশাই। হঠাৎ ফিরে এসে এক ছাত্রীকে ডেকে বললেন, “তোমার বাবা-মাকে দেখা করতে বলো।” কিছুটা ভয়ে ভয়েই মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন তাঁরা। দেখা হল। কিছুটা উসখুস করে, এ কথা, সে কথা বলে আসল কথাটা পেড়েই ফেললেন অধ্যাপক। ছাত্রীর বাবা-মার কাছে তাঁর কুণ্ঠিত আর্জি, “আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে চাই।”

পায়েল মজুমদার

শেষ আপডেট: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:৩২

ক্লাস শেষ। বই হাতে বেরিয়ে যাচ্ছেন মাস্টারমশাই। হঠাৎ ফিরে এসে এক ছাত্রীকে ডেকে বললেন, “তোমার বাবা-মাকে দেখা করতে বলো।” কিছুটা ভয়ে ভয়েই মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন তাঁরা। দেখা হল। কিছুটা উসখুস করে, এ কথা, সে কথা বলে আসল কথাটা পেড়েই ফেললেন অধ্যাপক। ছাত্রীর বাবা-মার কাছে তাঁর কুণ্ঠিত আর্জি, “আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে চাই।”

গবেষণার কাজে ছাত্রীকে ঘরে ডেকে পাঠিয়েছেন এক অধ্যাপক। ছাত্রী গেলেন। তবে একা নয়। এক ঝাঁক বন্ধুবান্ধবকে সঙ্গে নিয়ে। কারণ কানাঘুষো শোনা যেত, ‘স্যার’ নাকি নানা অছিলায় ছাত্রীদের শরীরে হাত দেন। তা রুখতেই স্যারের ঘরে এই দলবদ্ধ অভিযান।

দু’টি ঘটনাই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের। এর মধ্যে প্রথমটি অর্থনীতি বিভাগের এক প্রাক্তন অধ্যাপকের। শোনা যায়, এ ভাবেই তিনি তাঁর স্ত্রীকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। আর দ্বিতীয় ঘটনা? তার খুঁটিনাটি কেউ মনে রাখতে চান না। কারণ এ ধরনের ঘটনা কম-বেশি সব বিভাগেই প্রচুর ঘটছে। তা হলে কি এ হেন যৌন হেনস্থা রুখতে এ বার এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও অধ্যাপক-পড়ুয়া প্রেম, যৌন সম্পর্ক নিষিদ্ধ হওয়া উচিত? ঠিক যেমনটা সম্প্রতি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় করেছে। এ নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত শিক্ষামহল। এক দলের যুক্তি, এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা আসলে দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। অন্য পক্ষের দাবি, শিক্ষা ক্ষেত্রে বাড়তে থাকা যৌন হেনস্থার অভিযোগই স্পষ্ট করে দিচ্ছে, শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্কে লক্ষ্মণরেখা টানা ঠিক কতটা জরুরি।

ঠিক এই যুক্তি দিয়েছিলেন হার্ভার্ডের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক অ্যালিসন জনসন। হার্ভার্ডের ইতিহাস বিভাগেরই আর এক অধ্যাপক সুগত বসুর মতে, “এটার দরকার ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের হাতে যৌন হেনস্থার বহু অভিযোগ এসেছিল। তার অনেকগুলোর সপক্ষে প্রমাণও ছিল। নয়া নিষেধাজ্ঞার ফলে ভবিষ্যতে এ হেন ঘটনা কিছুটা রোখা যাবে।” কিন্তু এই নিয়ম আদৌ কি বাস্তবে প্রয়োগ করা সম্ভব, প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই। তাঁদের যুক্তি, কোনও অধ্যাপক-পড়ুয়া সত্যি একে অপরকে ভালবাসেন নাকি কোনও তরফের চাপে এই সম্পর্ক তৈরি করেছেন, তা নির্ধারণ করার মাপকাঠি কী? অনেকের আবার প্রশ্ন, আপাতদৃষ্টিতে এ ধরনের সম্পর্ক সহমতে তৈরি হয়েছে বলে মনে হলেও তার মধ্যে ক্ষমতার অপব্যবহার থাকতেই পারে। নয়া নিষেধাজ্ঞা এ সব ক্ষেত্রে কতটা কার্যকরী হবে?

সুগতবাবুর মতে, “সকলের ব্যক্তিগত জীবন নজরে রাখা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু এর পর কোনও পড়ুয়া যদি মনে করেন যে পদের অপব্যবহার করে কোনও অধ্যাপক তাঁর যৌন হেনস্থা করছেন, তা হলে সে অন্যায়ের প্রতিকার করতে পারবেন।” তবে তাঁর মতে, এ দেশের তুলনায় বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে এ ধরনের যৌন হেনস্থার ঘটনা অনেক বেশি ঘটে। সে জন্য সেখানে এই নিষেধাজ্ঞা আরও বেশি দরকার।

কিন্তু এখানেও তো যৌন হেনস্থার অভিযোগ নেহাত কম নয়। কয়েক মাস আগেই ফেল করিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে ছাত্রীকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছিল এক কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও এক বিভাগীয় প্রধানের বিরুদ্ধে। যৌন হেনস্থার অন্য একটি ঘটনায় আবার সেই বিশ্ববিদ্যালয়েরই উপাচার্যের নাম জড়িয়েছিল। তবে শুধুই যে পুরুষ অধ্যাপক মহিলা পড়ুয়াদের হেনস্থা করছেন, এমনটা নয়। পুরুষ অধ্যাপকের হাতে পুরুষ গবেষকের হেনস্থার দৃষ্টান্তও রয়েছে। বছর পাঁচ-ছয় আগে এমনই অভিযোগ শোনা গিয়েছিল কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে। শুধু কল্যাণী কেন? যৌন হেনস্থার অভিযোগ কলকাতা, যাদবপুর, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়েও (জেএনইউ) কম নয়।

এমনই একটি ঘটনার কথা মনে করছিলেন জেএনইউ-এর প্রাক্তনী ও অধ্যাপিকা আয়েষা কিদোয়াই। সে বার যৌন হেনস্থার অভিযোগ উঠেছিল সেন্টার ফর সোশ্যাল মেডিসিন ও কমিউনিটি হেলথের এক অধ্যাপকের বিরুদ্ধে। তাঁকে সাসপেন্ড করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বর্তমানে যৌন হেনস্থার অভিযোগ খতিয়ে দেখতে জেএনইউ-এ কমিটি রয়েছে। সেখানে নিয়ম মেনে তদন্ত করা হয়। তবে সেই নিয়মের তালিকায় হার্ভার্ডের মতো নিষেধাজ্ঞা জুড়তে রাজি নন আয়েষা। তাঁর মতে, “এই রকম নিষেধাজ্ঞা কখনওই চলতে পারে না। তবে যৌন হেনস্থা রুখতে কিছু নির্দিষ্ট নীতি তৈরি করা দরকার। অধ্যাপক-পড়ুয়ার মধ্যে সত্যি প্রেমের সম্পর্ক থাকলে সে ক্ষেত্রে এক রকম পদক্ষেপ আর যৌন হেনস্থার ঘটনা ঘটলে অন্য রকম পদক্ষেপ করা দরকার।” ডায়মন্ড হারবার মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শমিতা সেনও মনে করেন, “শিক্ষক বা শিক্ষিকা যখন পড়ুয়ার মূল্যায়ন করছেন, বা পড়ুয়ার অন্য কোনও কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত, তখন সেই পড়ুয়ার সঙ্গে তিনি কোনও ব্যক্তিগত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়বেন না, এমনটাই প্রোটোকল। তার বাইরে দু’পক্ষের সম্পর্কে বাধা দেওয়ার কোনও অর্থ হয় না।” একই মত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক সৌমিত্র বসুরও। তাঁর মতে, “দু’জন প্রাপ্তবয়স্কের সম্পর্কে বাধা দেওয়ার কোনও নৈতিক যুক্তি নেই।” উভয় পক্ষের সম্মতিতে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করা যাবে না, এমন নিয়ম চলে না, মত সৌমিত্রবাবুর।

কিন্তু কোন ক্ষেত্রে উভয় পক্ষের সম্মতিতে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে আর কোন ক্ষেত্রে সেটা যৌন হেনস্থা কী ভাবে এই পার্থক্য করা সম্ভব? খুব স্পষ্ট ভাবে যে পার্থক্য করা যাবে না তা মেনে নিচ্ছেন অধ্যাপিকা তথা সমাজকর্মী শাশ্বতী ঘোষ। এবং এই নিষেধাজ্ঞার জেরে যে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ ভাবে কিছু প্রকৃত প্রেমেও বাধা পড়তে পারে, সে কথা মানছেন তিনি। কিন্তু যৌন হেনস্থার ঘটনা কমাতে এ টুকু করা দরকার, মত শাশ্বতীদেবীর।

অর্থাৎ এই নিষেধাজ্ঞা এখানে জারি হলে নতুন করে আর কোনও অধ্যাপক-পড়ুয়ার প্রেমকাহিনি শোনা যাবে না। মুখে মুখে ফিরবে না কোনও মিষ্টি গল্পের ইতিহাস। কতিপয় যৌন হেনস্থার জন্য এমন কড়া দাওয়াই? ভাবছেন শিক্ষক-পড়ুয়া দু’তরফই।

payel majumder university
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy