হিসাবের খাতায় গত ছ’বছরের জমাখরচের অঙ্ক। সেই অঙ্কে ভরসা রেখেই আগামী বিধানসভা নির্বাচনে আসনভিত্তিক রণকৌশল নির্ধারণ বিজেপির। রাজ্যের ২৯৪টি বিধানসভা কেন্দ্রেই তৃণমূলের সঙ্গে সেয়ানে সেয়ানে টক্কর নেওয়া যাবে, এমন কথা স্বপ্নেও ভাবছে না বিজেপি। অন্তত ৫০টি বিধানসভা আসনে যে অধিকাংশ বুথে দলের এজেন্টই বসানো যাবে না, সে কথাও ব্যক্তিগত আলোচনায় মেনে নিচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির নানা গুরুদায়িত্বে থাকা একাধিক নেতা। কিন্তু সংখ্যালঘু প্রধান ওই সব আসনকে হিসাবের বাইরে রেখেও বিজেপি পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় ‘জাদুসংখ্যা’র খুব কাছে পৌঁছে যেতে পারে বলে দলের রাজ্য নেতৃত্বের দাবি। এ রাজ্যে বিজেপি যে সব আসনে ইতিমধ্যেই কখনও না কখনও জিতেছে, তার যোগফল দেখেই বিজেপি নেতৃত্বের এই ‘আত্মবিশ্বাস’।
২০১৯ সালের লোকসভা, ২০২১ সালের বিধানসভা এবং ২০২৪ সালের লোকসভা— এই তিনটি বড় নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে মোট কতগুলি বিধানসভা আসনে বিজেপির পতাকা উড়েছে, সেই হিসাব সামনে রেখে চলছে রণকৌশল সাজানো। তিনটি নির্বাচনের মধ্যে তিন বারই বিজেপি জিতেছে বা এগিয়ে থেকেছে, এমন বিধানসভা আসনের সংখ্যা ৫৫। তিন বারের মধ্যে দু’বার বিজেপি জিতেছে বা এগিয়ে থেকেছে এবং এক বার হেরে গিয়েছে বা পিছিয়ে থেকেছে, এমন বিধানসভা আসনের সংখ্যা ৩৮। আর এগুলির বাইরে আরও ৫৩টি বিধানসভা আসন এমন রয়েছে, যেগুলিতে এই তিনটি নির্বাচনে কোনও এক বার বিজেপি জিতেছে বা এগিয়ে থেকেছে, বাকি দু’বার হেরে গিয়েছে বা পিছিয়ে থেকেছে। এই আসনগুলি মিলিয়ে সংখ্যাটা দাঁড়াচ্ছে ১৪৬।
এর বাইরে ১৯৯৯ সালের উপনির্বাচনে অশোকনগরে জিতেছিলেন বিজেপির বাদল ভট্টাচার্য। ২০১৪ সালের উপনির্বাচনে বসিরহাট দক্ষিণে জিতেছিলেন বিজেপির শমীক ভট্টাচার্য। সে সব আসনকেও ‘সম্ভাব্য’ প্রাপ্তির তালিকায় রাখছে বিজেপি। অর্থাৎ, সংখ্যা পৌঁছে যাচ্ছে অন্তত ১৪৮-এ। পশ্চিমবঙ্গে সরকার গড়ার জন্য প্রয়োজন ১৪৮টি আসনই।
রাজ্য বিজেপির প্রাক্তন সভাপতি সুকান্ত মজুমদার যে হিসাব দিচ্ছেন, তাতে স্পষ্ট যে এই আসনগুলি নিয়ে বিজেপি বিশদ অঙ্ক কষা শুরু করেছে। সুকান্তের কথায়, ‘‘যে আসনগুলি নিয়ে কথা হচ্ছে, সেগুলিতে সর্বশেষ নির্বাচনে তৃণমূল আর বিজেপির প্রাপ্ত মোট ভোটের মধ্যে ফারাক ১০ লক্ষেরও কম। অর্থাৎ বিজেপি ওই আসনগুলিতে মোট পাঁচ লক্ষ ভোট বাড়াতে পারলেই জাদুসংখ্যায় পৌঁছে যাবে। আসনপ্রতি তিন-সাড়ে হাজার ভোট আমাদের বেশি পেতে হবে অথবা তৃণমূলের ওই পরিমাণ ভোট কমতে হবে। ভুয়ো ভোট বাদ গেলেই তো তৃণমূলের ভোট তার চেয়ে অনেক বেশি কমে যাবে।’’
রাজ্য বিজেপির সাধারণ সম্পাদক তথা পুরুলিয়ার সাংসদ জ্যোতির্ময় মাহাতোর কথায়, ‘‘এই সব আসনে আমরা কখনও না কখনও জিতেছি মানে এটা প্রমাণিত যে, ওই আসনগুলির জনবিন্যাস বিজেপির জয়ের জন্য অনুকূল। সুতরাং ভোট এবং গণনা ঠিক মতো হলে আমাদের আসনসংখ্যা কমপক্ষে কত হতে পারে বোঝাই যাচ্ছে।’’ জ্যোতির্ময়ের দাবি, বিজেপির আসনসংখ্যা ১৬৩-তে পৌঁছোবে।
বনগাঁ এবং রানাঘাট লোকসভার অন্তর্গত ১৪টি বিধানসভা আসনের মধ্যে ১২টিতেই গত তিনটি সাধারণ নির্বাচনে বিজেপি জিতেছে বা এগিয়ে থেকেছে। এ ছাড়া ভাটপাড়া, কৃষ্ণনগর উত্তর, মুর্শিদাবাদ, ইংরেজবাজার, পুরাতন মালদহ, হবিবপুর, গাজোল, বালুরঘাট, তপন, গঙ্গারামপুর, রায়গঞ্জ, কালিয়াগঞ্জ, ধূপগুড়ি, ময়নাগুড়ি, ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ি, আলিপুরদুয়ার, মাদারিহাট, কালচিনি, ফালাকাটা-সহ আরও কিছু আসনে বিজেপি লাগাতার জিতে আসছে। তবে লক্ষণীয় হল, এই আসনগুলির বেশিরভাগই মতুয়া প্রধান এলাকায় অথবা উত্তরবঙ্গে।
কলকাতা এবং লাগোয়া এলাকায় কিছু আসন রয়েছে, যেখানে লাগাতার তিন বার না পারলেও অন্তত দু’টি সাম্প্রতিক নির্বাচনে বিজেপি জিতেছে বা এগিয়ে রয়েছে। যেমন জোড়াসাঁকো, শ্যামপুকুর, বিধাননগর, হাবড়া। ২০১৯ এবং ২০২৪, দু’টি লোকসভা নির্বাচনেই এই আসনগুলিতে বিজেপি প্রার্থীরা এগিয়ে ছিলেন। কিন্তু ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি সেখানে হারে। নদিয়ার কৃষ্ণনগর দক্ষিণ, মালদহের বৈষ্ণবনগর, উত্তর দিনাজপুরের হেমতাবাদ, করণদিঘি, কোচবিহার জেলার কোচবিহার দক্ষিণ, শীতলকুচি, দিনহাটা, জলপাইগুড়ি জেলার জলপাইগুড়ি (সদর), নাগরাকাটা- সহ আরও কিছু আসনে বিজেপি গত তিনটি নির্বাচনের মধ্যে যে কোনও দু’টিতে এগিয়ে থেকেছে।
গত ছ’বছরে একবার অন্তত বিজেপি জিততে পেরেছে, এমন ৫৩ আসনের মধ্যে কলকাতাতেও বেশ কয়েকটি রয়েছে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে মুখ্যমন্ত্রীর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিজের আসন ভবানীপুরে বিজেপি এগিয়ে ছিল। লাগোয়া রাসবিহারী আসনেও একই ফল হয়েছিল। উত্তর কলকাতার মানিকতলা বিধানসভা কেন্দ্রেও সে বছর বিজেপি প্রার্থী তৃণমূলের চেয়ে বেশি ভোট পেয়েছিলেন। এ ছাড়া উত্তর ২৪ পরগনার বারাসত, সন্দেশখালি, দক্ষিণ ২৪ পরগনার সোনারপুর দক্ষিণ, নদিয়ার তেহট্ট, মুর্শিদাবাদের বহরমপুর, জঙ্গিপুর-সহ আরও কিছু আসনে বিজেপি গত ছ’বছরে অন্তত একবার জিতেছে।
বিজেপি সূত্রের খবর, সংখ্যালঘু প্রধান ৫০ আসনকে নেতিবাচক তালিকায় রেখে জোর দেওয়া হবে ২৪৪টি আসনে। রাজ্য বিজেপির একাধিক পদাধিকারীর বক্তব্য, সেগুলির মধ্যে ১০০টিতেও যদি বিজেপি হেরে যায়, তা হলেও ‘জাদুসংখ্যা’-র খুব কাছাকাছিই থাকবে।