Advertisement
E-Paper

কলকাতায় ছেলেবেলা কাটানো ‘সেরার সেরা’ মুগ্ধ আজও এ শহরের প্রেমে

চার বছর আগেও ছিলেন ভারত সরকারের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, এখন বিশ্ব ব্যাঙ্কের প্রধান অর্থনীতিবিদ ও সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট। ২০১৬ সালে সেরার সেরা বাঙালি তিনি।

গৌতম চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২১ অগস্ট ২০১৬ ০৩:২১
কৌশিক বসুর হাতে ‘সেরার সেরা বাঙালি’-র পুরস্কার তুলে দিচ্ছেন আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়। শনিবার বিশ্বনাথ বণিকের তোলা ছবি।

কৌশিক বসুর হাতে ‘সেরার সেরা বাঙালি’-র পুরস্কার তুলে দিচ্ছেন আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়। শনিবার বিশ্বনাথ বণিকের তোলা ছবি।

চার বছর আগেও ছিলেন ভারত সরকারের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, এখন বিশ্ব ব্যাঙ্কের প্রধান অর্থনীতিবিদ ও সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট। ২০১৬ সালে সেরার সেরা বাঙালি তিনি।

বহু দিন প্রবাসী, কিন্তু কলকাতায় ছেলেবেলা কাটানো কৌশিক বসু আজও এই শহরের প্রেমে মুগ্ধ। ‘‘কত রকম খেলা, কালচারাল অ্যাকটিভিটিজ, সিনেমা, নাটক। কলকাতা বরাবরই আমার জীবনে বিশেষ স্থানে,’’ — এবিপি আনন্দের সেরা বাঙালি ২০১৬ অনুষ্ঠান মঞ্চে সম্মান হাতে নিয়ে বলছিলেন তিনি। শুনতে শুনতে মনে পড়ল, এ শহরের চেনা বাংলা শব্দ ‘এলেবেলে’কেও তিনি চমৎকার ভাবে ইংরেজি ভাষায় চালিয়ে দিয়েছিলেন। বাচ্চারা যাকে খেলতে নিতে চায় না, নিজেদের মধ্যে চোখ টেপাটেপি করে তাকে এলেবেলে করে রাখে না? কৌশিক লিখেছিলেন, হাল আমলে গণতান্ত্রিক দেশে সরকারি নীতি নির্ধারণের ব্যাপারটাও সে রকম। সরকার ওয়েবসাইটে ও জনপরিসরে তার নীতি প্রকাশ করে লোকের মতামত চায়। লোকে মতামত দেয়, কিন্তু ক্ষমতা তাদের ওই এলেবেলে করে রাখা রপ্ত করে নিয়েছে।

সেরা বাঙালি অনুষ্ঠান এ বার পা দিল ১২ বছরে। কৌশিকবাবুর আগেই লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট সম্মান তুলে দেওয়া হল সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের হাতে। তুলে দিলেন সুপারহিট ‘প্রাক্তন’ ছবিতে তাঁর স্বামীর ভূমিকায় যিনি ছিলেন, সেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সেই ছবির দুই পরিচালক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও নন্দিতা রায়ের হাতে তার আগে চলচ্চিত্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সেরার সম্মান তুলে দিয়েছেন ‘প্রাক্তন’-এরই নায়ক প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। সাবিত্রী সম্মান হাতে নিয়ে রসিকতাচ্ছলে জানিয়েছেন, ‘‘পুরস্কার তখন দেওয়া হয়, যখন লোকটার আর বোধশক্তি থাকে না। আমার এখনও আছে।’’

প্রতিভার এই বোধ, উচ্চাবচ যাত্রাপথের কঠিন সাধনাকেই কুর্নিশ করে সেরা বাঙালি অনুষ্ঠান। সাবিত্রীর মতোই ও-পার বাংলা ছেড়ে আসা যোগেন চৌধুরী। আর্ট কলেজ, প্যারিস, রাষ্ট্রপতি ভবনের কিউরেটর থেকে বিশ্বভারতী— দীর্ঘ যাত্রাপথ পেরিয়ে তাঁর ছবি আজ ভারতীয় চিত্রকলার অনন্য মাইলফলক। শিল্পকলায় এ বারের সেরা বাঙালি তিনি। মনে পড়ে, ফরিদপুরের দুই বাঙাল দীর্ঘকাল নিঃশব্দে বুকে বয়ে গিয়েছেন দেশভাগের বেদনা। এক জন যোগেন। অন্য জন আজ আর এই দুনিয়ায় নেই। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।

সেরা বাঙালি-র মঞ্চে (বাঁ দিক থেকে) শাম্ভবী ঘোষ, মিমি চক্রবর্তী, দীপ্তায়ন ঘোষ, ঋতব্রত মুখোপাধ্যায়, নন্দিতা রায়, দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায়,

সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, কৌশিক বসু, যোগেন চৌধুরী, মৃগাঙ্ক শূর, সুমন দে, মনোজ মিত্র, অন্তরা মিত্র, শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় এবং শিবশঙ্কর প্রসাদ চৌরাসিয়া।

(সামনের সারিতে) আর্শিয়া মুখোপাধ্যায় এবং শায়েরি সরকার। শনিবার। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।

ও-পার বাংলার সন্তান তিনিও— নাট্যকলায় সম্মানিত সেরা বাঙালি: মনোজ মিত্র। তাঁর ‘সাজানো বাগান’ বা ‘নরক গুলজার’ কে ভুলতে পারে? নাটক লেখা, পরিচালনার পাশাপাশি তপন সিংহের ‘বাঞ্ছারামের বাগান’ বা ‘আদালত ও একটি মেয়ে’ ছবিতে তাঁর চরিত্রাভিনয় আজও অনেকের স্মৃতির উজ্জ্বল উদ্ধার! তাঁর হাতে সম্মান তুলে দিলেন এই যুগের অভিনেতা দেবশঙ্কর হালদার। সেরা বাঙালিরা এ রকমই ছকের বাইরে। সব সময় প্রবীণরা নবীনদের পুরস্কার দেবেন, প্রাক্তনরা বর্তমানদের, এমন নয়।

নিজস্ব ছক-ভাঙা গড়নের চালেই সঙ্গীতের সেরা বাঙালি: ‘দিলওয়ালে’ ছবিতে ‘রং দে তু মোহে গেরুয়া’ খ্যাত গায়িকা, উত্তর ২৪ পরগনার মছলন্দপুরের মেয়ে অন্তরা মিত্র। তিনি সম্মান-স্মারক নিলেন রূপম ইসলামের হাত থেকে। অন্তরার শুরুটা হয়েছিল সর্বভারতীয় এক রিয়্যালিটি শো’য়। রিয়্যালিটি শো-এর আবিষ্কারেরা অনেকেই পরে হারিয়ে যান। কিন্তু অন্তরা নিজের জেদে মুম্বই পাড়ি দিয়েছিলেন, জিতে গিয়েছেন।

সেই জেদটাই দেখিয়েছিলেন ‘চাউ’ ওরফে শিবশঙ্কর প্রসাদ চৌরাসিয়া। গল্ফ ক্লাবের মালির সন্তান, এক সময় অন্যের গল্ফ কিট বয়ে নিয়ে যাওয়া ক্যাডির কাজ করেছেন। সেখান থেকে ইন্ডিয়ান ট্যুরে আটটা খেতাব জয়! তাঁর হাতে খেলার সেরা বাঙালির সম্মান তুলে দিলেন অরুণলাল।

আর ওই সম্মানটা? বাণিজ্যে সেরা বাঙালি! লক্ষ্মী টি-র কর্ণধার দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায়। তাঁর বাবাই পরাধীন ভারতে চা বাগানের প্রথম ভারতীয় মালিক। বাগানটা দিয়েছিলেন ত্রিপুরার মহারাজা। ১৪টি টি-এস্টেট-এর পরে দীপঙ্কর সম্প্রতি কিনেছেন মকাইবাড়ি টি এস্টেট। সেই মকাইবাড়ি, যার চা খান ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। এবং হ্যাঁ, লক্ষ্মী টি গ্রুপের বাগানে শ্রমিকদের রেশন থেকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য বিনামূল্যে, এখনও। তাঁর হাতে সম্মান তুলে দিলেন বন্ধন ব্যাঙ্কের কর্ণধার চন্দ্রশেখর ঘোষ।

ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির ব্রেন অ্যান্ড কগনিটিভ সায়েন্সেস-এর প্রধান মৃগাঙ্ক শূর। মস্তিষ্কে এমআরআই করলে তারার মতো যে ‘অ্যাস্ট্রোসাইটস’ দেখা যায়, তার কী কাজ? বিজ্ঞানীরা এ নিয়ে সংশয়ে ছিলেন। মৃগাঙ্কবাবুরা প্রমাণ করেছেন, এই অ্যাস্ট্রোসাইটগুলি মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালন থেকে স্নায়বিক প্রতিক্রিয়া— অনেক কাজই করে। মগজাস্ত্রের খুঁটিনাটি জানা এই মৃগাঙ্কবাবুই বিজ্ঞানে এ বারের সেরা বাঙালি। তাঁর হাতে সম্মান-স্মারক তুলে দিলেন আর এক মস্তিষ্কবিজ্ঞানী সুমন্ত্র চট্টোপাধ্যায়।

ত্রয়ী। সেরা বাঙালি-র অনুষ্ঠানে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় এবং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ছবি: সুমন বল্লভ।

অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল কীর্তন গানে। বিদ্যাপতির পদ গাইলেন তৃষা বসু। মিথিলার এই বিদ্যাপতিও কি নন বাঙালির অন্যতম সেরা ঐতিহ্য? শ্রীকৃষ্ণ মথুরায় চলে যান, পিছনে পড়ে থাকেন রাধা শুধু এক বুক স্মৃতি নিয়ে।

সেই স্মৃতির অনুষঙ্গেই আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়ের হাত থেকে সেরার সেরা বাঙালির পুরস্কার নিয়ে কৌশিকবাবু বলছিলেন, আজ তাঁর মা, বাবা ও বড়দি বেঁচে থাকলে খুশি হতেন। জীবিত এক জনকেও মিস করছেন তিনি। লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্সে তাঁর মাস্টারমশাই অমর্ত্য সেন। তাঁর বক্তৃতা শুনেই অর্থনীতিতে আগ্রহের শুরু কৌশিকবাবুর।

কৌশিকবাবু তাঁর সাম্প্রতিক বইয়ে জানিয়েছেন, ভারত সরকারের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হওয়ার পর তিনি অক্ষরে অক্ষরে ‘সেন’স রুল’ মেনে চলেছেন। মাস্টারমশাই অমর্ত্য সেন তাঁকে বলেছিলেন, ‘যে পদে বসছ, সম্মানের। কিন্তু একটা কথা মাথায় রাখবে। প্রত্যেকটা বাক্য শেষ করবে, আধখানা কিছু বলবে না। তা হলে ভারতীয় মিডিয়া তোমার মুখে বাকি কথাটা বসিয়ে দেবে।’

সেরার সেরা বাঙালি এ দিন কোনও বাক্য অসম্পূর্ণ রাখেননি।

Kaushik Basu SeraBanglai Award
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy