বুধবার বেঙ্গালুরুর চেন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে আইপিএল জয়ের উদ্যাপন অনুষ্ঠানে পদপিষ্ট হয়ে ১১ জনের মৃত্যুর ঘটনা ১৩ বছর আগে কলকাতাকে মনে পড়িয়ে দিয়েছে। চিন্নাস্বামীর ঘটনায় কড়া সমালোচনার মুখে পড়েছে কর্নাটক সরকার এবং রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু (আরসিবি) কর্তৃপক্ষ। সেই সূত্রেই কলকাতায় শুরু হয়েছে তুলনার পালা।
১৩ বছর আগে ২০১২ সালে গৌতম গম্ভীরের নেতৃত্বে কলকাতা নাইট রাইডার্স (কেকেআর) প্রথম বার আইপিএল জিতেছিল। ইডেন গার্ডেন্সে গোটা দলকে এনে নাগরিক সংবর্ধনা দিয়েছিল কলকাতা পুরসভা এবং রাজ্য সরকার। সেই অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছিলেন কেকেআরের মালিক শাহরুখ খান। ছিলেন বিপুল সংখ্যক দর্শক। ছিলেন কেকেআরের অপর মালিক অভিনেত্রী জুহি চাওলা, অভিনেতা দেব-সহ বাংলা সিনেমার তারকারা। কিন্তু উৎসব উদ্যাপন হয়েছিল কার্যত নিরাপদেই। যদিও অনুষ্ঠান শেষের পরে ইডেনের বাইরে অতিরিক্ত ভিড় সামাল দিতে পুলিশকে লাঠি চালাতে হয়েছিল। কিন্তু তাতে গুরুতর ভাবে কেউ আহত হননি। প্রাণহানি তো দূরস্থান।
(উপরে) কলকাতার রাস্তায় ট্রাকে ট্রফি হাতে শহর পরিক্রমায় কলকাতা নাইট রাইডার্সের গোটা দল। চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে প্রবেশের মুখে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর টিম বাস (নীচে))। —ফাইল চিত্র।
তখন কলকাতা পুলিশে কর্মরত পদস্থ আধিকারিকদের একাংশের কথায়, ‘‘আমরা জানতাম, কলকাতার ট্রফি জয়ের সঙ্গে জনতার উন্মাদনা এবং আবেগ মাত্রাছাড়া পর্যায়ে পৌঁছোবে। ওই অনুষ্ঠানে প্রচুর ভিভিআইপি ছিলেন। ছিলেন শাহরুখ খানও। কিন্তু আমরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে দিইনি। জনতার উচ্ছ্বাস যে বাঁধভাঙা হতে পারে, তা আন্দাজ করেই উপযুক্ত বন্দোবস্ত করা হয়েছিল।’’ এক প্রাক্তন পুলিশ আধিকারিকের কথায়, ‘‘দুর্ঘটনা দুর্ঘটনাই। চিন্নাস্বামীতেও দুর্ঘটনাই ঘটেছে। কিন্তু ১৮ বছর পরে বিরাট কোহলি আইপিএল ট্রফি নিয়ে এলে জনতার উন্মাদনা যে কোন পর্যায়ে যেতে পারে, তা আগাম আন্দাজ করা উচিত ছিল। সেই অনুযায়ী পরিকল্পনাও করা উচিত ছিল।’’
সেদিন ইডেনে হাজির ছিলেন অধুনা কলকাতার মেয়র তথা রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। বৃহস্পতিবার তিনি বলেন, ‘‘বেঙ্গালুরুতে যে ঘটনা ঘটেছে, তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। আমি কারও সমালোচনা করতে চাই না।’’ তবে পাশাপাশিই ফিরহাদ বলেন, ‘‘২০১২ সালে কেকেআর আইপিএল জেতার পরে আমরাও উৎসবের আয়োজন করেছিলাম। তখন ইডেনের গেটগুলো খুলে দেওয়া হয়েছিল। ক্রিকেটারদের বড় গাড়িতে চাপিয়ে শহরের অনেকটা ঘুরিয়ে ইডেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে মমতা’দি ওঁদের সংবর্ধনা দিয়েছিলেন। কিন্তু বেঙ্গালুরুতে কী হয়েছে, তা আমি এখান থেকে বলতে পারব না।’’
এটা ঠিকই যে, ২০১২ সালে নাগরিক সংবর্ধনার দিন বিপুল ভিড়ের কথা আগাম অনুমান করে ইডেনের সমস্ত গেট খুলে দেওয়া হয়েছিল। মাঠের ভিতরে কোনও দর্শককে যেতে দেওয়া হয়নি। গ্যালারিতেও ঢুকতে দেওয়া হয়েছিল নির্দিষ্ট প্রবেশপত্রের ভিত্তিতে। ইডেনের প্রতিটি ব্লকে পুলিশ মোতায়েন ছিল। মুখ্যমন্ত্রী মমতার নির্দেশে পশ্চিমবঙ্গ সরকার, কলকাতা পুরসভা এবং ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল (সিএবি) হাতে হাত মিলিয়ে ওই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল।
ঘটনাচক্রে, সে বছরেই মুম্বইয়ে ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে আইপিএল ম্যাচ চলাকালীন মুম্বই ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে ঝামেলা হয়েছিল শাহরুখের। সেই গোলমালের কারণে শাহরুখের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে ঢোকার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন মুম্বই ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন প্রধান তথা তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অধুনাপ্রয়াত বিলাসরাও দেশমুখ। সেই বিতর্কের কথাও মাথায় ছিল কলকাতা পুলিশের। তাই অধিনায়ক গৌতম গম্ভীর-সহ দলের কয়েক জন তারকা ক্রিকেটারকে বাদ দিয়ে রোড শোয়ের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কেকেআর টিম হাজরা মোড় থেকে মহাকরণ পর্যন্ত একটি ফুল দিয়ে সাজানো খোলা ট্রেলারে বিজয়মিছিলে অংশ নেয়। রাস্তার দু’পাশে হাজার হাজার মানুষ দাঁড়িয়ে তাদের অভিনন্দন জানান। বাঁধন না মেনে অনেকে ট্রেলারের কাছাকাছিও চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু রাস্তা থেকে ট্রেলার অনেকটা উঁচুতে থাকায় কেউ ক্রিকেটারদের ধারেপাশে যেতে পারেননি। ১৩ বছর পরে তৎকালীন আধিকারিকদের একাংশ জানাচ্ছেন, আসলে সেটি ছিল একটি কৌশল। রাস্তায় উদ্বেল জনতাকে কাছ থেকে গোটা টিম এবং ট্রফি দেখার সুযোগ করে দেওয়ায় শহুরে জনতার একটা বড় অংশকে ইডেনমুখী হওয়া থেকে তখনকার মতো নিবৃত্ত করা গিয়েছিল।
ঘটনাচক্রে, বেঙ্গালুরুতেও প্রথমে কোহলিদের হুডখোলা বাসে করে বিমানবন্দর থেকে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু যানজটের কারণ দেখিয়ে বেঙ্গালুরুর পুলিশ তা বাতিল করে দেয়। তারকা ক্রিকেটারদের বাসে চাপিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় হোটেলে। সেই বাসদু’টির গায়ে সাঁটা আরসিবি-র বিশাল বিশাল পোস্টার। ফলে বাসের ভিতরে বসে কাচের জানালার ওপার থেকে ক্রিকেটারেরা যে হাত-টাত নেড়ে জনতাকে দেখা দেবেন, তারও অবকাশ ছিল না। বলা হয়, যা হওয়ার চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামেই হবে। ফলে জয়ী ক্রিকেটারদের দেখতে লাখ লাখ লোক স্টেডিয়ামের বাইরে ভিড় জমিয়েছিলেন।
সূত্রের দাবি, চিন্নাস্বামীতে ঢোকারও প্রবেশপত্র ছিল। কিন্তু একটি প্রবেশপত্র দেখিয়ে একাধিক লোক ঢুকে পড়েন। পুলিশের হিসাবে অন্তত তিন লক্ষ মানুষ জড়ো হয়েছিলেন স্টেডিয়ামের ভিতরে-বাইরে। সেখানে পুলিশের সংখ্যা ছিল মাত্র ৫০০! তা সত্ত্বেও আহতদের প্রাথমিক ভাবে হাসপাতালে পাঠানোর কাজ পুলিশবাহিনীই করেছে। দেখা গিয়েছে, কর্তব্যরত পুলিশকর্মীদের একাংশ আহত দর্শককে পাঁজাকোলা করে ছুটছেন হাসপাতালের দিকে।
২০১২ সালে কেকেআরের আইপিএল জয়ের উদ্যাপন দেখতে প্রায় ৭০ হাজার দর্শক ইডেনে উপস্থিত হয়েছিলেন। গ্যালারিতে ঢোকার জন্য বিশেষ প্রবেশপত্রেরও বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। পুলিশের কড়া নজরদারিতে সেদিন দর্শকরা প্রবেশ করেছিলেন ইডেনে। প্রবেশপত্র ছাড়া কাউকে ইডেনের ধারেপাশে ঘেঁষতে দেওয়া হয়নি। পুলিশ সূত্রের খবর, ইডেনের অনুষ্ঠানের সময় প্রায় ৩০ হাজার মানুষ বাইরে অপেক্ষা করেছিলেন। রাস্তা থেকে তাঁরা ততক্ষণে চলে এসেছেন ইডেনের সামনে। সম্ভবত সেই কারণেই অনুষ্ঠান শেষের পরে খানিক তাল কেটেছিল। অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে ইডেনের বাইরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে লাঠিচার্জ করে। তাতে কয়েকজন আহতও হন। তবে গুরুতর আহত হওয়া বা প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি।
দ্বিতীয়ত, সেদিনের অনুষ্ঠানে কেকেআর কর্তৃপক্ষ তথা শাহরুখ অংশ নিয়েছিলেন কলকাতা পুলিশের শীর্ষ আধিকারিকদের পরামর্শ মেনে। যা পুলিশকে পরিস্থিতি সামলাতে সাহায্য করেছিল। বেঙ্গালুরুতে তেমন হয়নি বলেই খবর। একাধিক সূত্রের দাবি, ওই উদ্যাপন বুধবারের বদলে রবিবার করার অনুরোধ করা হয়েছিল আরসিবি-কে। কিন্তু তারা তাতে রাজি হয়নি। তাদের যুক্তি ছিল, ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের কারণে এমনিতেই আইপিএলের সূচি এক সপ্তাহ পিছিয়ে গিয়েছে। রবিবার উৎসব করা হলে অনেক বিদেশি ক্রিকেটারকে পাওয়া যাবে না। সেই অনড় মনোভাবই বিপর্যয় ডেকে এনেছে বলে অভিযোগ।