Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

গরাদ কেটে ও পাঁচিল টপকে উধাও ৩ বন্দি

শেষ রাতে অনেকগুলো কুকুর এক সঙ্গে চিল-চিৎকার করে ওঠায় টনক নড়ে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের পাহারায় থাকা পুলিশের। টর্চের জোরাল আলো ফেলে নজরদারি শুরু করতেই আক্কেল গুড়ুম। গল্ফ নম্বর ৫ (৭ নম্বর টাওয়ার)-এ পাঁচিলের গায়ে ঝুলছে বন্দিদের লুঙ্গি-গামছা পাকিয়ে বানানো একটি লম্বা দড়ি। রাত তখন প্রায় তিনটে। বেজে উঠল জেলের পাগলা ঘন্টি। শুরু হল দৌড়োদৌড়ি। কিছু ক্ষণের মধ্যেই খবর মিলল পানিশমেন্ট সেলের গরাদ কেটে, তিন-তিনটি পাঁচিল টপকে, চম্পট দিয়েছে তিন বন্দি। এর মধ্যে এক জন আজিম মিস্ত্রি যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত, বাকি দু’জন কুতুবউদ্দিন লস্কর এবং শামিম হাওলাদার বিচারাধীন বন্দি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ০৯ অগস্ট ২০১৪ ০৩:২৬
Share: Save:

শেষ রাতে অনেকগুলো কুকুর এক সঙ্গে চিল-চিৎকার করে ওঠায় টনক নড়ে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের পাহারায় থাকা পুলিশের।

টর্চের জোরাল আলো ফেলে নজরদারি শুরু করতেই আক্কেল গুড়ুম। গল্ফ নম্বর ৫ (৭ নম্বর টাওয়ার)-এ পাঁচিলের গায়ে ঝুলছে বন্দিদের লুঙ্গি-গামছা পাকিয়ে বানানো একটি লম্বা দড়ি। রাত তখন প্রায় তিনটে। বেজে উঠল জেলের পাগলা ঘন্টি। শুরু হল দৌড়োদৌড়ি। কিছু ক্ষণের মধ্যেই খবর মিলল পানিশমেন্ট সেলের গরাদ কেটে, তিন-তিনটি পাঁচিল টপকে, চম্পট দিয়েছে তিন বন্দি। এর মধ্যে এক জন আজিম মিস্ত্রি যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত, বাকি দু’জন কুতুবউদ্দিন লস্কর এবং শামিম হাওলাদার বিচারাধীন বন্দি। তিন জনের বিরুদ্ধেই ডাকাতি, অপহরণ-সহ একাধিক মামলা রয়েছে। ডাকাতি করতে গিয়ে খুনের অভিযোগ রয়েছে আজিম মিস্ত্রির বিরুদ্ধে।

প্রায় এক ঘণ্টা ধরে চলা এই ‘অপারেশন’ ঘুণাক্ষরেও টের পাননি বলে দাবি রক্ষী এবং পুলিশ কর্মীদের। তিন নম্বর বন্দি পাঁচিল থেকে বাইরের রাস্তায় ঝাঁপ দেওয়ার পরই কুকুরের দল সমবেত চিৎকার করে ওঠে। আর তখনই সতর্ক হন রক্ষীরা। তত ক্ষণে বন্দিরা হাওয়া।

বাংলাদেশি দুষ্কৃতীদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকায় তিন পলাতকের সীমান্ত পেরিয়ে যাওয়ার সম্ভবনাও উড়িয়ে দিচ্ছে না পুলিশ। এ দিন সকালেই সীমান্ত লাগোয়া থানা ও বিএসএফকে সর্তক করা হয়েছে। তিন পলাতকের ছবিও পাঠানো হয়েছে।

কী ভাবে পালাল আজিমরা?

জেল সূত্রের খবর, আলিপুর জেলের ‘পানিশমেন্ট সেল’-এর আট নম্বর ঘরে ছিল পাঁচ বন্দি। সাধারণত জেলে ঝগড়া-মারামারি, মোবাইল রাখা কিংবা মাদক নেওয়ার অভিযোগ ওঠে যে সব বন্দির বিরুদ্ধে, তাদেরই পানিশমেন্ট সেলে রাখা হয়। রাত দেড়টা নাগাদ বিশেষ ধরনের ছোট করাত দিয়ে প্রথমে ঘরের জং ধরা পুরনো কয়েকটি গরাদ কেটে সেলের ছাদে ওঠে আজিমরা। সেখান থেকে নামে সামনের করিডরে। এর পরে সন্তর্পণে দরজা পেরিয়ে পৌঁছে যায় সেলের দেওয়ালের কাছে। ওই দরজা বন্ধ থাকার কথা থাকলেও বৃহস্পতিবার রাতে সম্ভবত তা ছিল না বলে প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছে। এর পরে মাথায় বাঁকানো লোহার আংটা লাগানো গামছা-লুঙ্গির দড়ি ব্যবহার করে ছোট দেওয়ালটি টপকে যায় আজিমরা। এক জেলকর্মীর বক্তব্য, “এমনিতেই সেলের পাঁচিলটা একটু নিচুু। তার ওপরে বসানো কাঁটাতারও ভেঙেচুরে গিয়েছে। তাই আজিমদের টপকাতে বিশেষ অসুবিধে হয়নি।”

এর পরে তারা পৌঁছে যায় দ্বিতীয় বড় পাঁচিলটির সামনে। সেটি প্রায় ৩৫ ফুট উঁচু। বড় ও ছোট পাঁচিলের মধ্যে কিছুটা ফাঁকা জায়গায় রয়েছে জেলের ছাপাখানা, রান্নাঘর ইত্যাদি। এই অংশ দিয়ে তারা সোজা চলে যায় ১০ এবং ১১ নম্বর দেওয়ালের মাঝামাঝি অংশে। পাঁচিলের মাথায় লোহার আংটা আটকে দেয় তারা। তার পরে দড়ি বেয়ে উপরে উঠে সেই দড়ি উল্টোদিকে লাগিয়ে একে একে পাঁচিল বেয়ে নেমে যায়। পুলিশের সন্দেহ, আজিমদের সেলে থাকা বাকি দু’জনও পালানোর চেষ্টায় ছিল। কিন্তু তৃতীয় বন্দি পালানোর সময়ে হুড়মুড়িয়ে পড়ে গেলে আংটাটি খুলে যায়। তাই বাকিরা আর পালাতে পারেনি। যদিও পুলিশকে ওই দুই বন্দি জানিয়েছে, আজিমরা রাতে চা খাওয়ানোর পরে তাদের আর কিছু মনে নেই। পুলিশ অবশ্য ওই দুই বন্দিকে জেরা করছে।

শুক্রবার ভোর রাতে বন্দি পালানোর কথা জানাজানি হতেই প্রশাসনের শীর্ষ মহলে হইচই শুরু হয়। সকালেই জেলে যান কারামন্ত্রী হায়দার আজিজ সফি এবং কারা দফতরের এডিজি অধীর শর্মা। ঘটনাস্থল ঘুরে দেখার পরে মন্ত্রী স্বীকার করেন, এই ঘটনায় রক্ষীদের গাফিলতি রয়েছে। তিনি বলেন, “রাত দেড়টা থেকে তিনটের মধ্যেই পালিয়েছে বন্দিরা। ঘরের লোহার গরাদ কাটা হয়েছে। আমরা থানায় অভিযোগ করেছি।” কর্তব্যে গাফিলতির জন্য এ দিন সকালেই সাসপেন্ড করা হয়েছে জেলের সুপার চিত্তরঞ্জন ঘড়াইকে। সাসপেন্ড করা হয়েছে রাতে ওই এলাকায় পাহারায় থাকা দুই কারারক্ষী উত্তম কোনার এবং তন্ময় কর্মকারকেও। পরিমল ভট্টাচার্য ও দিলীপ দত্ত নামের দুই কারারক্ষীকে শো-কজ করেছে কারা দফতর। আলিপুর জেলে আফতাব আনসারির মতো কুখ্যাত অপরাধী ও জঙ্গিদেরও রাখা হয়। অনায়াসে পাঁচিল টপকে গিয়ে তিন বন্দি দেখিয়ে দিল, এই জেলের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আসলে কত ঠুনকো।

প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশের ধারণা, জেলের কর্মীদের একাংশের যোগসাজস ছাড়া এ ভাবে তিন জন একসঙ্গে জেল থেকে পালাতে পারত না। জেলের লেদ মেশিনেই দড়ির মাথার আংটা ও গরাদ কাটার করাতটি তৈরি করা হয়েছে বলে পুলিশের ধারণা। রাতে সেলের দরজায় পাহারা ছিল না কেন, তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পরে পুলিশ জেনেছে, বৃহস্পতিবার রাতে ওই এলাকায় ১৩ জন রক্ষীর পাহারায় থাকার কথা থাকলেও ছিলেন মাত্র তিন জন। পুলিশের অনুমান, রক্ষী কম থাকার বিষয়টি আগে থেকেই জানত ওই বন্দিরা। পুলিশ জেনেছে, এর আগে ডায়মন্ডহারবার ও দমদম জেল থেকেও পালিয়েছিল আজিম মিস্ত্রি। এ ক্ষেত্রেও আজিমই মূল চক্রী বলে সন্দেহ পুলিশের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE