E-Paper

পেটের টানে কাজে এসে ফেরা হল না ঘরে

রবিবার রাতে দুর্ঘটনার পরেই ঘটনাস্থলের কয়েকশো মিটার দূরে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় আহতদের।

শান্তনু ঘোষ

শেষ আপডেট: ১৯ মার্চ ২০২৪ ০৭:৩৮
হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এক আহতকে।

হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এক আহতকে। নিজস্ব চিত্র।

চাপ চাপ ধুলো মাখা কালো ব্যাগটাই একমাত্র সম্বল! সেটি নিয়ে এসএসকেএমের ট্রমা কেয়ারের সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন সাইরুল শেখ। সপ্তাহ তিনেক পরে ওই ব্যাগ নিয়েই তাঁর সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে ফেরার কথা ছিল ভাগ্নে নাসিমুদ্দিনের। কিন্তু, তা আর হল না। রুটি-রুজির টানে দৈনিক ৭০০ টাকা মজুরিতে যে বহুতল তৈরির কাজে শহরে এসেছিলেন নাসিমুদ্দিন, রবিবার রাতে সেটির নীচেই চাপা পড়ে মৃত্যু হয়েছে ২৪ বছরের
ওই যুবকের।

সোমবার সন্ধ্যায় কলকাতা পুরসভার অ্যাম্বুল্যান্সে ছেলের নিথর দেহ নিয়ে ট্রমা কেয়ারে পৌঁছে নাসিমুদ্দিনের বাবা আঞ্জিল শেখ বললেন, ‘‘সব শেষ হয়ে গেল। বাড়িতে আর কাকে নিয়ে যাব?’’ প্রতিবেশী এক যুবকের মাধ্যমে দিন কুড়ি আগে মুর্শিদাবাদের কোলান রাধাকান্তপুরের বাসিন্দা নাসিমুদ্দিন গার্ডেনরিচের ওই বহুতলে রাজমিস্ত্রির কাজে এসেছিলেন। সঙ্গে এসেছিলেন তাঁর এক শ্যালকও। সেই তরুণ, হুগলির বাসিন্দা ১৮ বছরের শেখ আবদুল্লাও ধ্বংসস্তূপের নীচে আটকে ছিলেন। এ দিন সন্ধ্যায় উদ্ধার হয় তাঁরও দেহ। এমন ভাবেই এ দিন সকাল থেকে কখনও কলকাতা পুলিশ, কখনও পুরসভার অ্যাম্বুল্যান্সে করে একের পর এক মৃতদেহ এসেছে পিজির ট্রমা কেয়ারে। সঙ্গে আসা প্রতিটি পরিবার ছিল বাক্‌রুদ্ধ। সকলে বলছেন, ‘‘কোথা থেকে যে কী হয়ে গেল! ভাবতেই পারছি না।’’

রবিবার রাতে দুর্ঘটনার পরেই ঘটনাস্থলের কয়েকশো মিটার দূরে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় আহতদের। পরিস্থিতি সামাল দিতে কার্যত বিনিদ্র রাত কাটিয়েছেন সেখানকার কর্মীরা। তাঁদেরই এক জনের কথায়, ‘‘রাতে একের পর এক আহতদের রক্তমাখা অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। চোখ বন্ধ করলে এখনও ওই দৃশ্য ভাসছে।’’

রাতে এসএসকেএমে কাউকে আনা না হলেও, এ দিন সকালে ওই বেসরকারি হাসপাতাল থেকে শামা বেগম (৪৫), হাসিনা খাতুন (৫৫)-এর মৃতদেহ এসএসকেএমের পুলিশ মর্গে নিয়ে আসে কলকাতা পুলিশ। বেলা যত গড়িয়েছে, একে একে আকবর আলি (৩৪), রিজওয়ান আলম (২৩), মহম্মদ ওয়াসিক (১৯), মহম্মদ ইমরান (২৭), রমজান আলি (৬০)-র ক্ষতবিক্ষত দেহ ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করে আনা হয় ট্রমা কেয়ারে। প্রত্যেককেই পরীক্ষা করে চিকিৎসকেরা মৃত বলে জানান। সন্ধ্যায় আসে নাসিমুদ্দিন ও আবদুল্লার দেহ। তাঁদের নিয়ে এ দিন রাত পর্যন্ত পিজি-তে আসা মৃতদেহের সংখ্যা হয় ৯। প্রত্যেকের এ দিনই ময়না তদন্ত করা হয়েছে বলে খবর।

বাড়ির ছেলে ভাঙা বহুতলের নীচে চাপা পড়েছে শুনে এ দিন সকালেই পিজির ট্রমা কেয়ারে চলে এসেছিলেন আবদুল্লার
পরিজনেরা। কিন্তু সেখানে কোনও খবর না পেয়ে তাঁরা চলে যান ঘটনাস্থলে। সন্ধ্যায় আবদুল্লার দেহ নিয়ে পিজিতে এসে তাঁর এক আত্মীয় শেখ সেলিম জানান, আগে জব্বলপুরে সোনার কাজ করতেন আবদুল্লা। বাজারে মন্দা চলায় দিন পনেরো আগে জামাইবাবু নাসিমুদ্দিনের সঙ্গে জোগাড়ে হিসাবে গার্ডেনরিচের বহুতলে কাজে যোগ দেন। জানা গিয়েছে, রবিবার রাতে বহুতলের দোতলায় শুয়েছিলেন নাসিমুদ্দিনেরা। রাত তিনটে নাগাদ দুর্ঘটনার খবর পান আঞ্জিল। তার পরেই চলে আসেন গার্ডেনরিচে। একই ভাবে,
এ দিন সকালে খবর পেয়ে হাওড়া থেকে তড়িঘড়ি গার্ডেনরিচ পৌঁছে যান আকবর আলির শ্যালক শেখ নাসিরুদ্দিন। বললেন, ‘‘দিদি
শারিকা বেগম হাসপাতালে ভর্তি। ওকে কী করে বলব, জামাইবাবু আর নেই!’’

এ দিন গার্ডেনরিচের ওই বেসরকারি হাসপাতালের সামনেও ছিল আহতদের পরিজনদের ভিড়। সেখানে থাকা, এ বছরের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী আকাশ পাত্র জানান, রাতে বিকট শব্দে
ঘুম ভেঙে তিনি দেখেন, ইটের দেওয়াল এবং টালির ছাউনির একাংশ ভেঙে পড়েছে। নীচে চাপা পড়ে রয়েছেন মা নমিতা পাত্র। কোনও মতে উদ্ধার করে তাঁকে ওই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এ দিন সকালে এসএসকেএম থেকে এক আধিকারিক-সহ
অস্থি, স্নায়ু-শল্য, শল্য, ইমার্জেন্সি মেডিসিনের চিকিৎসকদের ৯ জনের একটি দল ওই হাসপাতালে যায়। সেখান থেকে মইনুল হক,
মুসরত জাহান ও মহম্মদ সাইলুদ্দিন গাজিকে আনা হয় ট্রমা কেয়ারের বিপর্যয় ব্যবস্থাপনা ওয়ার্ডে। তাঁদের এক জনের মেরুদণ্ড ভেঙেছে, আর এক জনের পা ভেঙেছে।
তাতে সাড় নেই। আর এক জনের কোমরের নীচের অংশ ভেঙেছে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

migrant labour

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy