মাঠখোদাই মানে কী? কৃষিকাজ ও ফসল উৎপাদন বললে যা বোঝায়, ‘মাঠখোদাই’ও তা-ই। দুর্গাপুজোর সঙ্গে তার সম্পর্ক কী? কৃষির মতোই, শরতে পুজোমণ্ডপের পরিসর কর্ষণ করে সৃষ্টি হয় নিত্যনতুন শিল্প। কত কিছু দিয়েই তো গড়ে ওঠে সেই শিল্প। যেমন কাঠ। মানুষের হাতে কাঠের ব্যবহার কি আর আজকের? অতি প্রাচীন তা। উনিশ শতক ইস্তক শিল্পকলার পরিসরে ‘কাঠখোদাই’ বা উডকাট এক আলাদা জায়গা করে নিয়েছে, উৎকর্ষের শিখর ছুঁয়েছে বাংলার শিল্পীদের হাত ধরে। সৃষ্টিশীলতা, শিল্পচর্চা, শিল্পমাধ্যম আর পুজো-শিল্প— এই নানা দিককেই এ বার পুজোয় মেলাচ্ছে দক্ষিণ কলকাতার পূর্বাচল শক্তি সঙ্ঘ, ‘মাঠখোদাই, কাঠখোদাই’ মূল ভাবনা ঘিরে। তাকে কেন্দ্রে রেখে, খোদাইশিল্পের সঙ্গে সংযুক্ত চিত্র-আলোকচিত্র-ভাস্কর্যের পরিসরে সাত জন শিল্পীর কাজে গড়ে উঠছে এক যৌথ শিল্পমণ্ডপ।
সাধারণত পুজো-শিল্পের অঙ্গনে এক জন প্রধান শিল্পীর সৃষ্টিপ্রকল্পে সঙ্গত করেন সহযোগী শিল্পীরা। সেই চেনা কাঠামো ভেঙেছেন এ বার উদ্যোক্তারা। মূল ভাবনার সঙ্গে সমঞ্জস, নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের স্বাধীন ভাবে করা কাজ একসূত্রে গাঁথছেন তাঁরা। কাঠখোদাই-ছবির দিকপাল শিল্পী হরেন দাসের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্যে সেজে উঠবে এই দুর্গাপুজোর মণ্ডপ। লিনোকাট, লিথোগ্রাফ, এচিং-এর মতো মাধ্যমে কাজ করলেও, উডকাট মাধ্যমে উৎকর্ষের সর্বোচ্চ স্তর ছুঁয়েছিলেন এই শিল্পী। বাংলা তথা ভারতের এক অস্থির সামাজিক ও রাজনৈতিক সময়ে বিকশিত তাঁর শিল্পীজীবন। শহর কলকাতায় বসে করা তাঁর কাজে উঠে আসত গ্রামজীবনের ছোট ছোট মুহূর্ত, দিনাজপুরে অতিবাহিত তাঁর শৈশবস্মৃতিও। সমকালীন বাস্তবের বৃহৎ আখ্যানের নীচে চাপা পড়ে যাওয়া সহজ সুখস্মৃতি ধরা আছে, খোদাই করা কাঠের ব্লক থেকে তোলা তাঁর প্রিন্টগুলিতে।
এই সময়ের শিল্পীদের কাজেও যেন পূর্বজের ছায়া। আশীষ ঘোষ ও অভিজিৎ হালদারের ভাস্কর্যে, তন্ময় চক্রবর্তী ও মিল্টন ভট্টাচার্যের ছাপচিত্রে, সৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সায়নদীপ কংসবণিকের চিত্রকলায়, বিজয় চৌধুরীর আলোকচিত্রে এমন বিষয় কম্পোজ়িশন ভাব ও রসের বিস্তার, যা অদ্ভুত ভাবে মনে করায় হরেনবাবুর খোদাইচিত্র। এ কথাটা বলা দরকার, আজকের শিল্পীদের কাজগুলি এ বারের পুজোর জন্য আলাদা করে তৈরি নয়, আগেই সৃষ্টি হয়েছিল তারা, অথচ এ বারের পুজোর মূল ভাবনার সঙ্গে মিলেমিশে গেছে অনায়াসে। এ যেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বয়ে চলা এক শিল্প-সংলাপ, প্রকৃতি মানুষ জীবন ও স্মৃতি দিয়ে গাঁথা। সেই অলৌকিক সংলাপই রূপ পাচ্ছে পুজোমণ্ডপে, যার সূত্রধর তথা কিউরেটরের গুরুদায়িত্বটি শিল্পী পার্থ দাশগুপ্তের, নকশা ও প্রতিমাও তাঁরই। গবেষণার কাজ করেছেন দেবদত্ত গুপ্ত। ছবিতে উপরে হরেন দাসের খোদাইচিত্র, নীচে বিজয় চৌধুরীর আলোকচিত্র।
জীবন-নাট্য
বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার (ছবি) জীবন নিয়ে জনপরিসরে কথা হয় না তত। অথচ স্বাধীন তথা আধুনিক ভারতে বিজ্ঞানকে কী ভাবে দেশের মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করা যাবে, ভাবিত ছিলেন তিনি তা নিয়ে; কুসংস্কার অজ্ঞানতা অশিক্ষার কবল থেকে দেশবাসী যাতে মুক্ত হয়, সেই লক্ষ্যে ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। আধুনিক প্রযুক্তি ও ভারী শিল্প স্থাপনের মাধ্যমে দেশের দারিদ্রমুক্তির পক্ষে ছিলেন তিনি; ক্লাসরুম ও ল্যাবরেটরি থেকে বেরিয়ে, লড়েছিলেন রাজনীতির ময়দানেও। ভারতে নিউক্লিয়ার গবেষণার এই পথিকৃতের স্বপ্ন ছিল কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গকে দেশের পারমাণবিক গবেষণার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা। এই কর্মময় ব্যতিক্রমী জীবনকে নাট্যে ধরা সহজ নয় বড়, সেই কাজটিই করেছেন নাটককার সুদীপ্ত ভৌমিক। ‘অশোকনগর নাট্যআনন’ তা মঞ্চে আনছে চন্দন সেনের নির্দেশনা ও মুখ্য অভিনয়ে। আগামীকাল, ১৪ সেপ্টেম্বর রবিবার সন্ধে সাড়ে ৬টায় অ্যাকাডেমি মঞ্চে প্রথম অভিনয় মেঘনাদ-এর।
নিরীক্ষার ছবি
গত তিন বছর ধরে শহরে হচ্ছে অন্য ঘরানার এক চলচ্চিত্র উৎসব। পরিবর্তিত সময়, মূল্যবোধের আবহে কি বদলে যাচ্ছে সিনেমার ভাষা— এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে ‘ইমামি আর্ট এক্সপেরিমেন্টাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’। ইমামি ফাউন্ডেশন, কলকাতা সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভিটি (কেসিসি)-র সঙ্গে চতুর্থ বছরের উৎসব-সঙ্গী সত্যজিৎ রায় ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট (এসআরএফটিআই)। দু’টি দিন এর মধ্যেই অতিক্রান্ত, আজ ও আগামী কাল যথাক্রমে কেসিসি ও এসআরএফটিআই-তে দেখা যাবে নিরীক্ষাধর্মী নানা ছবি, সকাল ১১টা থেকে সন্ধে পর্যন্ত। হবে আলোচনাও।
দেড়শো বছরে
“এই কথাটাই আপনাদিগকে বিশেষ করিয়া স্মরণ করাইতে চাই যে, যথার্থ স্বাধীন ও মৌলিক চিন্তার সাক্ষাৎ মাতৃভাষা ভিন্ন ঘটে না।” ‘মাতৃভাষা এবং সাহিত্য’ রচনায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বলা এ কথার তাৎপর্য আজ যে কত প্রাসঙ্গিক, বলার অপেক্ষা রাখে না। অমর কথাশিল্পীর জন্মদিন সমাগত, ১৫ সেপ্টেম্বর— এ বছর তাঁর সার্ধশতবর্ষের সূচনা। এই উদ্যাপনেরই অংশ বহুমাত্রিক শরৎচন্দ্র (জ্ঞানদীপ প্রকাশনী) নামের গ্রন্থ প্রকাশ-অনুষ্ঠান, ১৭ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচার গোলপার্কের শিবানন্দ হল-এ। বলবেন সুমিতা চক্রবর্তী ও সোমনাথ ভট্টাচার্য। দেবজ্যোতিনারায়ণ রায় সম্পাদিত বইটিতে নানা মণিকণা: রবীন্দ্রনাথ ও সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে শরৎ-পত্রালাপ, তাঁর জন্মদিনের প্রতিভাষণ, সমসময়ের স্মৃতিচারণ, কবিতার্ঘ্য, একগুচ্ছ নিবন্ধে এই সময়ের মূল্যায়নও।
উত্তরণের গাথা
মধ্যযুগের এক অসামান্য গাথা রচিত হয়েছিল কবি দ্বিজ বংশীদাসের কন্যা, প্রথম বাঙালি মহিলা কবি হিসেবে কথিত চন্দ্রাবতীকে ঘিরে। প্রেমিক জয়ানন্দ তাঁর সঙ্গে প্রতারণা করে, বেদনার্ত চন্দ্রাবতী জীবন সঁপে দেন মাতৃভাষায় রামায়ণ পালা রচনায়। মূল মহাকাব্য যেখানে সীতার প্রতি উপেক্ষায় বিধুর, সেখানে চন্দ্রাবতীর পালায় সীতা হয়ে ওঠেন মূল চরিত্র। ও দিকে জীবনেও নাটকীয়তা: অনুতপ্ত জয়ানন্দ ফিরে আসে, চন্দ্রাবতী কিন্তু সাড়া দেন না, প্রত্যাখ্যাত জয়ানন্দ আত্মহত্যা করে। দুঃসহ আঘাত-বেদনা অতিক্রম করে বাকি জীবন পালা রচনাতেই উৎসর্গ করেন চন্দ্রাবতী। এই গল্প হলেও সত্যিকে নাচে-গানে গেঁথে নাট্যমঞ্চে এনেছে ‘নান্দীপট’; উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়ের রচনায়, প্রকাশ ভট্টাচার্যের নির্দেশনায়। দলের ৪৭তম প্রতিষ্ঠাদিবসে আগামী ১৮ সেপ্টেম্বর সন্ধে সাড়ে ৬টায় চন্দ্রাবতী কথা-র অভিনয়, অ্যাকাডেমি মঞ্চে।
শতবর্ষী
“আমাদের অভাবের নদীর উপর দিয়ে/ কেন ওরা সব পাঁজরকে গুঁড়িয়ে যায়?” গত শতকের মাঝামাঝি ‘পরাণ মাঝি হাঁক দিয়েছে’ কবিতায় এই উচ্চারণ রাম বসুর। পঞ্চাশের দশকের কবি বলে তাঁকে চিহ্নিত করে বাংলা কবিতার ইতিহাস, তবে ১৯৫০-এর প্রথম কবিতাবই তোমাকে থেকে শুরু করে ২০০৭-এ প্রয়াণের বছরে প্রকাশিত যাই, যাচ্ছি পর্যন্ত তাঁর সুদীর্ঘ কবিতাযাত্রার পদচিহ্ন দেখলে বোঝা যাবে, বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বামপন্থী প্রতিবাদী চেতনা যেমন তাঁর কবিতায় জারিত, তেমনই সঙ্গী প্রেমও— মানুষ জীবন প্রকৃতি থেকে যা আলাদা নয়। ১৯৮৯-এ রবীন্দ্র পুরস্কারে ভূষিত এই কবির জন্মশতবর্ষ এ বছর, ভোলেনি একুশের ডাক পত্রিকা। আজ বিকেল সাড়ে ৫টায় সুকিয়া স্ট্রিটে রামমোহন লাইব্রেরির রায়া দেবনাথ হল-এ উদ্যাপন: স্মৃতিচারণ, আলোচনা, গান, কবিতায়।
একটি ছবি ঘিরে
অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের কাহিনি অবলম্বনে, হরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় প্রযোজিত, নীরেন লাহিড়ী পরিচালিত উত্তম-সুচিত্রা জুটির ছবি ইন্দ্রাণী মুক্তি পায় ১৯৫৮ সালে। উত্তমকুমার অভিনীত কোনও ছবিতে হিন্দি গানের ব্যবহার সেই প্রথম, মহম্মদ রফির কণ্ঠে ‘সবহি কুছ লুটা কর হুয়ে হম তুমহারে’। বাকি ছ’টি বাংলা গানের রচয়িতা গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার; সঙ্গীত পরিচালক নচিকেতা ঘোষ। উত্তমকুমারের জন্মশতবর্ষের সূচনালগ্নে এই ছবিরই একগুচ্ছ স্মারকের প্রদর্শনে মহানায়ককে শ্রদ্ধা জানাল উত্তরপাড়া জীবনস্মৃতি আর্কাইভ, গত ৩-৭ সেপ্টেম্বর। দেখা গেল সিনেমার দুষ্প্রাপ্য ফিল্ম স্টিল ও তার নেগেটিভ, সিনেমা-পুস্তিকা, পোস্টার, এই চলচ্চিত্রের নামলিপি-সম্বলিত মূল জাবদা খাতাটিও (ছবিতে তারই একটি পৃষ্ঠা)। এই সামগ্রীগুলি সংরক্ষণে নেওয়া হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা, অ্যাসিড-মুক্ত আবরণের মধ্যে রাখা হয়েছে অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে। প্রদর্শনীটির ভাবনা ও রূপায়ণ অরিন্দম সাহা সরদারের। বাংলা সিনেমার ইতিহাস সংরক্ষণে এই তো চাই!
নান্দনিক
এক ছাদের তলায় গান নাচ অঙ্কন কবিতা-চর্চা, আবার যোগব্যায়াম আর টেবিল টেনিসেরও অনুশীলন, এ শহরে সম্ভব করেছে বন্ডেল রোডের সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ‘কলাভৃৎ’। আড়াই দশকেরও বেশি যাত্রাপথে পেয়েছে বাংলার নানান গুণিজনের পরশ, আশীর্বাদও: গান ও নাচের কর্মশালায় এখানে এসেছেন মান্না দে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় অমর পাল সংযুক্তা পাণিগ্রাহী। চার হাজার বাংলা গানের (ডিস্ক) সংগ্রহশালা রয়েছে ওদের, ভবনের অন্দরসজ্জা বাংলার পটচিত্র দিয়ে। রবীন্দ্র সদনে সম্প্রতি হয়ে গেল অনুশীলা বসুর পরিচালনায় ওদের অনুষ্ঠান ‘বিরাজ সত্য সুন্দর’; সেখানে নজর কাড়ল ওদের নান্দনিকতা— কচিকাঁচা সদস্যদের আঁকা অনুষ্ঠানের ১০৬৮টি আমন্ত্রণপত্র, প্রত্যেকটিই স্বতন্ত্র শিল্পকৃতি! গুণিজনদের হাতে তুলে দেওয়া হল আর্ট প্লেট, গণেশ-কোলে মা দুর্গা আসছেন বাপের বাড়ি (ছবি)। ছিল রণপা-নৃত্য; গান, নাচ, আবৃত্তি, ঢাকের বাদ্যিও!
মুহূর্তকথা
তাঁদের জীবদ্দশাতেই তাঁরা মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন প্রতাপ দাশগুপ্ত সম্পর্কে— সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং মৃণাল সেন। পর পর তিন বছর, ২০০৪-২০০৬, এই তিন জনকে নিয়েই স্থিরচিত্রের প্রদর্শনী করেছিলেন আলোকচিত্রী প্রতাপ। তাঁর সেই সব ছবিতে ওই তিন শিল্পী সাহিত্যিক চলচ্চিত্রকার তাঁদের দৈনন্দিন যাপনের মুহূর্তকথার মাঝেও যেন জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠেছিলেন। মাঝখানে চলে গেছে অনেকগুলো শরৎ-বসন্ত— এত বছর পর এ বার বর্ষীয়ান চিত্রশিল্পী যোগেন চৌধুরীকে নিয়ে প্রদর্শনী করছেন এই আলোকচিত্রী— ‘পোর্ট্রেটস অব দ্য লিভিং লেজেন্ড’। আগামী ১৮ সেপ্টেম্বর, বৃহস্পতিবার, সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে গ্যালারি চারুবাসনা-য় ‘সুনয়নী’ কক্ষে এই প্রদর্শনীর উদ্বোধন। দেখা যাবে আগামী ২৫ তারিখ পর্যন্ত।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)