E-Paper

পদ্যের ধুলোপথে প্রথা ভাঙার উদ্‌যাপন, মঞ্চের আলোয় এ বার জীবনী-শক্তি

প্রিয় বন্ধুর বয়স ৬০ পেরোতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘পৃথিবীর শক্তি চট্টোপাধ্যায়দের বয়স বছরের হিসেব কষে হয় না। শক্তির মধ্যে এখনও যে একটা দুরন্ত শিশু রয়ে গেছে।’

সম্রাট মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৮:৩৭
শক্তি চট্টোপাধ্যায়।

শক্তি চট্টোপাধ্যায়।

নিয়মকে ধুলোয় উড়িয়ে চলার নিয়মেই ব্রতী ছিলেন আজীবন। তাঁর কলমও দৌড়ত দলছুট, দুর্নিবার, দুরন্ত খ্যাপামির এলোমেলো আলপথ ধরে। যে কলম হেলায় বলতে পারে, ‘সে দীর্ঘ লোকটি ভালবাসত তীব্র বাহিরের আলো / গলিতে আঁটবে না তাকে, জেনে, যেত সদর সড়কে / সড়কে ধরবে না বলে চলে যেত ময়দানের ঘাসে / ময়দানে যদি না আঁটে, ভেবে, যেত সমুদ্রে, গভীরে / এরই নাম অস্থিরতা।’

প্রিয় বন্ধুর বয়স ৬০ পেরোতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘পৃথিবীর শক্তি চট্টোপাধ্যায়দের বয়স বছরের হিসেব কষে হয় না। শক্তির মধ্যে এখনও যে একটা দুরন্ত শিশু রয়ে গেছে।’ সেই দুরন্ত শিশুরই বোধহয় প্রশ্ন ছিল, ‘যেতে পারি, কিন্তু কেন যাব...’? যদিও তাতে তাঁর বিদায় বিলম্বিত হয়নি। কবিতার খাতা উল্টে রেখে মাত্র ৬১ বছর বয়সেই স্বভাবসিদ্ধ ঢঙে ‘উধাও’ হয়ে যান তিনি। এ বার অবশ্য চিরতরে। হঠাৎ উধাও হওয়ার যে অভ্যাসে তাঁরই বরাবরের ‘কপিরাইট’, তাতেই যেন পূর্ণচ্ছেদ টেনে দিলেন নিজে।

নিজের প্রতি কৌতুকপূর্ণ তাচ্ছিল্যও ছিল শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘ট্রেডমার্ক’। যিনি নিজেরই শ্রেষ্ঠ কবিতার সঙ্কলনের ভূমিকায় অবলীলায় লিখতে পারেন, ‘আমার কোনও কবিতার বই-এ ‘শ্রেষ্ঠ’ পদবন্ধটি নির্বিকার ভাবে জুড়ে গেছে— কল্পনা করাও শক্ত। তবু, পাকেচক্রে হয়ে গেছে বলে, পাঠকের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।’

কবিতাকে বলতেন পদ্য। নিজের পদ্য আর জীবনের মাঝে কখনও কোনও সীমানা-প্রাচীর তোলেননি শক্তি। পদ্য গড়িয়ে যেত জীবনের দিকে, জীবন উথলে পড়ত পদ্যের পাতায়। বন্ধু, সহকর্মী, সুহৃদরা জানতেন, নিজের খামখেয়ালি যাপন থেকেই পাখির মতো করে রসদের খুদকুঁড়ো কুড়িয়ে আনতেন তিনি। সেই সংগ্রহই হয়ে উঠত তাঁর পদ্যের খাতা। তাঁরা বুঝতেন, ওই যাপন থেমে গেলে শক্তিও হয়তো আর শক্তি থাকবেন না।

দক্ষিণ ২৪ পরগনার বহড়ু গ্রাম থেকে কলকাতার অলিগলি, ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য নানা কাজ থেকে আনন্দবাজার পত্রিকার বার্তা বিভাগ— শক্তির বর্ণময় এবং আশ্চর্য সেই যাত্রারই গল্প বলবে পূর্ব-পশ্চিম নাট্যদলের নবতম প্রযোজনা ‘আ-শক্তি’। তাঁর কবিতা ও জীবনের রসেই জারিত এ গল্পের চলন। কবির ছোটবেলা আর বড়বেলা পরস্পরকে কী ভাবে জড়িয়ে রয়েছে, সে কথাই বলছিলেন নাটকের ‘শক্তি’ দেবশঙ্কর হালদার। তাঁর কথায়, ‘‘শক্তির মধ্যে এক ছেলেমানুষ বাস করত। সেই ছোট শক্তি বার বারই চলে আসত বড় শক্তির কাছে। ছোটবেলার যন্ত্রণা বড়বেলাকে ছুঁয়ে যেত, আবার বড়বেলার যন্ত্রণা ছোটবেলাকে মনে করাত। এই যাতায়াতটা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি আমরা। ছোটবেলায় মামাবাড়ির জীবন, পরবর্তী কালে বিয়ে, সংসার, আনন্দবাজারের কর্মজীবন এবং সুনীল, সন্দীপন, তারাপদ, শরতের মতো বন্ধুদের সঙ্গে শক্তির যাপন, রাজনীতি— সবই রয়েছে।’’

‘আ-শক্তি’র পরিচালনার পাশাপাশি আলো, মঞ্চ, আবহ এবং সম্পাদনা, সবটাই সামলাচ্ছেন নাট্যকার দেবাশিস। বাবার হাত ধরে ছোটবেলা থেকেই কবিতার একনিষ্ঠ পাঠক তিনি। দেবাশিস বলছেন, ‘‘পড়ার সুবাদে শক্তি সম্পর্কে জানা ছিল অনেকটাই। খামখেয়ালি, কিছুটা অ্যানার্কিস্ট এবং বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। ওঁর জীবন নিয়ে নাটক করার প্রস্তাব আসায় সানন্দে সম্মত হই। ওঁর পরিবারের সঙ্গেও কথা হয়। কাজটা করতে গিয়ে আরও অনেক কিছু জানলাম। শক্তির কবিতাও নতুন করে উপলব্ধি করছি। আমার মনে হয়, যে কোনও সাহিত্যই আত্মজৈবনিক। সাহিত্যিকের জীবনের ছায়া তাঁর সাহিত্যকর্মেও থাকে।’’

শক্তিকে সব চেয়ে কাছ থেকে যিনি দেখেছেন এবং বলা ভাল, সামলেছেনও দীর্ঘ বছর, সেই স্ত্রী মীনাক্ষী চট্টোপাধ্যায় ইচ্ছে থাকলেও শারীরিক কারণে মহলায় যেতে পারেননি। মঞ্চস্থ হলে হয়তো যাবেন দেখতে। গল্পটা শুনেছিলেন প্রথমে। পরে তাতে কিছু পরিবর্তন হয়েছে বলেও শুনেছেন। মীনাক্ষীও তাই আরও অনেকের মতো এই নাটক নিয়ে কৌতূহলী। বললেন, ‘‘ওঁকে নিয়ে যে নাটক হচ্ছে, এটা বেশ ইন্টারেস্টিং লাগছে আমার। তবে, দর্শক কী ভাবে নেবেন, জানি না। ওঁর জীবনে কিছু বাড়াবাড়ির দিকও তো ছিল, সে সব নাটকে না থাকলেই ভাল। তবে, এই উদ্যোগটা ভাল লাগছে।’’ দেখতে যেতে পারবেন কিনা, জানেন না তিনি। বললেন, ‘‘আমি তো হুইলচেয়ারে চলাফেরা করি। যদি শরীর ভাল থাকে, দেখতে যাব।’’

নাটকের ভাবনা যাঁর মস্তিষ্কপ্রসূত, সেই সৌমিত্র মিত্রের অসংখ্য স্মৃতি শক্তিকে ঘিরে। তাঁর কথায়, ‘‘ওঁর সঙ্গে এত সময় কাটিয়েছি, বলে শেষ করার নয়। শক্তিদাকে নিয়ে নাটক আসলে ওঁর কবিতা আর জীবনের উদ্‌যাপন। মনে পড়ে, শক্তিদা যে দিন বেতন পেতেন, সে দিন সিরাজদা বা শীর্ষেন্দুদা ওঁকে পাহারা দিতেন, যাতে টাকা নিয়ে শক্তিদা উধাও না হয়ে যান বা খরচ না করে ফেলেন। তার পরে মীনাক্ষীদি এসে সেই টাকা নিয়ে যেতেন।’’

সৌমিত্রের উৎসাহেই নাটকটি লিখতে শুরু করেন উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলছেন, ‘‘কারও জীবন নিয়ে কাজ বেশ চ্যালেঞ্জিং বিষয়। সাদামাটা ভাবে ওঁর জীবনটা দেখাতে চাইনি আমরা। ওঁর কবিতা আর জীবন মেলাতে চেয়েছি। শক্তির জীবনের কিছু কম জানা দিক তুলে এনেছি। ওঁর মদ্যপান বা নেশা করা নিয়ে কত গল্পই তো রয়েছে। এই নাটকে সেটি গুরুত্ব পায়নি। শক্তির ছিল সংসারে এক পা, বাইরে এক পা। এই বোহেমিয়ান শক্তি আর সংসারী শক্তি কী ভাবে একত্রবাস করতেন, সেটাই তুলে ধরেছি আমরা।’’

শক্তিকে নিয়ে অসংখ্য স্মৃতি বন্ধু শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়েরও। তাঁর মনে পড়ছে, ‘‘স্বভাব-কবি বলতে যা বোঝায়, শক্তি ছিল তা-ই। অমিত বিস্ফোরক আর অমেয় প্রেম ছিল ওর মধ্যে। আমাদের তুই-তোকারির সম্পর্ক ছিল বটে, তবু শক্তির প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধাও ছিল। চোখের সামনেই দেখেছি শক্তিকে তাৎক্ষণিক কবিতা লিখে ফেলতে।আর কী সব অসাধারণ কবিতা। শক্তি বরাবর ওর কবিতাকে পদ্য বলে এসেছে। শব্দটি তাচ্ছিল্যসূচক বটে, কিন্তু ওর পদ্যকে তাচ্ছিল্য করে, এমন সাধ্যি কার! এখন শক্তিকে মঞ্চে দেখার অপেক্ষা।’’

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

theatre drama

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy