Advertisement
E-Paper

ভয় নিয়েই শুরুটা, তবে এখন অকুতোভয়

এই বিশ্বাসে জোর এসেছে ঢেউ গুনতে গুনতেই। সংক্রমণের ঢেউ নয়, বিপুল জলরাশির

অয়ন প্রধান (গবেষক)

শেষ আপডেট: ২১ মে ২০২১ ০৬:৫৭
প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

দুনিয়াকে শাসন করার চেষ্টা করছে যে অদৃশ্য শত্রু সৈন্য, তাদের খুঁজে বার করাই আমাদের কাজ। ধরতে পারলেই গ্রেফতারি পরোয়ানার রিপোর্ট তৈরি করা পর্যন্ত আমাদের দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব পেয়েছিলাম গত বছরের এপ্রিলে। প্রথমে ভয়, সঙ্গে কিছু অস্বস্তি ছিল। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি, শত্রু কমজোর হওয়ায় আমরাও খানিক বিরতি পেয়েছিলাম। ফের বেগতিক অবস্থা। বাড়ছে দায়িত্ব। এখন অনেকটাই চিনেছি শত্রুকে। কিছু পদ্ধতি মেনে ঠান্ডা মাথার লড়াইয়ে জয় আসবে নিশ্চিত, এই বিশ্বাস গেঁথে গিয়েছে।

এই বিশ্বাসে জোর এসেছে ঢেউ গুনতে গুনতেই। সংক্রমণের ঢেউ নয়, বিপুল জলরাশির। ছোট্ট থেকেই মন ভাল আর খারাপ, দুই সময়েই সমুদ্রের সঙ্গে ভাব জমে খুব। পিজি হাসপাতালে জন্ম হলেও বেড়ে ওঠা মূলত পূর্ব মেদিনীপুরের এগরা থানার নেগুয়া গ্রামে। গ্রাম থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে সমুদ্র। আইআইটি খড়্গপুরে
ক্যানসার বায়োলজি গবেষণায় হাতেখড়ি। ২০১৬ সাল থেকে এসএসকেএমের সঙ্গে যুক্ত। রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস এবং ক্যানসার বায়োলজির প্রজেক্টে গবেষণা করছি। কী ভাবে কোভিডের সঙ্গে যুক্ত হলাম?

গত বছর মার্চে লকডাউন শুরু হতেই বাড়ি যাই। সপ্তাহ তিনেকের মধ্যে ডাক আসে হাসপাতাল থেকে। নেমে পড়লাম যুদ্ধে। ঢাল বলতে পিপিই আর দুটো এন ৯৫ মাস্ক। সঙ্গী হল পরিবারের একরাশ আতঙ্ক। যদিও ভয় নিয়েই শুরুটা, তবে এখন অকুতোভয়। ভাইরাস, ব্যাক্টিরিয়া নিয়ে কাজ ও আরএনএ আলাদা করার অভিজ্ঞতা থাকায় ডাক পড়েছিল। সে সময়ে দিনে ১০০০টা লালারস পরীক্ষাও করতে হয়েছে এক-এক জনকে। সেই কাজে ১২ ঘণ্টাও পেরিয়ে যেত।

পিপিই পরার পরে শৌচাগারে যাওয়া যেত না। গেলে পিপিই বদলাতে হবে। সেই সময়ে পিপিই-র অভাবে এমন কিছু করা ছিল চরম বিলাসিতা। ফলে জল খুব কম খেতাম। এতে পেশিতে টান ধরত, মাথা ঘুরত, ক্লান্ত লাগত। এ নিয়েই চলছিল বাঘা যতীনের দু’কামরার ফ্ল্যাট থেকে এসএসকেএমে যাত্রা। আমার থেকে মা, বাবা বা ভাইয়ের সংক্রমণ হতে পারে, তাই বাড়ি যাইনি বহু মাস। একা ফ্ল্যাটে ঘিরে থাকত প্রিয়জনের মুখ আর ফোনে চেনা মানুষের স্বর। পুজোর সাত দিন আগে হানা দিল শত্রু। মাস্ক পরে শ্বাসে ঝাপসা হওয়া চশমা আর ঘাম গড়িয়ে অস্বস্তি মুছতে
ভুলবশত হাত চলে যেত মুখে। তেমনই এক অসতর্ক মুহূর্তে সে ঢুকে পড়ল। লালারসের নমুনা কিছু ক্ষেত্রে এমন ভাবে আসে যে লালা বেরিয়ে যায়। তখনই সেটা হাতে লেগে যায়। কখনও আবার ২৪ ঘণ্টা ধরে ঘুরতে থাকা সেন্ট্রিফিউজ (লালারস পরীক্ষার যন্ত্র) খারাপ হয়ে যেত। চার-পাঁচ জন হুড়মুড়িয়ে পড়তাম একটা যন্ত্রে।

ভাবছেন হয়তো, এ নতুন কী? এটাই তো পেশা। আমাদের কিন্তু এই কাজের প্রাপ্তি বলতে শুধুই সার্টিফিকেট। তবু এমন সঙ্কটে গুরুত্ব বুঝে ঝাঁপিয়ে পড়েছি।

হাল্কা জ্বর আর গায়ে ব্যথার উপসর্গ ছিল। রিপোর্ট এল পজ়িটিভ। ফ্ল্যাটে একাই থাকতাম। হোম ডেলিভারির খাবার নীচের দরজা থেকে আনতাম। স্যরদের পরামর্শ আর সহকর্মীদের সাহায্য ছিলই। রিপোর্ট নেগেটিভ এলেও ক্লান্তি গিলে খেয়ে নিচ্ছিল। সাত মাস পরে বাড়ি গেলাম সাত দিনের জন্য। বাইক নিয়ে রোজ সমুদ্রের কাছে যেতাম। সঙ্গী হত বন্ধুরা। শুষে নিতাম অক্সিজেন। আর ছিল বাবা-মা ও ভাইয়ের স্নেহমাখা পরিচর্যা। নভেম্বরে যোগ দিলাম নিজের গবেষণায়। পাশাপাশি নমুনা পরীক্ষার কাজ। জানুয়ারি থেকে যোগ হল হাসপাতালের প্রতিষেধক প্রদান কর্মসূচির উপরে নজরদারির দায়িত্ব। এখন গবেষণা, নমুনা পরীক্ষা আর প্রতিষেধক― তিনটে কাজেই জড়িয়ে গিয়েছি।

জানি, কোভিড-যুদ্ধে মৃত সেনানীদের পরিবারের ক্ষত কোনও দিন শুকোবে না। তবুও বলব, জয় আসবেই। ওঁদের ত্যাগ আমরা ব্যর্থ হতে দেব না।

COVID-19
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy