Advertisement
০১ মে ২০২৪
Presidency University

প্রেমহীন প্রেসিডেন্সি! লাভার্স লেনের কী হবে? নীতিপুলিশির অভিযোগে প্রশ্ন প্রাক্তনীদের

নীতিপুলিশি হয়েছে কি হয়নি, তা নিয়ে শেষ কথা বলছেন না। কিন্তু শেষে কিনা সহপাঠীদের সঙ্গে মেলামেশার অধিকার নিয়ে মুখ খুলতে হচ্ছে প্রেসিডেন্সির পড়ুয়াদের, তা শুনে বিস্মিত প্রাক্তনীরা!

Presidency University

প্রেসিডেন্সির ক্যাম্পাসে কোনও যুগলকে নিভৃতে সময় কাটাতে দেখলেই কর্তৃপক্ষ তাঁদের ধরছেন। এমনকি, ডেকে পাঠানো হচ্ছে অভিভাবকদের। ছবি: সংগৃহীত।

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ জুন ২০২৩ ১৯:২০
Share: Save:

প্রেসিডেন্সি খবরে থাকবেই! হাটের মাঝে কথা পড়া মাত্র এমনই বক্তব্য বহু সদ্য প্রাক্তনীর। কেউ হাসলেন। কেউ হায় হায় করলেন। কিন্তু নিজেদের শিক্ষাঙ্গন নিয়ে বলা গল্পের পরতে পরতে ঝলকে ওঠা গৌরব আড়াল করলেন না। তবে সে কালের প্রাক্তনীদের গৌরব আলাদা। প্রেসিডেন্সি চত্বরে ‘অস্বাভাবিক’ কিছু হলে অবাক হন তাঁরা। এখনও। ‘নীতিপুলিশি’র অভিযোগ উঠেছে শুনেই যেমন বিস্মিত হলেন বছর আশির এক প্রাক্তনী। বললেন, ‘‘এ সব হচ্ছে? শেষে কিনা প্রেসিডেন্সিতে!’’

প্রেসিডেন্সির ক্যাম্পাসে কোনও যুগলকে নিভৃতে সময় কাটাতে দেখলেই কর্তৃপক্ষ তাঁদের ধরছেন। এমনকি, ডেকে পাঠানো হচ্ছে অভিভাবকদের। এমনই অভিযোগ তুলেছেন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের একাংশ। শুক্রবার এমন অভিযোগ-সহ অন্য কয়েকটি বিষয় নিয়ে ছাত্র সংগঠন এসএফআইয়ের পক্ষ থেকে স্মারকলিপি দেওয়া হয় ডিন অফ স্টুডেন্টস অরুণ মাইতিকে। কর্তৃপক্ষ অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

Presidency University

যুগলদের মেলামেশার জায়গা হিসাবে বিখ্যাত ক্যাম্পাসের ‘লাভার্স লেন’। ছবি: সংগৃহীত।

নীতিপুলিশি হয়েছে কি হয়নি, তা নিয়ে শেষ কথা বলতে চান না প্রাক্তনীরা। সে কথার দু’পিঠ থাকবেই। কিন্তু শেষে কিনা সহপাঠীদের সঙ্গে খোলামেলা মেলামেশার অধিকার নিয়ে মুখ খুলতে হচ্ছে প্রেসিডেন্সির পড়ুয়াদের, তা শুনে বিস্মিত প্রাক্তনীরা! ছাত্রছাত্রীদের আচরণবিধি শিখিয়ে ‘বাঁধা’র চেষ্টা প্রেসিডেন্সির ইতিহাসের সঙ্গে মেলে না বলেই মত অধিকাংশের। ১৯৭৩ সালে দর্শন বিভাগের স্নাতক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা সায়নী ভৌমিক এখনও নিজের কানকেই ‘বিশ্বাস’ করতে পারছেন না। তাঁর বক্তব্য, ‘‘আমরা যে সময়ে পড়তাম, তখন তো ছেলেমেয়েদের মধ্যে মেলামেশা নিয়ে সমাজ তত সহজ ছিল না। কিন্তু আমাদের কলেজে এ সব কোনও নিষেধাজ্ঞা ছিল না।’’ বরং মুক্ত চিন্তার প্রসারের জন্য খ্যাত ছিল প্রেসিডেন্সি কলেজ। প্রাক্তনীরা সে দিকেই জোর দিচ্ছেন।

প্রবীণ নাট্যকার অশোক মুখোপাধ্যায়ের যেমন মনে পড়ছে, সাধারণ ভাবে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া ‘নীতি’কে প্রশ্ন করতেই শিখেছেন তাঁরা প্রেসিডেন্সির শিক্ষকদের কাছে। ১৯৫৮ সালে ইংরেজি বিভাগে পঠনপাঠন শুরু তাঁর। পরের তিন বছর কেটেছে সেখানেই। বললেন, ‘‘তখন সময়টা আলাদা ছিল। মহিলা সহপাঠীদের ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করতাম আমরা। কিন্তু বন্ধুত্ব হত। প্রেমও হত। অনেকে পরবর্তী কালে কলেজের সহপাঠীকে বিয়ে করেছেন। তাঁরা সুখে সংসারও করেছেন।’’ সে সব নিয়ে আলাদা করে কর্তৃপক্ষ কিছু বলতেন না বলেই মনে পড়ে তাঁর। প্রেসিডেন্সির আবহ খোলামেলা বলেই পরিচিত তাঁর কাছে। বরাবরই আধুনিক ভাবনার অঙ্গন বলে জায়গাটি প্রাক্তনীদের মনে ধরা আছে।

Presidency University

প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়। ছবি: সংগৃহীত।

প্রেসিডেন্সির নিজস্ব সংস্কৃতি আছে। অনেক বছর জায়গাটিকে দেখেও সে ভাবে বদলাতে দেখেননি সমাজতত্ত্ববিদ প্রশান্ত রায়। ১৯৬০ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ছাত্র হয়ে প্রথম প্রবেশ প্রেসিডেন্সিতে। পরে বহু বছর পড়িয়েছেন সেখানেই। নীতিপুলিশির অভিযোগের কথা শুনে প্রশান্তবাবুর মনে পড়ছে নিজের ছাত্রজীবনের কথা। বললেন, ‘‘তখন আমাদের বহু শিক্ষকই বিলেতফেরত। আধুনিক ভাবনার মানুষ। আমাদেরও খোলামেলা চিন্তাভাবনার কথা শেখাতেন। তখনও ছেলেমেয়েদের কাছাকাছি বসে গল্প করতে দেখা যেত। শিক্ষকেরা সে সব নিয়ে কখনও কোনও মন্তব্য করেননি।’’ তবে সেই ষাটের দশকের থেকে বিশেষ বদলায়নি প্রেসিডেন্সির সংস্কৃতি। এমনই মত প্রশান্তবাবুর। এত বছর যে তিনি পড়িয়েছেন সেখানে, তাতে ছাত্রছাত্রীদের মেলামেশার সার্বিক ভঙ্গি, মতাদর্শে বিশেষ বদল চোখে পড়েনি। তিনি বললেন, ‘‘প্রেসিডেন্সির ছেলেমেয়েরা তো নানা ধরনের জায়গা থেকে আসে। কিন্তু মিলে যায় একে অপরের সঙ্গে। কী করা উচিত, কোনটা নয়, সে সব বিষয়ে কিন্তু একটা ধারণা অধিকাংশেরই আছে বলেই দেখেছি।’’

এত কিছু নিয়ে আবার মাথা ঘামানো কেন! এমনই প্রশ্ন তুলনায় আধুনিক সময়ের প্রাক্তনীদের। দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের অধ্যাপক বোধিসত্ত্ব করও প্রেসিডেন্সিতে পড়াশোনা করেছেন। তিনি এমন সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত নন। বলছেন, ‘‘২০১৯-এর পর ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়নি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে, সেখানে ছাত্রছাত্রীদের প্রতিনিধিত্ব ছাড়া তৈরি আচরণবিধি উপর থেকে চাপাতে চাইলে এই অগণতান্ত্রিক নজরদারির বজ্র আঁটুনিতে ফস্কা গেরো থাকবেই। সাবালক, ভোটাধিকারপ্রাপ্ত ছাত্রছাত্রীদের জন্য দেশের সাধারণ আইনের বাইরে ব্যতিক্রমী, বিশেষ আচরণবিধির দরকার কী, তা-ও আমার জানা নেই।’’

চারপাশটা বদলে গেলে প্রেসিডেন্সি আর কী করবে? এমন প্রশ্নও করছেন কয়েক জন সদ্য প্রাক্তনী। মুম্বইয়ের আইআইটি-তে গবেষণা করেন তিনি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রেসিডেন্সির সেই প্রাক্তন ছাত্রী ২০১৯ সাল পর্যন্ত কাটিয়েছেন ক্যাম্পাসে। হাসতে হাসতে বললেন, ‘‘যুগের সঙ্গে তাল মেলাচ্ছে প্রেসিডেন্সিও। খবরে থাকতে হবে তো!’’ তাঁর বান্ধবী রিয়া সান্যাল একমত। তাঁদের কাছে খোলামেলা চিন্তার জায়গা যেমন প্রেসিডেন্সি, তেমন সব সময়ে সকলের নজরে থাকার চেষ্টাও আছে। এমনই অভিযোগ রিয়ার। বললেন, ‘‘না হলে হঠাৎ এত বিষয় থাকতে প্রেম করা নিয়ে কথা সকলে কথা বলবে কেন বলুন তো!’’ প্রেসিডেন্সি কর্তৃপক্ষ থেকে পড়ুয়া, সকলের উপরেই বিরক্তি প্রকাশ করছেন রিয়ারা। তাঁদের আর এক বান্ধবী বলছেন, ‘‘অভিভাবকদের ডেকে পাঠানোর মানে নেই। প্রেম করলে করবে! কিন্তু এত হইচই আবার প্রেসিডেন্সির ছাত্ররাই করে! সব নিয়ে উত্তেজিতও হয়ে পড়ে ওরা।’’

তবে প্রেসিডেন্সির প্রেমের ইতিহাস আলাদা। মনে করাচ্ছে বিরুদ্ধ স্বর। যুগলদের মেলামেশার জায়গা হিসাবে বিখ্যাত ক্যাম্পাসের ‘লাভার্স লেন’, ‘ম্যাথ্‌সের ছাদ’। সে সব জায়গার চেহারা তো একেবারে বদলেই যাবে তবে! এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বহু প্রাক্তনী অথবা একদা সে ক্যাম্পাসে প্রেমিক-প্রেমিকার সঙ্গে সময় কাটাতে যাওয়া ‘বহিরাগতরা’। আর এ সব দেখে বেজায় বিস্মিত পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়। প্রেসিডেন্সির প্রাক্তনী তিনিও। ১৯৯৬ থেকে ’৯৯ সাল পর্যন্ত কেটেছে সেখানে। এমন সব নীতি তাঁর সময়েও ছিল না। সৃজিতের প্রশ্ন, ‘‘কলেজে প্রেম করবে না তো কি ধাপার মাঠে প্রেম করবে?’’

প্রেসিডেন্সি কর্তৃপক্ষ অবশ্য আগেই দাবি করেছেন, প্রেমে আপত্তি নেই। প্রেমের ধরন নিয়েই যত কথা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Presidency University Moral Policing Campus
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE