Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Crime

হাত টেনে ধরে বলল, ‘গাড়িতে তুলে নে’, এখনও আতঙ্কে ট্যাংরার সেই বধূ

ঘটনাস্থলের ফুটেজ থেকে অ্যাম্বুল্যান্সের রেজিস্ট্রেশন নম্বর পাওয়া যায়নি।

বাঁ দিকে গোবিন্দ খটিক রোডের এখানেই ঘটে ঘটনাটি। ডান দিকে ঘটনাস্থলের কাছে সিসি ক্যামেরা। নিজস্ব চিত্র

বাঁ দিকে গোবিন্দ খটিক রোডের এখানেই ঘটে ঘটনাটি। ডান দিকে ঘটনাস্থলের কাছে সিসি ক্যামেরা। নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ১৭:৪৪
Share: Save:

বাড়ি থেকে কয়েকশো মিটার দূরে, পাড়ার মধ্যে যে এ রকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে, তা স্বপ্নেও ভাবেননি পিয়ালি (নাম পরিবর্তিত)। বুধবার দুপুরেও ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বার বার তাঁর চোখে-মুখে ফুটে উঠছিল আতঙ্ক।

ঠিক কী হয়েছিল মঙ্গলবার রাতে? পিয়ালি বলেন, ‘‘আমার মাসি শাশুড়ির মেয়ের বিয়ে। পাড়ারই পূর্বাঞ্চল প্রভাতী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছিল বিয়ের অনুষ্ঠান। ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হওয়ায় আমরা একটু বেশি রাত পর্যন্তই ছিলাম।” রাত সাড়ে ১১ টা নাগাদ পাঁচ বছরের মেয়েকে নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছিলেন তিনি। পিয়ালির কথায়, ‘‘মেয়ের পরীক্ষা। তাই তাড়াতাড়ি ফেরার জন্য একটু আগেই রওনা হই।” তাঁকে এগোতে দেখে বাড়ির পথ ধরেন তাঁর শ্বশুর উজ্জ্বল প্রামাণিক (নাম পরিবর্তিত) এবং তাঁর মামাশ্বশুর-সহ অন্য আত্মীয়েরা।

ঘটনাস্থল খতিয়ে দেখছেন ডিসি অজয় প্রসাদ এবং পুলিশ আধিকারিকরা। নিজস্ব চিত্র

ট্যাংরা থানা থেকে মেরেকেটে ৬০০ মিটার দূরে এই স্কুলটি। গোবিন্দ খটিক রোড ধরেই হাঁটছিলেন পিয়ালি। তাঁর কথায়, ‘‘মেয়ের হাত ধরে আমি রাস্তার ডান দিক ধরে হাঁটছিলাম। স্কুল থেকে খানিকটা পথ এগোতেই ইএম বাইপাসের দিক থেকে একটি গাড়ি আচমকা সামনে এসে দাঁড়ায়।” পিয়ালির দাবি, বাকি আত্মীয়েরা খুব বেশি হলে তখন ২৫ মিটার পিছনে।

আরও পড়ুন: হিন্দু হোস্টেল নিয়ে স্থায়ী সমাধান চায় প্রেসিডেন্সির পড়ুয়ারা, এখনও ঘেরাও উপাচার্য

অভিযোগ, গাড়িটা কাছে এসে দাঁড়ানোর পর পিয়ালি দেখেন নীল আলো জ্বলছে মাথায়। হেড লাইটের জোরালো আলোয় তিনি তখনও বুঝতে পারেননি কী গাড়ি। তবে গাড়ির সামনে বসা দু’জন। চালক এবং তাঁর পাশে এক জন। অভিযোগ, তিনি গাড়িটা পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে চালকের পাশে বসা যুবক আচমকাই তাঁর হাত ধরে টানেন। দু’জনের এক জন অন্য জনকে বলে, ‘‘গাড়িতে তুলে নে।’’ ইতিমধ্যে তিনি হাত ছাড়িয়ে চেঁচাতে শুরু করেন। পিয়ালির অভিযোগ, ‘‘আমার চিৎকার শুনে পিছনে থাকা শ্বশুরমশাই এবং বাকি আত্মীয়েরা ছুটে আসেন।” তাঁরা ওই গাড়িটির পথ আটকে ধরেন।

তখনই পিয়ালি বুঝতে পারেন গাড়িটি একটা অ্যাম্বুল্যান্স। প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ, সবাই গাড়িটা ঘিরে ধরতেই সেটা স্টার্ট দিয়ে এগোনোর চেষ্টা করে। তখন উজ্জ্বলবাবু চালকের পাশের দিকের দরজা খুলে এক ব্যক্তিতে পাকড়াও করার চেষ্টা করছেন। সেই অবস্থাতেই অ্যাম্বুল্যান্সের চালক গাড়ির গতি প্রচণ্ড বাড়িয়ে ছিটকে এগিয়ে যায়। আর গাড়ির গতির অভিঘাতে পড়ে যান উজ্জ্বল। তাঁর জামা আটকে যায় গাড়ির চাকায়। তাঁকে শুদ্ধ হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে অ্যাম্বুল্যান্সটি এগিয়ে যায় বৈশালী মোড়ের দিকে।

আরও পড়ুন: স্কুল-কলেজের পড়ুয়াদের হাতে মাদক, পার্ক সার্কাসে গ্রেফতার পাচারকারী

প্রায় ৫০-৬০ মিটার দূর পর্যন্ত ছেঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার পর চাকায় আটকে যাওয়া উজ্জ্বলের জামা খুলে যায়। রাস্তায় ছিটকে পড়েন তিনি। গাড়ি নিয়ে চম্পট দেয় দুই দুষ্কৃতী। তত ক্ষণে চিৎকার শুনে আরও লোকজন বেরিয়ে এসেছেন রাস্তায়। উজ্জ্বলের শ্যালক রমেন (নাম পরিবর্তিত) এ দিন বলেন, ‘‘রক্তাক্ত অবস্থায় একটা অটোতে তুলে আমরা জামাইবাবুকে নিয়ে যাই এনআরএস মেডিক্যাল কলেজে। সেখানে তিনটে নাগাদ তাঁর মৃত্যু হয়।”

চিকিৎসকদের কাছ থেকে পুলিশ পরে জানতে পেরেছে, উজ্জ্বলের পায়ে এবং পাঁজরের একাধিক হাড় ভেঙেছে। পুলিশ সূত্রে খবর, দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ট্যাংরা থানার আধিকারিকরা রাতেই হাসপাতালে যান। সেখানে উজ্জ্বলের মৃত্যুকালীন জবানবন্দিও নথিভুক্ত করেন তাঁরা। সেই জবানবন্দিতে তিনি গাড়ির ধাক্কা মারা এবং ছেঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ। তাঁদের দাবি, রাতে উজ্জ্বলের পরিবারের লোকজন গাড়ির ধাক্কা মারার আগের কোনও ঘটনা পুলিশকে জানায়নি। ফলে, পুলিশ বেপরোয়া গাড়ির ধাক্কায় মৃত্যুর ঘটনা ধরেই তদন্ত শুরু করে। পুলিশের দাবি, বুধবার সকালে পিয়ালির অভিযোগ তাঁরা জানতে পারেন। যদিও উজ্জ্বলের পরিবারের দাবি, রাতেই পুলিশকে সব ঘটনা জানানো হয়েছিল, কিন্তু পুলিশ বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি।

মঙ্গলবার রাতে এই স্কুলেই হয় বিয়ের অনুষ্ঠান। নিজস্ব চিত্র

আরও পড়ুন: ট্যাংরায় তরুণীকে অপহরণের চেষ্টা, বাধা দিতে গিয়ে নিহত শ্বশুর

এ দিন সকালে গোটা ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পরই ঘটনাস্থলে পৌঁছন ডিসি (পূর্ব শহরতলি) অজয় প্রসাদ, কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের আধিকারিকরা। প্রাথমিক তদন্তের পর তাঁরা ঘটনাস্থলের আশে পাশে তিনটি সিসি ক্যামেরার হদিশ পান। তার একটি থেকে ফুটেজও পাওয়া গিয়েছে। দেখা গিয়েছে অ্যাম্বুল্যান্সটিকে। তবে ক্যামেরা গুলি অ্যাম্বুলেন্সের ডানদিকে থাকায়, প্রচন্ড গতিতে এগিয়ে যাওয়া গাড়ির বাঁদিকে আটকে থাকা উজ্জ্বলকে দেখা যায়নি ওই ফুটেজে। ডিসি অজয় কুমার বলেন,‘‘ আমরা উজ্জ্বল প্রামাণিকের মৃত্যুকালীন জবানবন্দির ভিত্তিতে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০৪ ধারায় অনিচ্ছাকৃত খুনের মামলা দায়ের করেছি।” তিনি ইঙ্গিত দেন, পিয়ালির অভিযোগের উপর ভিত্তি করে পরবর্তীতে অপহরণের চেষ্টার মতো আরও ধারা যুক্ত হতে পারে।

তদন্তকারীরা বৈশালী মোড়ে ট্রাফিক পুলিশের সিসি ক্যামেরা দেখে নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করেন কোন দিকে গিয়েছে ওই অ্যাম্বুলেন্স। কারণ, ঘটনাস্থলের ফুটেজ থেকে অ্যাম্বুল্যান্সের রেজিস্ট্রেশন নম্বর পাওয়া যায়নি। এ দিন বিকেলে মহেশতলার কাছে একটি অ্যাম্বুল্যান্সকে আটক করা হয়। তার সঙ্গে সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা অ্যাম্বুল্যান্সের মিল রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। এক ব্যক্তিকেও আটক করা হয়েছে।

আরও পড়ুন: নির্ভয়া: দণ্ডিতরা আরও এক সপ্তাহ সময় পেল দিল্লি হাইকোর্টে

পুলিশের একটি অংশের দাবি, পিয়ালির বক্তব্যে কিছু অসঙ্গতি রয়েছে। কারণ গাড়িচালকের পাশের আসনে বসে পিয়ালির মতো ভারী চেহারার মহিলাকে গাড়ির পিছনে জোর করে তোলা সম্ভব নয়। তবে তদন্তকারীদের অন্য অংশের মতে, উজ্জ্বল প্রামাণিককে গাড়িটি ধাক্কা মেরেছে এবং প্রাথমিক ভাবে এটাও নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে যে তাঁকে ছেঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখান থেকে এটা স্পষ্ট ঘটনা পুরো মিথ্যেও নয়। তাই মহিলার অভিযোগকে সামনে রেখেই তদন্ত করা হচ্ছে। কলকাতা পুলিশের এক কর্তা স্বীকার করেন, ‘‘ঘটনাটি ভয়ানক এবং গোটা ঘটনা বুধবার সকালের আগে পুলিশ কেন জানতে পারল না তা-ও খতিয়ে দেখা দরকার।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Crime Abduction Tangra Christopher Road
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE