‘‘আমাদের স্কুলে ভর্তি কেন...আপনার ভাগ্নিকে কি কোনও ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা আইএএস অফিসারের গলার লকেট বানাতে চান?’’নিজের গলার ‘ক্রসে’ হাত রেখে প্রশ্নটা করলেন সিস্টার সিরিল। শুনে হতভম্ব অভিজিৎ বর্ধন। ভর্তি হতে আসা ছাত্রীদের পরিবারের সঙ্গে এ ভাবেই কথা বলতেন শিয়ালদহ লোরেটো ডে স্কুলের ডাকসাইটে প্রধান শিক্ষিকা। শুধু নিজের কর্মজীবন বা ভাল বর জোটানোর পা-দানির খোঁজে মেয়েকে এ স্কুলে ঠেলে দিলে কপালে দুঃখ আছে তাঁদের! কারণ, শুধু নিজের ভবিষ্যৎ গড়া নয়, এখানে সুবিধাবঞ্চিত অন্য শিশুদেরও পড়াশোনা শেখাতে হয়, বৃহত্তর সমাজের সঙ্গেও মিশতে হয়। তা ছাড়া, এ স্কুলের শিক্ষা বৃথা।
লোরেটো স্কুলের ছক-ভাঙা ক্যাথলিক সন্ন্যাসিনীর সঙ্গে ১৯৯০-এর দশকে প্রথম মোলাকাত এমনই কর্কশ ছিল সোনারপুরের প্রসাদপুর বিদ্যানিকেতনের বিজ্ঞানের শিক্ষক অভিজিতের জন্য। ক্রমশ তিনি টের পান, আইরিশ রক্তের সন্ন্যাসিনী শহরের কুলীন ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ঘেরাটোপে বন্দি থাকার পাত্রী নন। স্কুল স্তরে বিজ্ঞান চর্চার মঞ্চ, অভিজিতের ‘সায়েন্স কমিউনিকেটর্স ফোরাম’-এর অন্যতম প্রধান প্রেরণা সিরিল তাঁর ছাত্রী, সহকর্মী থেকে চারপাশের সবার মধ্যেই সবার রঙে রং মেশানোর মন্ত্র বুনে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। লোরেটোর সন্ন্যাসিনী মণ্ডলের মুখপাত্র সিস্টার মণিকার কথায়, ‘‘সিস্টার সিরিল মুনি যেন এক বিপ্লবী সন্ন্যাসিনী, স্কুলশিক্ষার চেনা ধাঁচটাকে আমূল পাল্টে যিনি এক সৃজনশীল রূপ দিয়েছিলেন। হাজারো শিশুর ক্ষমতায়নে শিক্ষাকে হাতিয়ার করে তোলেন তিনি।’’
৮৬ বছর আগে আয়ারল্যান্ডের উইকলো শহরে জন্ম সদ্যপ্রয়াত সিরিলের। ১৯৫৬ সালে কলকাতায় আসেন তিনি। লখনউ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণিবিদ্যায় পিএইচ ডি-র পরে লখনউ, কলকাতায় বিভিন্ন লোরেটো স্কুলের প্রাণশক্তি হয়ে ওঠেন। সিরিলের কন্যাপ্রতিম বিশাখা সেনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক অর্ধ শতকের। তখন লোরোটো হাউসে অষ্টম শ্রেণিতে পড়তেন বিশাখা। পরে লোরেটো শিয়ালদহের ইংরেজি শিক্ষিকা থেকে সিরিলের স্বপ্নের লোরেটো রেনবো স্কুলের সহ-অধিকর্তা হয়ে উঠেছেন তিনি। এই রেনবো স্কুলের মাধ্যমেই যেন তাঁর স্কুলের ছাত্রীদের সঙ্গে সমাজের সেতু বাঁধেন সিরিল। ক্যাথলিক সন্ন্যাসিনীর সেবাভাবই হয়ে ওঠে ছক-ভাঙা নারী সত্তাকে আবিষ্কারের মন্ত্রও। ম্যাগসেসে পুরস্কার, পদ্মশ্রী-র শিরোপা অকারণে পাননি সিরিল।
১৯৮০-র দশকে শিয়ালদহের লোরেটোর মেয়েদের পৈলানে গরিব শিশুদের পড়াতে হত। এই কর্মকাণ্ডই ‘রেনবো স্কুলে’র চেহারা নেয়। ১৯৯৪-এ শিয়ালদহ স্টেশনে এক বার একটি মেয়ের হেনস্থা হওয়ার পরে রেনবো স্কুলের হোমেরও পত্তন ঘটে। লোরেটোর বিভিন্ন স্কুলে এখন পাঁচটি রেনবো হোম। তাদের সাতরঙা স্বপ্ন সারা দেশেরই প্রেরণা। পশ্চিমবঙ্গ সর্বশিক্ষা মিশনও সিরিলের সহায়তায় বিপন্ন শৈশবের ছোটদের জন্য ২৫টা হস্টেলের পত্তন করেছে।
লোরেটো শিয়ালদহের রেনবো হোমে রোজ রাতে ১৫০টি শিশুকেই আদর করে ঘুমোতে পাঠাতেন সিরিল। রোজ রাত দেড়টায় কাজ শেষ হলে বুড়ি বয়সেও মোটরবাইক চালিয়ে শিয়ালদহ থেকে এন্টালিতে তাঁর আবাসে ফিরতেন।রেনবো স্কুলের ছাত্রী, পুণের কলেজ থেকে সাংবাদিকতায় স্নাতক রিঙ্কি সরকার বলেন, ‘‘সিস্টার অঙ্ক না-শেখালে মাধ্যমিকই পাশ করতাম না আমি!’’
বিশাখার মনে আছে, গুজরাতের সাম্প্রদায়িক হিংসার পরে সিস্টার সিরিলের আক্ষেপ, কেন সেখানে হোম নেই তাঁদের। বেড়াল-অন্ত-প্রাণসন্ন্যাসিনী মেতে থাকতেন তাঁর পোষ্য সন্তানদের নিয়েও। আবার এক বার একটি বেড়ালের মৃত্যুর পরে স্কুলের ছাত্রীদের সামনে তার অঙ্গ ব্যবচ্ছেদকরে ক্লাস নেন। কয়েক বছর আগে আয়ারল্যান্ড থেকে সিস্টারের একমাত্র ভাইয়ের মৃত্যুসংবাদ আসার পরেও সবাই দেখেন, কাজে ডুবে তিনি। ভিতরের যন্ত্রণা বুঝতেই দেননি কাউকে। কাজের মাধ্যমেই অক্লান্ত কর্মযোগী সন্ন্যাসিনীকে শ্রদ্ধা জানাতে চান সহযোগীরা।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)