Advertisement
E-Paper

বেপরোয়া অটোয় উঠে বেঘোরে মৃত্যু অষ্টাদশীর

মিউজিক সিস্টেমের মাত্রাছাড়া আওয়াজে ভিতরে বসে থাকা দায়। কিন্তু চালকের হেলদোল নেই। যে কোনও গাড়ির ভিড়ে মাথা গুঁজে দিয়ে, একে ওকে ওভারটেক করে দিব্যি চলছেন তিনি। ট্রাফিক নিয়ম মানার বালাই নেই, লাল সিগন্যালকে বুড়ো আঙুল দেখানোটাই দস্তুর।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৩:৩৮
পূজা পাল

পূজা পাল

মিউজিক সিস্টেমের মাত্রাছাড়া আওয়াজে ভিতরে বসে থাকা দায়। কিন্তু চালকের হেলদোল নেই। যে কোনও গাড়ির ভিড়ে মাথা গুঁজে দিয়ে, একে ওকে ওভারটেক করে দিব্যি চলছেন তিনি। ট্রাফিক নিয়ম মানার বালাই নেই, লাল সিগন্যালকে বুড়ো আঙুল দেখানোটাই দস্তুর। চার জন বসানোর নিয়মও বহু ক্ষেত্রে থোড়াই কেয়ার। এ ভাবেই শহরজুড়ে চলছে অটো-রাজ। প্রাণ হাতে বসে থাকলেও যাত্রীরা মুখ খোলেন না। নিত্য অভিজ্ঞতায় তাঁরা জানেন, বলে লাভ নেই। বললে মুখঝামটা তো বটেই, অনেক ক্ষেত্রে মারধর খাওয়ার সম্ভাবনাও থাকে!

যার নিট ফল, ঘনঘন দুর্ঘটনা। যেমন শুক্রবার। এ দিন সাত সকালেই গৌরীবাড়ি মোড়ে ট্রাফিক সিগন্যালের তোয়াক্কা না করে দুর্ঘটনার কবলে পড়ল একটি অটো। সিগন্যালের লাল আলো উপেক্ষা করে তীব্র গতিতে যেতে গিয়ে সরাসরি বাসের পেটে ধাক্কা মারল সেটি। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হল অটোচালকের পাশে বসা কলেজ ছাত্রী পূজা পালের। পুলিশ সূত্রের খবর, সকাল সওয়া ছ’টা নাগাদ রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রিটের উপরে সিগন্যাল সবুজ হয়েছে দেখে হাওড়া-বারাসাত রুটের একটি বাস এগোচ্ছিল। সে সময় সিগন্যাল ভেঙে এগিয়ে যাওয়া বেলেঘাটা আইডি-আরজি কর রুটের অটোটি গিয়ে ধাক্কা মারে বাসটির পিছনের দরজায়। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় ১৮ বছর বয়সি পূজার। আশঙ্কাজনক অবস্থায় আরজি কর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় অটোচালক জয়দীপ নস্কর এবং পিছনের সিটে বসা তিন যাত্রী অজয় সরকার, ইতি সরকার এবং শিব সোঁয়াইকে।

সকালের দুর্ঘটনার রেশ না কাটতেই বিকেলে অটোর আরেকটি দৌরাত্ম্য দেখল মহানগর। দেখা গেল, অটোচালকরা মন্ত্রীদেরও পরোয়া করেন না! এ দিন বিকেলে মধ্য কলকাতার মির্জা গালিব স্ট্রিটে খাদ্য ভবনে ঢোকার মুখে খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক দেখেন গেট জুড়ে দাঁড়িয়ে চারটি অটো। লালবাতি লাগানো মন্ত্রীর গাড়ি দেখেও সরেনি তারা! গাড়ি থেকে নামেন মন্ত্রী। তাঁর সঙ্গে তর্ক জুড়ে দেন অটোচালকরা। এক নিরাপত্তারক্ষীকে ধাক্কা মেরে একটি অটো পালায়। মন্ত্রীর নিরাপত্তারক্ষীরা যতক্ষণে থানায় ফোন করেছেন, ততক্ষণে বাকি অটোচালকেরা অটো নিয়ে উধাও।

দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় এসে নজরুল মঞ্চে সভা ডেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সতর্ক করেন শহরের ‘বেয়াদব’ চালকদের। ছবি দিয়ে মোড়ে মোড়ে চলছে ‘সেফ ড্রাইভ, সেভ লাইফ’-এর প্রচার। কিন্তু এ দিনের দু’টি ঘটনাই প্রমাণ করল, ওই সব পোস্টার অটোচালকদের জন্য নয়!

শাসক দল ও পরিবহণ দফতরের একাংশের নেতাদের দাবি, ‘‘ভোটে পেশীশক্তি থেকে সভা-জমায়েত— সবেতেই বড় ভরসা অটো ইউনিয়ন। তাই বাম আমলেও এদের চটাননি নেতারা। তৃণমূলও তা-ই করছে।’’

আরও কারণ আছে। প্রতি অটো ইউনিয়নই প্রতি দিন চালকদের থেকে চাঁদা তোলে। অঙ্কটা দু’ থেকে পাঁচ টাকা। এ ভাবে মাসে কয়েক লক্ষ টাকা আদায় হয়। শাসক দলের এক শীর্ষ নেতার কথায়, ‘‘শুধু শহর ও শহরতলির অটো ইউনিয়নগুলি থেকেই দলের আয় কয়েক কোটি টাকা।’’ অটো ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত নেতাদের একাংশ বলছেন, অটোকে নিয়ন্ত্রণ করার ঝুঁকি নেয় না পুলিশও। যে কোনও ঘটনায় তারা যোগাযোগ করে ইউনিয়ন নেতাদের সঙ্গেই।

কলকাতা পুলিশ অবশ্য এই সব অভিযোগ মানেনি। ডিসি ট্রাফিক ভি সলোমন নেসাকুমারের দাবি, গত ছ’মাসে ১ লক্ষ ৯ হাজার অটোকে জরিমানা করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও এমন দুর্ঘটনা কেন? নেসাকুমারের বক্তব্য, ‘আরও বেশি করে অটোচালকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। ট্রাফিক আইন সম্পর্কে ঠিকমতো ধারণা দিতে হবে।’’

তবে এমন চেষ্টা নতুন নয়। পরিবহণমন্ত্রী হওয়ার পরে মদন মিত্র প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, বেপরোয়া অটোর বিরুদ্ধে অভিযান চলবে। অটোকে নিয়ন্ত্রণে তদানীন্তন যুগ্মসচিব আশিস ঠাকুরের নেতৃত্বে কমিটিও তৈরি হয়। তিন মাসের মধ্যে ওই কমিটি রিপোর্ট জমা দিলেও এখনও পর্যন্ত তা দিনের আলো দেখেনি!

কমিটি তাদের রিপোর্টে বলেছিল, কলকাতার অটোকে কয়েকটি অঞ্চলে ভাগ করা হোক। তার বাইরে কোনও অটোই যেতে পারবে না। নির্দিষ্ট রঙের মাধ্যমে এলাকাভিত্তিক অটোকে চেনা যাবে। দাদাগিরি কমাতে ধীরে ধীরে অটোকে দেশের অন্য শহরের মতো মিটারের আওতায় আনার কথাও বলা হয়েছিল। এমনকী, অটো ভাড়া নিয়ন্ত্রণেও নির্দিষ্ট সুপারিশ করেছিল কমিটি। বেআইনি অটোর দৌরাত্ম্য রুখতে কলকাতার প্রতিটি বৈধ অটোতে ‘হাই সিকিওরিটি নম্বর প্লেট’ লাগানোর কথা ঘোষণা করেছে সরকার। তা হলে সহজেই বেআইনি অটো চিহ্নিত করা যাবে। আজ পর্যন্ত এই নির্দেশ বাস্তবায়িত হয়নি।

নয়া পরিবহণমন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী সম্প্রতি ঘোষণা করেছেন পৃথক অটোনীতি তৈরি করা হবে। কিন্তু অটোকে যে এখনই ঘাঁটানো হবে না, তা রাজ্য প্রশাসনের এক শীর্ষ কর্তার কথায় স্পষ্ট। তিনি বলেন, ‘‘মন্ত্রী অটোনীতি তৈরির কথা বলেছেন বটে। কিন্তু তার মানে এখনই সরকার হইহই করে অটো শাসনে নেমে পড়বে, এমনটাও নয়। ভাবনাচিন্তা করেই এগোতে চায় সরকার।’’

অতএব, অটোর স্বৈরাচার চলছে, চলবে। আর প্রাণ যাবে পূজাদের।

college student Bus Auto
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy