Advertisement
E-Paper

এ বার প্রান্তিক স্টেশন শহিদ ক্ষুদিরাম, সব সুবিধা আছে? বাকি স্টেশনেরও কি স্বাস্থ্য পরীক্ষা হবে? বহু প্রশ্নে বিদ্ধ মেট্রো

প্ল্যাটফর্মের পিলারে ফাটল ধরা পড়ার কারণে নিউ গড়িয়া সংলগ্ন কবি সুভাষ স্টেশন পর্যন্ত মেট্রো চলাচল আপাতত বন্ধ। অনুমান, বছরখানেক লেগে যেতে পারে প্ল্যাটফর্ম সম্পূর্ণ মেরামত হতে।

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ৩০ জুলাই ২০২৫ ১৮:৪৯

রক্ষকই উদাসীন! মেট্রো কর্তৃপক্ষের সেই উদাসীনতার মাশুলই এখন গুণতে হচ্ছে যাত্রীদের। কবি সুভাষ মেট্রো স্টেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হওয়ায় তাঁদের নাকানিচোবানি খেতে হচ্ছে।

প্ল্যাটফর্মের পিলারে ফাটল ধরা পড়ায় নিউ গড়িয়া সংলগ্ন কবি সুভাষ স্টেশন পর্যন্ত মেট্রো চলাচল আপাতত বন্ধ। অনুমান, বছরখানেক লেগে যেতে পারে প্ল্যাটফর্ম সম্পূর্ণ মেরামত হতে। তত দিন পর্যন্ত উত্তর-দক্ষিণ মেট্রো শাখার দক্ষিণের প্রান্তিক স্টেশন শহিদ ক্ষুদিরাম। এই পরিস্থিতিতে যাত্রী পরিষেবা বিঘ্নিতও হতে পারে বলে আশঙ্কা। অনেক নিত্যযাত্রীর আশঙ্কা, মেট্রোর সময়সূচি বদলে যাবে না তো!

যদিও মেট্রো কর্তৃপক্ষের দাবি, এত দিন যে ভাবে মেট্রো চলাচল করেছে, তেমনই চলবে। মেট্রোর সময়সূচি বদলের কোনও সম্ভাবনা আপাতত নেই। ফলে যাত্রী পরিষেবা বিঘ্নিত হওয়ার প্রশ্ন উঠছে না। গোটা ব্যবস্থায় শুধু একটাই বদল হচ্ছে— এ বার মেট্রো আর কবি সুভাষ পর্যন্ত যাবে না। দক্ষিণেশ্বর থেকে আগত মেট্রোর শেষ এবং প্রান্তিক স্টেশন হবে শহিদ ক্ষুদিরাম।

কবি সুভাষ মেট্রো স্টেশন তৈরি হয়েছিল ২০১০ সালে। মাত্র ১৫ বছরেই সেই স্টেশনের এই হাল হলে ৪০ বছর ধরে পরিষেবা দেওয়া অন্যান্য স্টেশনের কী অবস্থা? সেখানে কি এ বার পিলার এবং অন্যান্য নির্মাণের স্বাস্থ্যপরীক্ষা হবে? কর্তৃপক্ষের দাবি, ‘‘এখনও অন্যত্র তেমন কোনও সমস্যা দেখা যায়নি। পরিস্থিতি অনুযায়ী নিশ্চয়ই সব করা হবে।’’ যদিও গত বছরের মতো এ বছরও পার্ক স্ট্রিট স্টেশনে ফাটল দিয়ে জল ঢুকে পড়া এবং মেট্রো বন্ধ করে দেওয়ার মতো ঘটনার উল্লেখ করছেন অনেকে। মেট্রোর এই দাবি তাঁরা উড়িয়ে দিচ্ছেন।

প্রসঙ্গত, শহিদ ক্ষুদিরাম স্টেশনে কবি সুভাষের মতো প্রান্তিক স্টেশনের উপযোগী অনেক ব্যবস্থা নেই। এত দিন কবি সুভাষ স্টেশনে যাত্রীদের ডাউন প্ল্যাটফর্মে নামিয়ে সেই মেট্রোই আবার একটু এগিয়ে লাইন পরিবর্তন করে আপ প্ল্যাটফর্মে এসে দমদম-দক্ষিণেশ্বেরের দিকে রওনা দিত। আপ এবং ডাউনে ট্রেনের লাইন পরিবর্তনের এই ব্যবস্থা শহিদ ক্ষুদিরামে নেই। যেমন দক্ষিণেশ্বরেও জায়গার অভাবে এই ব্যবস্থা করা যায়নি। সেখানে একটি লাইনেই আপ এবং ডাউন ট্রেন যাতায়াত করে। শহিদ ক্ষুদিরামে এই ব্যবস্থাও না-থাকায় প্রশ্ন উঠছে, মেট্রো চলবে কী পদ্ধতিতে? ডাউন প্ল্যাটফর্মে আসা মেট্রো আপ স্টেশনে আসবে কী ভাবে?

মেট্রো কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, এখনও পর্যন্ত যা ঠিক হয়েছে, দক্ষিণেশ্বর-দমদম থেকে আসা মেট্রো শহিদ ক্ষুদিরামে যাত্রীদের নামিয়ে কবি সুভাষের দিকেই যাবে। তার পর সেখান থেকেই মেট্রো আপ লাইনে উঠে শহিদ ক্ষুদিরামে ফিরে আসবে। ফলে ট্রেন পরিষেবা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা নেই।

মেট্রোর ব্যাখ্যা, কবি সুভাষে রেক চলাচলে এখনও পর্যন্ত কোনও সমস্যা নেই। যত সমস্যা প্ল্যাটফর্মে। যে পিলারের উপর প্ল্যাটফর্মের শেড, তাতে ফাটল দেখা দিয়েছে। তবে পরবর্তী কালে প্ল্যাটফর্মের মেরামতির কাজ শুরু হলে লাইনে রেক যাতায়াতে কোনও সমস্যা হবে কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়।

মেট্রো কর্তৃপক্ষের এই ব্যাখ্যাতেও যাত্রীদের বড় অংশের সংশয় কাটছে না। কারণ, গত ১৫ বছর ধরে কবি সুভাষ প্রান্তিক স্টেশন হওয়ার সুবাদে সেখানে সেইমতো করে অন্যান্য পরিবহণ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। প্রথমত, কবি সুভাষে নামলেই পাওয়া যায় শিয়ালদহ দক্ষিণ শাখার লোকাল ট্রেন। মেট্রো লাগোয়া নিউ গড়িয়া স্টেশন রয়েছে। তা ছাড়া প্রচুর অটো ও রিকশার রুটও তৈরি হয়েছিল ওই মেট্রো স্টেশন ঘিরে। টোটো চলাচলও শুরু হয়েছিল। কিন্তু শহিদ ক্ষুদিরাম প্রান্তিক স্টেশন না-হওয়ায় এই ধরনের কোনও পরিবহণ ব্যবস্থাই গড়ে ওঠেনি। একই সঙ্গে কবি সুভাষের মতো শহিদ ক্ষুদিরামে লাগোয়া কোনও লোকাল ট্রেনের স্টেশনও নেই। এক কিলোমিটার দূরে গড়িয়া স্টেশন রয়েছে ঠিকই। তার জন্যেও ১০-২০ টাকা বেশি খরচ হবে।

ক্যানিংয়ের বাসিন্দা জয়ন্ত দাসের কথায়, ‘‘এত দিন কবি সুভাষে নেমে ট্রেন ধরেছি। এ বার বাড়ি ফিরব কী ভাবে জানি না।’’ চাঁদনি চকে জয়ন্তের ইলেক্ট্রনিক্সের দোকান। কবি সুভাষ থেকে চাঁদনি চক পর্যন্ত তাঁর নিত্য যাতায়াত। বছর পঁয়ত্রিশের যুবক বলেন, ‘‘শহিদ ক্ষুদিরামে নেমে তো কোনও ট্রেন পাব না। বাসও কোথা থেকে চলে জানি না। বেজায় সমস্যার মুখে পড়তে হবে!’’ একই কথা বলছেন নামখানার সুমন মণ্ডলও। তিনিও রোজ শিয়ালদহে কাজে যান। কবি সুভাষ দিয়েই তাঁর যাতায়াত। তাঁর কথায়, ‘‘মেট্রো কর্তৃপক্ষ তো স্টেশন বন্ধ করেই খালাস! এ বার যাত্রীদের কী হবে, তা একবারও ভেবে দেখেছেন?’’

যাত্রীদের একাংশের অভিযোগ, হঠাৎ করে শহিদ ক্ষুদিরাম ‘প্রান্তিক স্টেশন’ হয়ে ওঠায় সেখানকার অটো বা রিকশাওয়ালারা যত ইচ্ছে ভাড়া চাইতে শুরু করেছেন। পঞ্চসায়রের সম্পিতা চৌধুরীর কথায়, ‘‘অটোয় দু’কিলোমিটার রাস্তার জন্য ৩০-৪০ টাকা খসছে। এ ভাবে যাতায়াত সম্ভব নাকি!’’

এই সমস্যা কত দিন থাকবে, সে বিষয়ে মেট্রোর কর্তৃপক্ষ এখনও সরকারি ভাবে স্পষ্ট করে কিছু জানাননি। তবে কর্তৃপক্ষের একটি সূত্রের দাবি অনুযায়ী, যদি গোটা মেট্রো স্টেশনই ভেঙে আবার নতুন করে তৈরি করার প্রয়োজন পড়ে, সে ক্ষেত্রে একটা গোটা বছর লেগে যেতে পারে। মেট্রোর যাত্রীদের অভিযোগ, সময়ে সময়ে রক্ষণাবেক্ষণ হলে এই পরিস্থিতি তৈরি হত না। মেট্রো কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার জন্যই নানা সমস্যার মুখে পড়তে হচ্ছে তাঁদের।

নিয়মিত পরীক্ষা এবং রক্ষণাবেক্ষণ হলে প্ল্যাটফর্মে ফাটল আগেই চিহ্নিত হত বলে মত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং (নির্মাণবিদ্যা)-এর অধ্যাপক পার্থপ্রতিম বিশ্বাসের। তাঁর বক্তব্য, ‘‘এই ফাটল কিন্তু এক দিনে তৈরি হয়নি। একটা কংক্রিটের পিলারে নানা কারণে ফাটল তৈরি হতে পারে। অন্যতম কারণ হল ‘আনইভন সেটলমেন্ট’। অর্থাৎ, কোনও পিলার এক দিকে বেশি বসেছে। আর এক দিকে কম বসেছে। যে কারণে কলকাতা শহরে বিভিন্ন জায়গায় বাড়ি হেলে পড়ে। প্ল্যাটফর্মটিও হেলে পড়েছে কি না, সেটাও দেখা দরকার।’’ তাঁর ধারণা, নিয়মিত তদারকি বা রক্ষণাবেক্ষণ হয়নি। ফাটল আগেই তৈরি হয়েছে। সম্প্রতি তা সকলের নজরে এসেছে।

অনেকের আবার দাবি, জলাভূমি ভরাট করে নরম মাটিতে কবি সুভাষ মেট্রো স্টেশন তৈরি হয়েছিল। ফলে মাটি বসে গিয়ে এ ভাবে ফাটল দেখা দিয়েছে। আবার কারও কারও দাবি, নির্মাণগত দিক দিয়েও নানা ত্রুটি ছিল। কলকাতা পুরসভার মেয়র পারিষদ (নিকাশি) তারক সিংহ বলেন, ‘‘জলাভূমি ভরাট নিয়ে যেমন কথা হচ্ছে, তেমনই আমাদের মনেও কিছু কিছু প্রশ্ন রয়েছে। প্রথম প্রশ্নই হল, নির্মাণগত দিক দিয়ে কি কোনও ক্রটি ছিল? নির্মাণসামগ্রী কি সঠিক মানের দেওয়া হয়েছিল? যদি নির্মাণসামগ্রী ভাল মানেরই ব্যবহার করা হয়ে থাকে, তা হলে দেখতে হবে ব্লেন্ডিং ঠিকঠাক ছিল কিনা। অর্থাৎ বালি-পাথরের মাপে কোনও ত্রুটি ছিল কিনা। যে মাটির উপর পিলার তৈরি করা হয়েছিল, সেই মাটি কি ভাল ভাবে পরীক্ষা হয়েছিল নির্মাণের সময়ে? কত দিন তা পিলার ধরে রাখতে পারবে, তা কি দেখা হয়েছিল?’’

যদিও পার্থপ্রতিমের বক্তব্য, নির্মাণসামগ্রীর মান নিয়ে আপস হয়নি। সে রকম হলে নির্মাণের পরে পরেই ফাটল তৈরি হত। কিন্তু এত দিন পর ফাটল দেখা দিয়েছে মানে ‘লংটার্ম সেটলমেন্ট’-এর কারণে এটা হয়েছে। তাঁর বক্তব্য, কারণ যা-ই হয়ে থাকুক না কেন, রক্ষণাবেক্ষণ জরুরি ছিল, যেটা সময়ে সময়ে হয়নি।

রক্ষক কি উদাসীন? মেট্রো কর্তৃপক্ষের দাবি, তাঁরা নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করেন। চলে নজরদারিও। প্রত্যাশিত ভাবেই কবি সূভাষের ঘটনা নিয়ে রাজনৈতিক চাপানউতরও শুরু হয়েছে। সিপিএম দোষ চাপিয়েছে প্রাক্তন রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর। তৃণমূল পাল্টা বলেছে, যখন স্টেশন নির্মাণ হয়েছিল, তখন সিপিএমের সমর্থনে কেন্দ্রে ক্ষমতায় ছিল ইউপিএ-১ সরকার। রেলমন্ত্রী ছিলেন লালু প্রসাদ। ফলে দায় সিপিএমের। রাজনৈতিক তর্কবিতর্ক যা-ই থাক, মেট্রোর কবি সুভাষ প্রান্তিক স্টেশন দিয়ে নিত্যযাত্রীদের দৈনন্দিন যাত্রা যে ব্যাহত হবে অন্তত আগামী এক বছর, তা নিয়ে কোনও তর্ক নেই।

Kolkata metro services Metro Services disrupted Garia
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy